বিজ্ঞাপন
default-image

বরিশাল নগরের ওয়াপদা কলোনি ছিল পাকিস্তানি সেনাদের টর্চার সেল। সেখান থেকে যাঁরা প্রাণ নিয়ে ফেরেন, তাঁদের একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ এম জি কবির ভুলু। ১৯ দিন অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন তিনি। পরে কারাগারে কাটান আরও ৭১ দিন। এরপর মুক্তি পেয়ে আবার রণাঙ্গণে ফেরেন লড়াকু এই সৈনিক।

সুশান্ত ঘোষের মুক্তিযুদ্ধে বরিশালের কিশোর ইতিহাস, এশিয়াটিক সোসাইটির মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, সুকুমার বিশ্বাসের মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবরসহ বিভিন্ন বইয়ে বরিশালের ওয়াপদা কলোনির টর্চার সেলের বিভিন্ন তথ্য মেলে। এসব বইয়ের তথ্য মোতাবেক, হানাদার বাহিনী বরিশালে প্রবেশ করে ২৫ এপ্রিল। স্টিমারঘাট, বিসিক ও চরবাড়িয়া এলাকা দিয়ে শহরে প্রবেশ করে তারা। পথে নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করে। ২৯ এপ্রিল পাকিস্তানিরা পাউবোর ওয়াপদা কলোনি দখল করে। অপেক্ষাকৃত নির্জন এই এলাকা ক্যাম্প স্থাপনের জন্য বেছে নেয়। এখান থেকেই ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও ভোলায় অভিযান চালাত হানাদারেরা। ক্যাম্পের পশ্চিম দিকে সাগরদী খালের তীরে বাংকার তৈরি করে সশস্ত্র পাহারা বসানো হয়। ওয়াপদা কলোনিতে ক্যাম্পের পাশাপাশি একাধিক ভবনে টর্চার সেল স্থাপন করে হানাদারেরা। ২৫ নম্বর ভবনে অসংখ্য বাঙালি মুক্তিকামী নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়। প্রতিদিন ট্রাকে করে বাঙালিদের ধরে আনা হতো টর্চার সেলে। ভোররাতে তাঁদের পাশের সাগরদী খালের পাড়ে নিয়ে গুলি করে মেরে মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হতো।

ওয়াপদা কলোনির টর্চার সেলে নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা কবির ভুলুকে। সেই দুঃসহ দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করেন তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে।

একাত্তরের ১৬ জুলাই। সকালে আগৈলঝাড়ার গ্রামের বাড়ি থেকে একটি স্টেনগান, হ্যান্ড গ্রেনেডসহ নৌকায় ওঠেন ভুলু। সঙ্গে ছিলেন সহযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন আর নৌকার মাঝি মেহের আলী। গন্তব্য ছিল বরিশাল সদরের চর কমিশনার। পথে গৌরনদীর বাটাজোর খালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন তাঁরা। নৌকা থেকে তুলে পিঠমোড়া করে খালের কিনারে তোলা হয় ওই তিনজনকে। ওই দিন তাঁদের রাখা হয় গৌরনদী কলেজের সেনাক্যাম্পে। সেখান থেকে প্রথমে বাটাজোর সেনাক্যাম্প ও পরে বরিশালের ওয়াপদা কলোনি। টর্চার সেলে টানা ১৯ দিন তাঁদের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন।

কবির ভুলু বলছিলেন, প্রতিদিনই চলত সীমাহীন নির্যাতন। বেয়নেট দিয়ে শরীর খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা হতো। পিঠমোড়া করে বেঁধে যতক্ষণ জ্ঞান থাকত, ততক্ষণ চলত নির্যাতন। সহযোদ্ধা আনোয়ার ছিলেন সুঠাম দেহের। একদিন ভোররাতে তাঁকে কক্ষ থেকে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। আনোয়ার হাঁটতে পারছিল না। তাকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। তারপর গুলির শব্দ। এরপর আর আনোয়ারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিছুদিন পর ছেড়ে দেওয়া হয় নৌকার মাঝি মেহেরকে।

কবির ভুলু বলেন, ওয়াপদা কলোনির টর্চার সেলে ১৯ দিন রাখার পর তাঁকে নেওয়া হয় যশোর ক্যান্টনমেন্টে। নেওয়া হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ২১ অক্টোবর কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। ছাড়া পেয়ে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া ক্যাম্পে যান। আবার যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। পরে মেহেন্দীগঞ্জের পাতারহাটের সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবহিনী কারফিউ দিলে লঞ্চে করে বরিশাল ত্যাগ করে। ওই দিন মুক্তিযোদ্ধারা নগরে প্রবেশ করেন।