বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে পিছু হটে পাকিস্তানি সেনারা। পঞ্চগড় চিনিকল এলাকা তখন ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত। কিন্তু তখনো চিনিকলের গ্যারেজের সামনে উড়ছিল পাকিস্তানের পতাকা। স্টেনগান কাঁধে নিয়েই দৌড় দেন হারুন অর রশিদ। পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে তিনি ওড়াতে যাচ্ছিলেন লাল–সবুজের প্রিয় পতাকা। পাশের বাংকারে আহত অবস্থায় পড়ে থাকা পাকিস্তানি এক সেনার গুলিতে হঠাৎ ঝাঁঝরা হয়ে যায় হারুনের বুক। পঞ্চগড় মুক্ত হওয়ার আনন্দ সেদিন বিষাদে পরিণত হয়েছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হারুনের রক্তে।

একাত্তরের টগবগে যুবক হারুন সবার কাছে পরিচিত ছিলেন রবি নামে। বড় ভাই হামিদুর রহমানের সঙ্গে ভারতের মুজিব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন সম্মুখযুদ্ধে। একাত্তরের ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় চিনিকল এলাকায় উড়তে থাকা পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে গিয়ে শহীদ হন তিনি। এরপর তাঁকে দাফন করা হয় ভারতের কোটগাছ বিএসএফ ক্যাম্পের সামনে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হারুনের এমন বীরত্বের কথা আজও শোনা যায় তাঁর সহযোদ্ধাদের কাছে। পঞ্চগড় জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও মেলে তাঁর সাহসিকতার বর্ণনা।

শহীদ হারুন অর রশিদের বাড়ি পঞ্চগড় সদরের হাড়িভাসা ইউনিয়নের উত্তর প্রধানপাড়া এলাকায়। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে হারুন ছিলেন চতুর্থ। মুক্তিযুদ্ধের সময় হারুন বিএ পরীক্ষার্থী ছিলেন। ওই সময় পাকিস্তানিদের অত্যাচারে তাঁর পরিবারের অন্যরা ভারতে আশ্রয় নিলেও বড় ভাই হামিদুর রহমানের সঙ্গে হারুন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে তাঁরা ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

২৮ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর চেকপোস্ট থেকে বর্ষিত হয় শত শত গোলা। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ভূমিকম্পের মতো প্রকম্পিত হয় পঞ্চগড়ের মাটি। ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। ২৯ নভেম্বর সকালে তাঁরা পঞ্চগড় শহরের উপকণ্ঠে ফকিরের হাট এলাকায় পাকিস্তানি ১২টি ট্যাংককে পিছু হটিয়ে দুপুর নাগাদ এগিয়ে আসেন পঞ্চগড় চিনিকল পর্যন্ত। সেখানেই ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের শক্ত ঘাঁটি। সেখানে বাংকার তৈরি করে যুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে পাকিস্তানি সেনারা পঞ্চগড় চিনিকল এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর একসময় চিনিকল এলাকায় চারদিকে সুনসান নীরবতা দেখে ওই এলাকা পাকিস্তানি সেনা মুক্ত হয়েছে ভেবে মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা ধ্বনি দিতে থাকেন। কিন্তু তখনো চিনিকল এলাকায় গ্যারেজের সামনে একটি পাকিস্তানের পতাকা উড়ছিল। হঠাৎ করেই এমন দৃশ্য দেখে আর স্থির থাকতে পারেননি সাহসী যোদ্ধা হারুন অর রশিদ। স্টেনগান কাঁধে নিয়েই হারুন দৌড়ে গিয়ে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ফেলে বাংলাদেশি পতাকা ওড়াতে যান। এ সময় পাশের একটি বাংকারে আহত অবস্থায় পড়ে থাকা পাকিস্তানি এক সৈনিকের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় হারুনের বুক। এ সময় তাঁর বড় ভাই কোম্পানি কমান্ডার হামিদুর রহমানও ছিলেন।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদের বীরত্বের কথা পাওয়া যায় নাজমুল হকের লেখা পঞ্চগড় জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মাহবুব আলমের লেখা গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে বইয়ে।

default-image

প্রতিবছরের ২৯ নভেম্বর পালন করা হয় পঞ্চগড় মুক্ত দিবস। শহীদ হারুন অর রশিদের নামে পঞ্চগড় চিনিকল এলাকায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। তবে তাঁর গ্রামের বাড়ি এলাকায় ঢাঙ্গীপুকুর থেকে বাঙ্গালপাড়া সড়কের নামকরণ করার কথা থাকলে তা বাস্তবায়িত হয়নি। শহীদ হারুনের কবরটি বাংলাদেশে নিয়ে আসার দাবিও পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের। এদিকে হারুন অর রশিদ শহীদ হওয়ার কিছুদিন আগে তাঁর বাবার কাছে যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে সত্য ও ন্যায়ের পথে নিজেদের লড়াই, বীরত্ব আর বিজয়ের আত্মবিশ্বাস উঠে এসেছে। সেই চিঠি এখনো তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে সংরক্ষিত আছে।

চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

‘৮.৮.৭১

আব্বা,

আচ্ছালামো আলায়কুম। আশা করি বাড়ীর সকলে মঙ্গল মতে আছেন। আপনাদের দোয়ায় আমরা ভাল আছি। এতদিন ধরে খুব ব্যস্ত ছিলাম বলে চিঠি লিখতে পরিনি। অবশ্য এখন সৈনিক তাই সৈনিকের ফুরসত কোনদিন হয় না। তবুও হাতে যতটুকু সময় মেলে তার ভিতর দিয়ে আপনাদের খোঁজ করব। আম্মা কি রূপ আছে। বুজান, দুলাভাই, ডলি বুজান কেমন আছে। আপনারা বর্তমানে কোথায় আছেন। চিন্তা করার কিছু নাই। সময় হলেই বাড়ীতে ফিরব। মরতে একদিন হবেই। মরার আগে যেন ১০/২০টা পশ্চিমা জানোয়ারকে খতম করতে পারি এই দোয়াই করবেন। আমাদের মত কত ভাই প্রাণ দিল এবং এখনও দিচ্ছে। আমরা বর্তমানে পচাগড়ের পিছনে আছি। বাড়ীর সবাইকে দোয়া করতে বলবেন। আমাদের এ লড়াই সত্যের, ন্যায়ের। কাজেই জয় আমাদের হবেই। সেদিন বেশি দূরে নয়। দৈনিক ২/৪ জন পাক ফৌজ মরতে আছে। বিশেষ আর কি—

ভাইজিও অপর পৃষ্ঠায় লিখবে। খোদা হাফেজ।

ইতি,

রবি’

শহীদ হারুনের ছোট ভাই হাবিবুর রহমান প্রধান বলেন, ‘যুদ্ধের সময় হারুন ভাই বাবাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এর কয়েক মাস পরেই আমরা জানতে পারলাম, আমার ভাই শহীদ হয়েছেন। কিন্তু তাঁর কবরটা ভারতে হওয়ায় আমরা ইচ্ছেমতো কবর জিয়ারত করতে পারি না। আমাদের দাবি, আমাদের গ্রামে যে সড়কটি তাঁর নামে করার কথা ছিল, সেটি বাস্তবায়ন করা হোক এবং আমার ভাইয়ের কবরটি বাংলাদেশে আনা হোক।’

হারুন অর রশিদের সহযোদ্ধা সায়খুল ইসলাম বলেন, টগবগে যুবক হারুন যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন অকুতোভয়। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ভারতীয় মিত্রবাহিনীর মেজর শেরকির আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। আমাদের দাবি, হারুনের এই বীরত্বের কথা নতুন প্রজন্ম জানুক। তাঁর কবরটা বাংলাদেশে এনে সেখানে ইতিহাসসংবলিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ করা হোক। এই আবেদন আমরা দেশের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত জানাই।

হারুন অর রশিদের অপর সহযোদ্ধা নূরুল ইসলাম বলেন, শহীদ হারুনের সেই টগবগে চেহারাটা এখনো চেখে ভাসে। চিনিকল এলাকায় সুনসান নীরবতা দেখে আমরা মুক্ত ভেবে যখন জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছিলাম, ঠিক তখনই পাকিস্তানি পতাকাটা চোখে পড়ে হারুনের। সহ্য করতে না পেরে তিনি স্টেনগান কাঁধে একাই পাকিস্তান পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলতে যান। এ সময় যে পাকিস্তানি সেনা বাংকারে আহত অবস্থায় পড়ে ছিল, তা কেউ জানত না। ওই আহত সেনার গুলিতেই ঝাঁঝরা হয়েছিল হারুনের বুক। পঞ্চগড় মুক্ত হওয়ার দিনে এমন ঘটনা ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে কষ্টের।