১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট মোংলা সমুদ্রবন্দরের অভিযানটি ছিল দুঃসাহসিক অভিযানগুলোর একটি। এই অভিযানে সাবমেরিনার মো. আহসানউল্লাহকে প্রধান করে ৪৮ জন নৌকমান্ডোর একটি দল পাঠানো হয়। আমিও সেই দলের একজন সদস্য ছিলাম।
আমাদের ৫ আগস্ট সকালে ডায়মন্ড হারবারের কাছাকাছি ক্যানিং নদীবন্দরে আনা হয়। পরদিন সকালে কমান্ডোদের বিদায় জানান পলাশী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের খ্যাতিমান প্রশিক্ষক লেফটেন্যান্ট কপিল।
বেলা দুইটায় আমাদের দল ভারত সীমান্তের সর্বদক্ষিণে, হিঙ্গলগঞ্জ সাব-সেক্টরের কৈখালী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছায়। ৭ আগস্ট সন্ধ্যায় কৈখালী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে বিদায় নিয়ে আমরা মোংলা বন্দরের দিকে যাত্রা করি।
১২ আগস্ট পৌঁছাই খুলনার কয়রা থানার কালাবগি গ্রামে । ১৩ আগস্ট বিকেলে মোংলার কাছেই সুতারখালী গ্রামে এসে আমরা অস্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে বসলাম। সেদিন সকালেই আক্রমণের প্রস্তুতি-সংকেত পাওয়া গিয়েছিল। আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। বন্দরে রেকি করার জন্য ১৪ আগস্ট সকালে একজন গাইডের সঙ্গে দুজন কমান্ডোকে পাঠানো হয়।
বিকেলে পর্যবেক্ষণ দল ফিরে এসে বন্দরে জাহাজের সংখ্যা ও অবস্থান ব্যাখ্যা করল। বন্দরের ম্যাপ খুলে সব কমান্ডোকে ব্রিফ করলেন দলনায়ক আহসানউল্লাহ। মার্চ মাসের আগে মোংলা বন্দর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো ঘাঁটি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তান নৌবাহিনী এখানে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সুসংহত করে। বন্দরে অনেক গানবোট মোতায়েন করে।
দলনেতা আহসানউল্লাহ ১৪ আগস্ট সকালে সব কমান্ডোকে জঙ্গলের কিনারে একত্র করে সর্বশেষ নির্দেশের কথা জানিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাতে শপথ করালেন।
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। সবাই যৎসামান্য আহার সেরে নিজ নিজ ফিনস, ড্যাগার, সুইমিং কস্টিউম, পলিথিনে মুড়ে একটা দেশলাইও নিলেন সেফটি ফিউজ জ্বালানোর জন্য। পুরো শরীরে প্রচুর শর্ষের তেল মেখে যাত্রার জন্য অপেক্ষায় রইলাম। এখান থেকে বন্দরের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। নদীপথে বন্দরে পৌঁছাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগবে। জোয়ার ও ভাটার সময় পর্যবেক্ষণ করে অপারেশনের সময় নির্ধারিত করা হয়েছিল। রাত দুইটায় নদীতে ভাটার শেষ এবং জোয়ার শুরু হবে। তখন নদীতে পানি স্থিতিশীল থাকবে। এ অবস্থায় কমান্ডোদের সাঁতরাতে পরিশ্রম কম এবং মাইন স্থাপন করতে সুবিধা হবে। তা ছাড়া এ সময় ভাটার টানে কমান্ডোদের সাগরে ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু সুতারখালী থেকে মোংলা বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করার পর সময় নির্ধারণে ভুল ধরা পড়ে। স্রোতের বিপক্ষে নৌকা চালিয়ে মোংলা বন্দরে পৌঁছাতে ভোর হয়ে যায়।
বন্দরের বিপরীত পারে কিছু দূরে বানিয়াশান্তা গ্রাম। গ্রামটি পতিতালয় হিসেবে সমধিক পরিচিত। হঠাৎ এত সশস্ত্র ব্যক্তিকে দেখে তারা ভয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। চিৎকার–চেঁচামেচিতে এক হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে বসে তারা। নিরাপত্তার জন্য আমাদের গেরিলা দলের নেতা তাদের বুঝিয়ে যার যার ঘরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেন। কমান্ডোরা পায়ে ফিনস পরে, গামছা দিয়ে মাইন ও এক্সপ্লোসিভ বুকে বেঁধে কোমরে একটিমাত্র ড্যাগার গুঁজে গ্রুপসহ সন্তর্পণে নদীতে নেমে হাতে হাত ধরে নির্দিষ্ট জাহাজের দিকে সাঁতরে এগোতে থাকেন। অপর তীরে বন্দরের মসজিদ থেকে সে সময় ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল।
দলনেতা আহসানউল্লাহ কাছের ছয়টি জাহাজে মাইন লাগানোর নির্দেশ দিলেন। কমান্ডোর সংখ্যা ৪৮। প্রতি জাহাজের জন্য আটজন কমান্ডোকে নির্দিষ্ট করা হলো। নদীতে প্রবল স্রোত। অনবরত গানবোটের টহল। সার্চলাইটের উজ্জ্বল আলো থেকে নিজেকে লুকানোর জন্য প্রত্যেকে মুখের ওপর কচুরিপানা ধরে এগোতে থাকি। প্রতিকূল পরিবেশ কমান্ডো দলের পরম্পরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এতে অসুবিধা হলেও বিক্ষিপ্তভাবে সবাই মাইন স্থাপন করে প্রাণপণে সাঁতরে দ্রুত কূলে ফিরে আসি।
মোংলা বন্দরে ১৫ আগস্ট প্রথম অভিযানে কমান্ডোরা যখন প্রমত্ত পশুর নদের মাঝে জাহাজে মাইন লাগিয়ে তীরে ফিরছেন, তখন দিনের আলোতে জাহাজের ডেকে পাকিস্তানিরা বিক্ষিপ্তভাবে পায়চারি করছে। যখন মাইনের প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে, তখন ঘড়ির কাঁটা সকাল ছয়টা ছুঁয়ে গেছে। বিকট শব্দে একটির পর একটি বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। পশুর নদের তীরে এক প্রলয়ংকরী অবস্থার সৃষ্টি হয়। বাণিজ্যিক জাহাজগুলো গুরুতরভাবে আক্রান্ত বুঝতে পেরে টানা বিপৎসংকেত বাজিয়ে উদ্ধারের জন্য এসওএস বার্তা পাঠাতে থাকে। পাকিস্তানি গানবোট হেভি মেশিনগান থেকে নদীর পশ্চিম তীরে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালিয়ে গাছপালা, বাড়িঘর ঝাঁঝরা করে দেয়। মর্টারের শেলগুলো কমান্ডোদের মাথার ওপর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এসে পানি ও ঘাসের মধ্যে পড়ে। এর মাঝে আমরা কমান্ডোরা অপেক্ষমাণ নৌকায় চেপে দ্রুত স্থান ত্যাগ করি।
এ অভিযানে সমুদ্রগামী ছয়টি জাহাজ সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে যায়। এ ছাড়া ‘এসএস লাইটনিং’ নামের যে বৃহদাকার সোমালিয়ান জাহাজ পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য সমরাস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী বহন করে মোংলা বন্দরে এসেছিল, সেটিও আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই জাহাজে প্রায় ২০ হাজার টন যুদ্ধাস্ত্র গম ও খাদ্যসামগ্রীর নিচে লুকানো ছিল।
সূত্র: সম্মুখ যুদ্ধ ১৯৭১। মতিউর রহমান (সম্পাদনা)
সূত্র: ১৬ আগস্ট ২০২১ প্রথম আলোর বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত