বিজ্ঞাপন
default-image

রংপুরের মানুষজন সেদিন ভোর থেকে সমবেত হতে থাকেন নিসবেতগঞ্জ এলাকায়। হাজার হাজার বীর জনতার স্লোগান আর বিদ্রোহে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে শহর–গ্রাম। প্রতিবাদী মানুষ লাঠিসোঁটা, তির-ধনুক নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মুহূর্তেই রক্তাক্ত হয়ে ওঠে সবুজ প্রান্তর। ঘাঘট নদের পানিও যেন রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল।

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ। রংপুরের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় একটি দিন। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার এক দিন পরেই এ অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষ জেগে ওঠেন। ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে অকাতরে বিলিয়ে দেন নিজেদের জীবন।

এই ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের কয়েক দিন আগে থেকেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল রংপুর শহর। ৩ মার্চ স্লোগানে প্রতিবাদমুখর হাজারো মানুষের মিছিলে রেলওয়ে স্টেশন রোডের পাশে এক অবাঙালির বাড়ি থেকে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। শহীদ হন কিশোর শংকু সমজদারসহ তিনজন। স্বাধীনতা ঘোষণার আগেই রংপুরের প্রথম শহীদ হয় এ অঞ্চলে। এরপর থেকে প্রতিদিনই রংপুর উত্তাল হতে থাকে। স্বাধীনতাকামী মানুষ সংগঠিত হন। প্রস্তুতি গ্রহণ করেন সশস্ত্র সংগ্রামের। এরই অংশ হিসেবে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন স্বাধীনতাকামী মানুষ।

সিদ্ধান্ত হয় ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করা হবে। এর প্রস্তুতি হিসেবে স্বাধীনতাকামী মানুষদের জাগিয়ে তুলতে রংপুরের আশপাশ এলাকায় হাটে হাটে ঢোল পেটানো হয়। শুরু হয় সভা–সমাবেশ। চলে উঠান বৈঠক। রংপুরসহ আশপাশ এলাকায় ব্যাপক মানুষের সাড়াও মেলে। প্রতিটি পাড়া–মহল্লার বাড়িতে বাড়িতে তরুণ ও যুবকেরা তির–ধনুক বানাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বাড়ির পেছনে খোলা মাঠে কলাগাছ পুঁতে তির–ধনুক চালানো প্রশিক্ষণও চলে। একপর্যায়ে শহরের সাধারণ মানুষ ছাড়িয়ে এ আন্দোলনের ঢেউ লাগে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায় ওঁরাও ও সাঁওতালদের মধ্যে। জেলা শহরের পাশের মিঠাপুকুর উপজেলার বলদিপুকুরে ওঁরাও ও সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন তির-ধনুক নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ে তিরন্দাজ সাঁওতালদের ভূমিকা ছিল মনে রাখার মতো। তির-ধনুক, বল্লম, বর্শা নিয়ে তাঁরা যোগ দিয়েছিলেন এই ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও অভিযানে।

১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণে নিসবেতগঞ্জ এলাকা এবং ঘাঘট নদের পাড়ে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এসে সংগঠিত হতে থাকেন। জেলার উত্তম, রাজেন্দ্রপুর, নিসবেতগঞ্জ, পাগলাপীর, সাহেবগঞ্জ, নজিরের হাট, লাহিড়ির হাট, কেরানীরহাট, শ্যামপুর, পালিচড়া, বুড়িরহাট, গঙ্গাচড়া, দমদমা, মিঠাপুকুর, বলদীপুকুর, রানীপুকুর, তামপাট, দামোদরপুর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ একত্র হতে থাকেন। সবার হাতে ছিল লাঠিসোঁটা, তির-ধনুক, বর্শা, বল্লম। হাজার হাজার মানুষের উচ্চারিত স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে নিসবেতগঞ্জ এলাকার জনপদ।

এই ইতিহাসকে স্মরণ করে রাখতে ২০০০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সাবেক সেনাপ্রধান মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান নিসবেতগঞ্জ এলাকায় ‘রক্তগৌরব’ নামের স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০২ সালের ২১ নভেম্বর এই স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করা হয়। সেখানে এই দিনে প্রতিবছর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাঁওতাল ও ওঁরাওরাও এখানে আসেন। শহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।

‘রক্তগৌরব’ স্মৃতিস্তম্ভে লেখা রয়েছে, ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে সারা দেশের মতো রংপুরের সাধারণ জনতা মিছিল–মিটিং আর প্রতিবাদের আগুনে জ্বলে ওঠে। ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর পাকিস্তানি বাহিনী রংপুর শহরে নিরস্ত্র বাঙালির বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একই সঙ্গে রংপুরের ইপিআর বাহিনীর সদর দপ্তরে অবস্থানরত বাঙালিদের আক্রমণ করে। অনেক নিরীহ মানুষ নিহত হন। রংপুরে গুজব রটে যে বহু বাঙালি সৈনিককে সেনানিবাসে হত্যা করা হয়েছে। অনেককে বন্দী করা হয়েছে। বাঙালি সৈনিকদের হত্যা ও বন্দী করার সংবাদ বাইরে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সাধারণ জনগণ আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। ২৮ মার্চ ওঁরাও, সাঁওতাল ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীসহ মুক্তিকামী জনগণ ঢোল বাজিয়ে ঘাঘট নদের পাড়ে একত্র হয়ে সেনানিবাসের দিকে যাত্রা করেন। দেশপ্রেমে উন্মত্ত বাঙালি জনগণ দা, বল্লম, তির-ধনুক, লাঠিসহ হাতের কাছে যা ছিল, তাই নিয়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গে লড়াই করতে যান। এ সময় সেনানিবাসের ৪০০ গজের মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শত শতজন।

পাকিস্তানি সেনারা এরপর মৃত-অর্ধমৃত প্রায় ৫০০ জন মুক্তিকামী মানুষকে নিসবেতগঞ্জ এলাকায় পেট্রল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এ অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী বীর জনতার রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও অভিযানের কাহিনি নিয়ে চিয়ারি বা বুদু ওঁরাও কেন দেশত্যাগ করেছিল নামে একটি উপন্যাসও লিখেছেন রংপুরের কৃতী সন্তান কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। বইটি দেশ–বিদেশে বহুল আলোচিত হয়েছে।

রংপুরের মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ও নবচেতনায় ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের দিন রংপুরের মানুষ জেগে উঠেছিলেন। হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। কারও হাতে ছিল লাঠিসোঁটা। সাঁওতাল ও ওঁরাও সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে ছিল তির-ধনুক, বল্লম। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এভাবে পাকিস্তানি হায়েনাদের আবাসস্থল ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের ঘটনা ইতিহাসে বিরল।’

সেই দিনের কাহিনির বর্ণনা দিয়েছেন নিসবেতগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আমজাদ হোসেন। রংপুর সদর উপজেলার ওয়েবসাইটে তিনি লিখেছেন, ২৮ মার্চ সকালে লোকজন আসবে কি আসবে না, এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় ছিলেন তিনি। অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে কাঁপছিল তাঁর। এরই মধ্যে সকাল ১০টা বাজতে না বাজতেই চারদিক থেকে হাজারো মানুষের ঢল নামে। তারপর অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল। সবার হাতে বাঁশের লাঠি, ছোরা, বল্লম, কুড়াল। সেই সঙ্গে তির-ধনুকও। সবার মুখে ছিল গগনবিদারী স্লোগান।

শেখ আমজাদ হোসেন আরও লিখেছেন, ‘একটি মিছিলের সম্মুখে কমরেড ছয়ের উদ্দিন। মজিবর মাস্টারের নেতৃত্বে আরেকটি বিরাট মিছিল। ভুরাঘাট, বড়বাড়ী হয়ে লোকজন আসা শুরু করলো। বলদিপুকুর থেকে আব্দুল গণির নেতৃত্বে সাঁওতাল বাহিনী তির-ধনুক নিয়ে এসেছেন। রানীপুকুরের রূপসী বালারহাট, গোপালপুর সব জায়গা থেকেই লোকজন ছুটে আসছেন। পাগলাপীরের লোকজন লাহিড়ীরহাট হয়ে আসছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা বলরাম মহন্ত ও আব্দুল কুদ্দুসের বাহিনী। এ ছাড়া ঐতিহাসিক ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও অভিযানে তৎকালীন ছাত্রনেতা অলোক সরকার, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মনসুর আহমেদ ছিলেন। ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক হোসেনও।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আমজাদ হোসেন তাঁর লেখনীতে বলেছেন, ক্যান্টনমেন্টের পেছনে এখন যেখানে স্মৃতিস্তম্ভ ‘রক্তগৌরব’ দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে সবাই সমবেত হলেন। লোকে লোকারণ্য। মুক্তিকামী বীর জনতার হাতে বাঁশের লাঠি আর হানাদারদের হাতে আধুনিক অস্ত্র। সবাই লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে ক্যান্টনমেন্টের দিকে এগিয়ে চললেন। বালারখাইল পার হয়ে ক্যান্টনমেন্ট মার্কেটের কাছে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই শুরু হয়ে গেল মেশিনগানের গুলি। গুলিবিদ্ধ হলেন অনেকে। ছত্রভঙ্গ হওয়া শুরু হলো। আহতদের আর্তনাদে গোটা এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠল। অনেক মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

এসব স্মৃতি ধরে রাখতে রংপুর শহরের প্রবেশদ্বারে স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণে ব্যবহৃত তির-ধনুক আর লাঠিসোঁটাও রয়েছে স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য ‘অর্জন’-এ। ১৯৯৯ সালের ২৪ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে এই ভাস্কর্যের উদ্বোধন করা হয়। রংপুর জেলা পরিষদের উদ্যোগ ও অর্থায়নে এটি নির্মাণ করেছেন রংপুরের কৃতী সন্তান ভাস্কর অনিক রেজা।