১৯৪৪ সালের ৫ জুন, রাত ৯টা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্ত আসন্নপ্রায়। রেডিও ঘিরে সবাই বসে আছেন যুদ্ধের সর্বশেষ সংবাদ জানার জন্য। হঠাৎই সংবাদের মাঝখানে খসখস কণ্ঠে থেমে থেমে কেউ বলে উঠল, ‘জো’র সঙ্গে ইলিনের বিয়ে হয়েছে। ... সুয়েজে এখন গরম। ... কম্পাস উত্তরমুখী আছে। ... ছক্কাটা টেবিলের ওপর আছে।’ সাধারণ শ্রোতাদের কাছে এ কথাগুলো অর্থহীন মনে হলোও পাঁচ লাখ ফরাসি মুক্তিযোদ্ধার জন্য রেডিওতে শুনতে পাওয়া এ কথাগুলোই ছিল দীর্ঘপ্রতীক্ষিত গোপন বার্তা। বার্তা পেয়ে ফরাসি মুক্তিযোদ্ধারা জার্মান অধিকৃত ফ্রান্সে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এতে পরদিন জার্মানের সৈন্য আর সরবরাহ যানগুলোর গতি এতটাই কমে গেল যে নরমান্ডিতে মিত্রবাহিনীর অবতরণ ঠেকাতে তাদের সেখানে পৌঁছাতে গড়ে ৪৮ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় লাগল। বেতারে প্রচারিত সেই গোপন বার্তা ইতিহাসের মোড় পাল্টে দিল।
একাত্তরের আগস্টে আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও এমন একটি ঐতিহাসিক অভিযানের সূত্রপাত হয়, যেখানে রেডিও থেকে প্রচারিত বার্তা হাতিয়ারের চেয়েও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখে। অভিযানের নাম ছিল—অপারেশন জ্যাকপট। পরিচালিত হয়েছিল ১৫ ও ১৬ আগস্ট।
জুলাইয়ের শেষের দিকে নৌকমান্ডোদের প্রথম দলের প্রশিক্ষণ শেষ হয়। ২ আগস্ট থেকে তাদের ছয়টি দল অভিযানের জন্য সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অভিযান ১৩ আগস্ট দিবাগত রাতে হতে পারে বলে দলনেতাদের ধারণা দেওয়া হলেও অভিযানের চূড়ান্ত সময়ের বিষয়ে গোপন সংকেত হিসেবে তাদের দুটি গান শোনানো হয়। প্রথম গানটি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া—‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি’।
দ্বিতীয় গানটি পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া—‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’। তাদের বলা হয় আনুমানিক ১২ আগস্ট আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রথম গানটি বাজানো হবে। সেই গানটি শুনতে পেলে দলনেতা বুঝবে যে অভিযান অত্যাসন্ন এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয় গানটি শোনার অপেক্ষায় থাকবেন। দ্বিতীয় গানটি যখন শুনবেন, বুঝবেন—২৪ ঘণ্টার মধ্যে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে হবে। তবে প্রথম গানটি ১২ আগস্ট না শুনতে পেলে পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করবেন।
গান শোনার জন্য দলনেতাদের একটি করে ন্যাশনাল প্যানাসনিক ব্র্যান্ডের ৮ ইঞ্চি লম্বা তিন ব্যান্ডের ট্রানজিস্টার রেডিও দেওয়া হয়। ১৩ আগস্ট সকালে দলনেতারা শুনতে পেলেন তাঁদের কাঙ্ক্ষিত গান—‘ আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি’। ১৪ আগস্ট সকালে কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে দ্বিতীয় গানটি সম্প্রচার করা হয়। নৌকমান্ডোরা ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত অর্থাৎ ১৫ আগস্ট রাত থেকে ১৬ আগস্ট রাতের মধ্যে তাদের লক্ষ্যবস্তুগুলোতে সফলভাবে অভিযান পরিচালনা করলেন। সফল হলো অপারেশন জ্যাকপট।