ঝালকাঠিতে এ পর্যন্ত ২৪টি বধ্যভূমি ও ১টি গণকবর শনাক্ত করা হয়েছে। এসব স্থানে একাত্তর সালে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা। দুটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হলেও অন্যগুলো সংরক্ষণে সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেই। স্থানীয় উদ্যোগে কয়েকটি জায়গায় নামফলক বসানো হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও জেলার বেশির ভাগ বধ্যভূমি অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকায় ক্ষুব্ধ শহীদ পরিবার ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
ঝালকাঠিতে শনাক্ত বধ্যভূমিগুলো হচ্ছে সদর উপজেলার পৌর খেয়াঘাট বধ্যভূমি, পালবাড়ি গোডাউনঘাট বধ্যভূমি, সচিলাপুর বধ্যভূমি, গাবখান বধ্যভূমি, ডুমুরিয়া বধ্যভূমি, ভীমরুলি বধ্যভূমি, শতদশকাঠি স্মৃতিলক্ষ্মী বালিকা বিদ্যালয় বধ্যভূমি, জগদীশপুর বধ্যভূমি, রামানাথপুর বধ্যভূমি, বেশাইনখান বধ্যভূমি, খায়েরহাট বধ্যভূমি, খাজুরিয়া গাইনবাড়ি বধ্যভূমি, কালীদাশ বাড়ি বধ্যভূমি, কুনীহাড়ি বধ্যভূমি, নবগ্রাম নাপিতখালী বধ্যভূমি, বেড়মহল বধ্যভূমি, গুয়াটন বধ্যভূমি; নলছিটি উপজেলার ষাটপাকিয়া ফেরিঘাট বধ্যভূমি, রাজপাশা বধ্যভূমি, তামাকপট্টি বধ্যভূমি, মানপাশা ঋষিবাড়ি বধ্যভূমি, রাজাপুর উপজেলার বাঘরী থানাঘাট বধ্যভূমি, কাঁঠালিয়া উপজেলার আমুয়ার বাঁশবুনিয়া দাশেরবাড়ি বধ্যভূমি ও আওরাবুনিয়া হাইস্কুল মাঠ বধ্যভূমি। এ ছাড়া রাজাপুরে রয়েছে দক্ষিণ কাঠিপাড়া গণকবর। রাজাপুর শহরের গোডাউনঘাট বধ্যভূমির জায়গাটি এখনো চিহ্নিত হয়নি।
রাজাপুর বাঘরী থানাঘাট বধ্যভূমিতে উপজেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। নলছিটির ষাটপাকিয়া বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ হয়েছে পৌরসভার উদ্যোগে। ঝালকাঠি পৌর খেয়াঘাট বধ্যভূমিতে জেলা পরিষদের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে এই কাজ বেশি দূর এগোয়নি।
ঝালকাঠির বধ্যভূমিগুলোর তথ্য মেলে একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর (সুকুমার বিশ্বাস), বরিশালের ইতিহাস (সিরাজ উদ্দিন আহমেদ) ও মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল (সুকুমার বিশ্বাস) বইয়ে। ঝালকাঠি শহরের সুগন্ধা নদীর পাড়ে পৌর খেয়াঘাট এলাকায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা। তীব্র নদীভাঙনে হত্যাযজ্ঞের স্থানটি বিলীন হয়ে গিয়েছিল। পরে সেখানে নতুন চর জাগে। এই বধ্যভূমিতে সরকারিভাবে ২০১৪ সাল থেকে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা প্রতিরোধ দিবসে প্রদীপ প্রজ্বালন করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।
ঝালকাঠির অন্য বধ্যভূমিগুলোও অবহেলিত। জেলা শহরের পালবাড়ি গোডাউনঘাট এলাকায় ৭ শতাধিক লোককে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ঘাটটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সেখানে কোনো স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি।
বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে ঝালকাঠিতে আশ্রয় নিতে এসেছিল বহু মানুষ। এমন কয়েক হাজার মানুষকে সদর উপজেলার কীত্তিপাশা ইউনিয়নের বিলাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে হত্যা করা হয়। কীত্তিপাশা ইউনিয়নের জগদীশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মাঠের এক প্রান্তে মাটি দিয়ে একটি বেদি তৈরি করে রেখেছে এলাকাবাসী। রাজাপুর উপজেলায় বাঘরী খালের ঘাট বধ্যভূমিতে পাকিস্তানি বাহিনী ৫ শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। এই বধ্যভূমিতে উপজেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। তবে উপজেলার শুক্তাগড় ইউনিয়নের দক্ষিণ কাঠিপাড়া গণকবরটি অযত্নে পড়ে আছে। শহীদ পরিবারের সন্তান শান্তিরঞ্জন বড়াল বলেন, ২০১০ সালের ৯ এপ্রিল কাঠিপাড়া গণকবরটি শনাক্ত হয়। জেলা পরিষদের অর্থায়নে সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর বাইরে এখানে স্মৃতিফলক নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
১৯৭১ সালের ২৫ মে কাঁঠালিয়া উপজেলার আমুয়া বাঁশবুনিয়া দাশেরবাড়ি গ্রামে ৩৯ জনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে জেলা পরিষদের সামান্য বরাদ্দে জায়গাটি চিহ্নিত করা হয়েছে। উপজেলার আওড়াবুনিয়া হাইস্কুল মাঠ বধ্যভূমিতে ২৫ জনকে হানাদারেরা হত্যা করে। তবে সুনির্দিষ্ট করে স্থানটি চিহ্নিত করা যায়নি।
নলছিটির হিন্দু ব্যবসায়ীদের বৈঠকের কথা বলে থানায় ডেকে আনা হয়। রাতে উপজেলার ষাটপাকিয়া ফেরিঘাটে ১৭ জনকে নিয়ে হাত বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালে নলছিটি পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ওই স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে।