বিজ্ঞাপন
default-image

কথা ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরকে শত্রুমুক্ত করতে একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী পেছন থেকে গোলাবর্ষণ করবে। আর এই সমর্থন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের দিকে এগিয়ে যাবেন। কিন্তু মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সহযোগিতা ছাড়াই এগিয়ে যাওয়ার। ১৪ ডিসেম্বর অল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পার হন মহানন্দা নদী। শত্রুপক্ষের অবস্থান ভাঙতে ভাঙতে তিনি সতীর্থদের ছেড়ে একাই অনেকখানি এগিয়ে যান। হঠাৎ শত্রুপক্ষের গুলিতে শহীদ হন তিনি।

মাতৃভূমির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানের নাম মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা ও অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ৭ নম্বর সেক্টরের মোহদিপুর সাব সেক্টরের এ কমান্ডারকে দেওয়া হয় ‘বীরশ্রেষ্ঠের’ খেতাব।

বরিশালের বাবুগঞ্জের বীর সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ প্রাঙ্গণের পবিত্র ভূমিতে চিরনিদ্রায় শায়িত। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখকদের মতে, আম-কাঁসা, রেশম-লাক্ষা ও নকশিকাঁথা চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীর কাছে গর্বের; তার চেয়ে বেশি গর্বের মহান মুক্তিযুদ্ধে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের অসামান্য বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব ও মাতৃভূমির জন্য তাঁর আত্মবলিদান।

পরম শ্রদ্ধাভরে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ ১৪ ডিসেম্বর তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করতে আসে যেমন, তেমন শ্রদ্ধা জানাতে মানুষ আসে তাঁর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল যে স্থান মহানন্দা নদী তীরের রেহাইচরে নির্মিত স্মৃতিসৌধেও।

ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের প্রসঙ্গ উঠলে আজও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সব মুক্তিযোদ্ধার বুক গর্বে ফুলে ওঠে। তাঁকে কাছ থেকে দেখা, তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধ করা বা অন্যের কাছ থেকে তাঁর সম্পর্কে শোনা মুক্তিযোদ্ধারাও মেলে ধরেন যুদ্ধকালের গল্পের ঝাঁপি। তিনি সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কোমলে-কঠোরে মেশানো সিংহহৃদয় এক বীর নায়ক। কমান্ডার হিসেবে যেমনই ছিল তাঁর কঠোর শাসন, তেমনই ছিল হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। আজও তাই এই বীর কমান্ডারের গল্প বলতে গিয়ে বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয় তাঁর অধীন সাব সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের। চোখের কোন চিক চিক করে ওঠে। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্তির দ্বারপ্রান্তে এসে তাঁর শহীদ হওয়ার সংবাদ শুনে ডুকরে কাঁদেননি এমন মুক্তিযোদ্ধা মেলা ভার। তাঁরা কেঁদেছেন যেমন, তেমনই শোক সামলে উঠে প্রতিশোধের নেশায় শত্রুর ওপর অমিততেজে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি ছিনিয়ে এনেছেন।

অনেকের কাছেই গল্প শোনা যায়, তিনি শুধু যুদ্ধই করতেন না, যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে পড়তেন বিশ্বের বিপ্লবী নেতাদের লেখা বইও। স্বপ্ন দেখতেন শোষণমুক্ত বাংলাদেশের।

এমন অভিমত চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বইয়ের লেখক মো. এনামুল হক ও অধ্যাপক মাযহারুল ইসলামেরও। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাঁদের মতে, বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ছিলেন বামঘেঁষা বিপ্লবী মতাদর্শের লোক। যুদ্ধে আত্মরক্ষার কৌশল অনেক সময় মানতেন না তিনি। যুদ্ধের সময় নিজের জীবনের কোনো পরোয়া করতেন না বরাবরই।

তাঁর সম্পর্কে ৭ নম্বর সেক্টরের আর এক বীর সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দীন চৌধুরীর মন্তব্য, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ছিলেন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ একজন বিপ্লবী মানুষের মতো। নিজের আত্মরক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতেন না। বেপরোয়া যোদ্ধা বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তেমনটাই। হয়তো এ জন্যই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এ নিয়ে তাঁকে একাধিকবার সতর্কও করা হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যেমন উল্লেখ আছে, তেমনই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও শোনা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরকে মুক্ত করতে ১১ ডিসেম্বর পেছন থেকে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণের। আর এই সমর্থন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের শহরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু পরবর্তী ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়াই চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর মুক্ত করবেন। শহরের বিপরীতে বারঘরিয়া থেকে মহানন্দা নদী পার হন অল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়েই। শত্রুপক্ষের অবস্থান ভাঙতে ভাঙতে তিনি সতীর্থদের ছেড়ে একাই অনেক এগিয়ে যান। এ সময় শত্রুপক্ষের গুলিতে তিনি নিহত হন।

সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ব্যক্ত করা ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে আর এক বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মেজর নাজমুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পর ১৬ ডিসেম্বর নবাবগঞ্জ কলেজ মাঠে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে এক বিরাট সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সমাবেশে মেজর গিয়াস উদ্দীন চৌধুরী মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের শহীদ ক্যাপ্টেন নামানুসারে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাম জাহাঙ্গীরাবাদ করার প্রস্তাব করেন। উপস্থিত জনতা মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে সেই প্রস্তাব সমর্থন করেন। পরবর্তী সময়ে সেটি আর বাস্তবায়িত হয়নি।

তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মহানন্দা নদীর ওপর নির্মিত হয় বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু। তাঁর নামে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিনটি কলেজ। প্রতিবছর তাঁর নামে আয়োজন করা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে খেলাধুলা প্রতিযোগিতা।