নাম রইজুদ্দিন পশারী হলেও ‘রইজুদ্দিন নাইয়া’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনে মাছ ধরা ছিল তাঁর পেশা। ইলিশ ধরে পাচার করতেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেখান থেকে আনতেন কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্য। সেগুলো বিক্রি করতেন পিরোজপুরের কালোবাজারে। এর সুবাদে সুন্দরবনের নদীনালা পথঘাট ছিল তাঁর নখদর্পণে। এই অভিজ্ঞতাই সফল মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত করে পিরোজপুরের মাঝি রইজুদ্দিনকে। অন্ধকার জগতের মানুষটি হয়ে ওঠেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের কান্ডারি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা রইজুদ্দিন পশারীর জন্ম পিরোজপুরের দক্ষিণ বাদুরা গ্রামে। তাঁর বাবা হাজি মেহের চান পশারী ছিলেন মৎস্যজীবী। ১০ বছর বয়সে রইজুদ্দিন বাবার পেশায় যুক্ত হন। মাছ ধরার কাজে চষে বেড়াতে থাকেন বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন। অচেনা সাগর আর গহিন সুন্দরবনের নদী–খালের সঙ্গে ধীরে ধীরে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। এই চেনা পথ ধরেই রইজুদ্দিন পশারী হয়ে ওঠেন কালোবাজারি। তিনি বঙ্গোপসাগরে ধরা ইলিশ সুন্দরবনের নদী–খাল হয়ে ও সাগরপথে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে যেতেন। মাছ বিক্রির টাকায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে কিনতেন কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্য। চোরাইপথে পিরোজপুরে এনে সেগুলো বিক্রি করে সংসার চালাতেন। ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) জিয়া উদ্দিনের হাত ধরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
রইজুদ্দিন পশারী ২০০৩ সালে মারা যান। তাঁর ছেলে সোহরাব হোসেন বলেন, ‘আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর অবদান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা কয়েকটি বইয়ে স্থান পেয়েছে। এ নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই।
মেজর জিয়া উদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবনের সেই উন্মাতাল দিনগুলি বইয়ে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে রইজুদ্দিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে ৩০০ মাইল দূরত্বে সুন্দরবনে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি গড়ে তোলার পেছনে যাঁদের অবদান ছিল, তাঁদের মধ্যে রইজুদ্দিন অন্যতম।
জিয়া উদ্দিন লিখেছেন, ‘সুন্দরবনে ঘাঁটি স্থাপনের সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই আমরা সুন্দরবন হয়ে মুজিবনগরে চলে যাব কিংবা অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের প্রয়োজনটা জানাব—এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। এ জন্য লোক সংগ্রহ করতে লাগলাম। সমুদ্র দিয়ে ভারতে যাওয়ার পথ চেনে এমন লোক ও সমুদ্রপথের উপযোগী নৌকা এবং মাঝিও আমাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কারণ, সমুদ্রে যেকোনো নৌকা এবং যেকোনো মাঝি নিয়ে চলা সম্ভব নয়। এটা করতে গিয়ে আমার মনে পড়ল পিরোজপুরের রইজুদ্দিন নাইয়ার কথা।’
মেজর জিয়া উদ্দিন সুন্দরবনে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি গড়ে তোলার পরপরই ভারত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পরিবহনের জন্য নৌপথের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। এরপর তিনি খবর পাঠান রইজুদ্দিনের কাছে। তখন রইজুদ্দিন তাঁর বিশ্বস্ত লোকজন নিয়ে হাজির হন। এরপর তিনি নৌকা তৈরি করলেন। সুন্দরবনের গভীর অরণ্যের যেসব পথ দিয়ে রইজুদ্দিন চোরাচালান করতেন, সেই সব পথ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যেতে লাগলেন ভারতে। এসব কথা উল্লেখ আছে ৯ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক প্রধান নূরুল ইসলাম মনজুর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চল বইয়ে এবং ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর (অব.) এম এ জলিলের সীমাহীন সমর বইয়েও।
রইজুদ্দিন পশারী নৌপথে যাঁদের ভারতে পৌঁছে দেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসের, বরিশালের আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ও ৯ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক প্রধান নূরুল ইসলাম মনজুরও। পরবর্তী সময়ে রইজুদ্দিন ভারত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ এনে সুন্দরবনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কাজে যুক্ত থাকেন। তাঁর বহরে থাকা ১০–১২টি নৌকা এই কাজে ব্যবহার করেন।
রইজুদ্দিন পশারী শুধু মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের নৌপথে ভারতে নিয়ে যাওয়া এবং অস্ত্র–গোলাবারুদ আনার কাজে যুক্ত ছিলেন, তা নয়। বরং অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি সুন্দরবনের ক্যাম্পে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের বিপদের সময় দেবদূতের ভূমিকায় আবির্ভূত হতেন।
রইজুদ্দিন পশারীর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার খবর পৌঁছে যায় স্থানীয় রাজাকারদের কাছে। তারা ১৯৭১ সালের ৭ মে পিরোজপুরের দক্ষিণ বাদুরা গ্রামে রইজুদ্দিন পশারী ও তাঁর স্বজনদের ২১টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
পিরোজপুরের সাংবাদিক ও গবেষক জগৎ প্রিয় দাস বলেন, রইজুদ্দিন পশারীর মতো মানুষের সহযোগিতা না পেলে সুন্দরবনে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি স্থাপনের পর অস্ত্র, গোলাবারুদ পরিবহন দুরূহ হতো। পাশাপাশি নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়া সহজ হতো না। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবনের ঘাঁটি স্থাপনে রইজুদ্দিন পশারীর অবদান মনে রাখার মতো।