একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে দু-চারটির বিষয়ে জানা গেলেও গণহত্যার পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি। জেলায় কী পরিমাণ গণহত্যা হয়েছে, কোথায় কোথায় হয়েছে, তা খুঁজে বের করতে ২০১৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কিছুসংখ্যক স্থানীয় উদ্যোক্তার এই কমিটি যাত্রা শুরুর পর থেকেই তাঁদের নানা রকম অনুসন্ধান চালিয়ে আসছে। যার মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে গণহত্যা, যুদ্ধের স্থান ও ঘটনার লোমহর্ষক চিত্র। ২১ সদস্যের এই কমিটির দাবি, ইতিমধ্যে তারা নতুন করে জেলার ২১টি গণহত্যার স্থান ও ৯টি যুদ্ধস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছে।
চিহ্নিত গণহত্যার স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ সদরের বাগবাটি, শালুয়াভিটা, ভাটটিয়ারি, ভিতপুর, ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়, পুরাতন জেলাখানা যমুনার ঘাট, স্টেশনের পাশের হরিজন কলোনি, শিয়ালকোল, চুনিয়াহাটি, ভদ্রঘাট, সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিস, বাহিরগোলা পাওয়ার হাউস, চর মিরপুর, রায়গঞ্জের ভুইয়াগাতী, তাড়াশের মান্নাননগর, উল্লাপাড়ার হান্দিয়াল নওগাঁ ও মোহনপুর, শাহজাদপুরের তালগাছী, উল্লাপাড়া সলপ ঘোষপাড়া, বেলকুচির তামাই হুড়াসাগর নদীর পাড়।
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলায় ঘটা গণহত্যাগুলোর তালিকা তথ্য-উপাত্তসহ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোর তথ্য-উপাত্ত তাদের সংগ্রহে আছে। তাদের অনুসন্ধান এখনো চলছে।
একাত্তরের ২৭ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ শহরের ভাঙ্গাবাড়ি বাহিরগোলা এলাকায় সংঘটিত হয়েছিল এমনই এক গণহত্যা। সেদিন স্থানীয় ১২ জন নিরীহ বাঙালিকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়। গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই ঘটনার বিস্তারিত চিত্র। কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম তাঁর মুক্তিযুদ্ধের গ্রাম নতুন ভাঙ্গাবাড়ি নামক বইয়ে লিখেছেন, ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কাস্তে-লাঙল-হাইলানড়ি নিয়ে প্রতিদিন শহরে মিছিল করেছে নতুন ভাঙ্গাবাড়ির মানুষ। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা যখন নিরীহ বাঙালিদের ওপর হামলে পড়ে, তখন সারা দেশের মতো সিরাজগঞ্জেও ছড়াতে থাকে নানা গুজব। শহরের অন্যান্য এলাকার মতো ভীত হয়ে পড়ে নতুন ভাঙ্গাবাড়ির মানুষও। তারা প্রথমেই নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দিতে শুরু করে নারী ও শিশুদের। সামান্য কিছু মানুষ থেকে যায় বাড়ি বা সামান্য যা সম্পত্তি তা যেন লুটেরারা লুট করে না নিতে পারে, এ ভয়ে।
২৭ এপ্রিল ভোরে ঈশ্বরদী থেকে ট্রেনযোগে এসে শহরের বাহিরগোলা স্টেশনে নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। আক্রমণ চালায় নতুন ভাঙ্গাবাড়িসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় গ্রামের প্রায় সব বাড়িঘর। গুলি চালানো হয় মানুষ দেখলেই। পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয় ১২ জনকে। সেদিনের শহীদদের মধ্যে আছেন বন্দে আলী মিয়া, আসির উদ্দিন, নজরুল ইসলাম, রহিম বক্স তালুকদার, জিগা তালুকদার, জাহানারা বেগম, তাহমিনা খাতুন, হামিদুন নেছা, নুরুন্নাহার খাতুন, শুক্কুর আলী প্রামাণিক, আবুল হোসেন প্রামাণিক ও চান বিবি। এর মধ্যে শহীদ নজরুল ইসলামকে হত্যা করা হয় বাহিরগোলা স্টেশনের পাশে অন্যদের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে। তাঁর ঠাঁই হয় বাহিরগোলা স্টেশনের পাশের গণকবরে। শহীদ বন্দে আলী খান ও শহীদ আসির উদ্দিনের লাশ তাঁর আত্মীয়স্বজন বহুলী ইউনিয়নের আলোকদিয়া মাদ্রাসা গোরস্থানে নিয়ে পুরোনো কাপড় মুড়িয়ে দাফন করেন। শুক্কুর প্রামাণিক ও আবুল হোসেন প্রামাণিককে তাঁদের সন্তানেরা বাড়ির ঘরের মধ্যে দাফন-জানাজা ছাড়াই মাটিচাপা দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
ভাঙ্গাবাড়ি এলাকার শাহাদত হোসেন তখন ১৪ বছরের কিশোর। তিনি বলেন, ২৭ এপ্রিল ফজরের নামাজের সময় পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালিয়ে বেশকিছু লোককে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। তখন পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে এলাকায় প্রাপ্তবয়স্ক খুব কম মানুষই থাকতেন।
ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সরোয়ার্দী খান একাত্তরে ১৫ বছরের কিশোর। তিনি বলেন, ‘ওই দিন একের পর এক বৃষ্টির মতো গুলি করে পাকিস্তানি সেনারা। যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের তুলে আবার গুলি করে হত্যা করা হয়।
ভাঙ্গাবাড়ির মতোই আরেক নির্মম গণহত্যা ঘটে জেলার বেলকুচি উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার উত্তরে রাজাপুর ইউনিয়নের বয়ড়াপাড়ায়। একাত্তরের গণহত্যা: যমুনার পূর্ব-পশ্চিম বইটিতে শফিউদ্দিন তালুকদারের বর্ণনায় সেই গণহত্যার চিত্র পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, সেখানেই এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী যতীন্দ্র মোহন সাহার বাড়ি। পাকিস্তানি সেনাদের বাহিনীর ভয়ে ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে সিরাজগঞ্জ শহর থেকে কয়েকজন আত্মীয়স্বজন তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেন। ১৩ মে ভোরে কয়েকজন রাজাকারের যোগসাজশে পাকিস্তানি সেনারা যতীন্দ্র মোহন সাহার বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এরপর পরিবারের সদস্য, বাড়ির কর্মচারী, আত্মীয়স্বজনসহ ১৭ জনকে আটক করে সিরাজগঞ্জ শহরে নিয়ে যায়। ওই দিন বিকেলের দিকে সিরাজগঞ্জ ফেরিঘাটে জেটির ওপর দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশগুলো খরস্রোতা যমুনায় ফেলে দেয় তারা।
অনুসন্ধান কমিটি বলছে, এভাবেই অসংখ্য গণহত্যা হয়েছে যমুনাপারের এই জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলজুড়ে। যেগুলোর ইতিহাস রচিত হয়নি, রয়েছে অগোচরে। জেলার প্রতিটি গণহত্যা ও যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া ইউনিয়নের প্রধান সড়কে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকার সঙ্গে নিহত সাধারণ মানুষের নামসহ ফটক নির্মাণের প্রস্তাব করছেন এই কমিটি।
সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম বলেন, তাঁরা বাংলাদেশের অন্তত একটি জেলাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ’ হিসেবে দেখতে চান। যার প্রতিটি গ্রামে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন। প্রতিটি সড়ক থাকবে মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদদের নামে, একইভাবে পাঠাগার, স্কুল-মাদ্রাসার নামও থাকবে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বা কোনো মুক্তিবাহিনীর নামে। গ্রামের কোন বাড়ি শহীদ পরিবারের, কোন বাড়ি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের বাড়ি, কোথায় কোথায় হয়েছে নারী নির্যাতন-অগ্নিসংযোগ, তাও জানা থাকবে গ্রামের সবার।