বিজ্ঞাপন
default-image

পুরো দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা। এস কে ফোর্স ও জেড ফোর্স গঠন। স্বাধীনতা যুদ্ধের নকশা প্রণয়ন এবং যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার শপথ। সম্মুখ সমরের পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের ওপরও গুরুত্বরোপ। মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত ছিল এগুলো। এর সবই এসেছিল গোপন এক বৈঠক থেকে। তাতে অংশ নেন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৭ জন সেনা কর্মকর্তা।

সেই বৈঠকটি হয়েছিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা–বাগান ব্যবস্থাপকের বাংলোতে। তাই মনে কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতার কোনো ছবি আঁকলে সেখানে তেলিয়াপাড়া বাংলোটা জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে। হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তেলিয়াপাড়া চা-বাগান। জেলার মাধবপুর উপজেলার মধ্যে পড়েছে স্থানটা। চারপাশে শুধুই সবুজের বেষ্টনি। নির্জন এই স্থানকেই নিরাপদ মনে করেছিলেন স্বাধীনতাকামী ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মহান মুক্তিযুদ্ধ–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে এখানে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল বসেছিলেন গোপন বৈঠকে।

ঐতিহাসিক ওই বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী (এম এ জি ওসমানী)। তিনি ভারতের আগরতলা থেকে এসে ওই বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন তৎকালীণ কর্নেল এম এ রব, মেজর সি আর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, লে. কর্নেল সালাউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন নাসিম, লে. সৈয়দ ইব্রাহীম প্রমুখ। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বৈঠকে অংশ নেন ব্রিগেডিয়ার শুভ্রমানিয়ম, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল।

ওই বৈঠক থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে পুরো দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। বৈঠক থেকে এস কে ফোর্স ও জেড ফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত আসে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বড় ভূমিকা রেখেছিল এই দুটি বাহিনী। তা ছাড়া অংশগ্রহণকারীরা একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আরও কিছু অতিগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এসেছিল এই বৈঠক থেকেই। বৈঠক শেষে এম এ জি ওসমানী নিজের পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ওসমানী ও রবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের নকশা প্রণয়ন এবং যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার শপথ করানো হয়। শপথবাক্য পাঠ করান এম এজি ওসমানী। সেই সময় তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের বাংলোটিকে ৩ নম্বর সেক্টরের সদরদপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তেলিয়াপাড়া চা-বাগান থেকে ওই কার্যালয় সরিয়ে নেওয়া হয়।

এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মিশে আছে এই তেলিয়াপাড়া চা- বাগানের বাংলোয়। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী সম্মুযুদ্ধেরও সাক্ষী বাংলোটি। কিন্তু ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি আজও তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকদের বাংলো হিসেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অবশ্য ২, ৩ ও ৪ নম্বর সেক্টরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বাংলোর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে নির্মিত হয়েছে তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ।

বুলেটের আকৃতিতে তৈরি এই স্মৃতিসৌধের প্রবেশের পথে রয়েছে দুটি ফলক। তাতে অঙ্কিত রয়েছে কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ শিরোনামের বিখ্যাত কবিতার পঙ্‌তিমালা। দক্ষিণ দিকে লাগানো ফলকটি জানান দেয়, এ স্থানটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত। সেখানে স্মৃতিফলকে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, সাবেক সেনা ও সরকারি কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা ৩৩ জনের নামের তালিকা।

চা-বাগানের সবুজের বেষ্টনীতে স্মৃতিসৌধ ছাড়াও আছে একটি প্রাকৃতিক হৃদ। লাল–শাপলা ফোটা এই হৃদ বর্ষাকালে অপরূপ হয়ে ওঠে। স্মৃতিসৌধ থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই ঐতিহাসিক বাংলোটি। এখানকার ৪ এপ্রিলের সেই ঐতিহাসিক বৈঠকের একটি ভাস্কর্য রয়েছে মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে। সেটি তেলিয়াপাড়ার এই বাংলোতেই স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু কী কারণে তা হয়নি বিষয়টি অনেকের কাছেই অস্পষ্ট।

প্রতিবছর ৪ এপ্রিল ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস হিসেবে পালিত হয়। তেলিয়াপাড়ার বাসিন্দা মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক দেওয়ান আশ্রাব আলীর এক লিখিত তথ্যে জানা যায়, খালেদ মোশারফের নির্দেশে দেওয়ান আশ্রাব আলী তেলিয়াপাড়া চা–বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে জঙ্গল কেটে ভারতে জীপ যাওয়ার মতো একটি রাস্তা নির্মাণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাৎপর্যময় বাংলোটিতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরির পরিকল্পনা আছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি।

হবিগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘তেলিয়াপাড়া বাংলোটি আমাদের গর্বের, বহু ত্যাগের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী। এটি এখনও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসেনি। এখনও সেটি তেলিয়াপাড়া চা–বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলো হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।’ বাংলোটির নিয়ন্ত্রণ সরকারের কাছে নিয়ে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মর্জিনা আক্তার বলেন, বাংলোটিকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রূপান্তরিত করা যায় কি না, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অনেক আগেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আসেনি।