বিজ্ঞাপন
default-image

মার্চ মাসের দ্বিতীয়ার্ধে শেখ মুজিবুর রহমান ও জেনারেল ইয়াহিয়ার মধ্যে যে আলোচনা শুরু হয় তাতে আমি সরাসরি সংশ্লিষ্ট দিলাম না। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আলোচকদলে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন, মোশতাক, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান ও কামাল হোসেনের মতো সিনিয়র রাজনীতিবিদরা। তবে আলোচনায় সময় সবাই সব সময় অংশগ্রহণ করেছিলেন, এমনও নয়। পশ্চিম পাকিস্তানি দলের সঙ্গে বৈঠকের সময় শেখ মুজিবুর একেক সময় একেক সাব-গ্রুপকে বাছাই করতেন। ৬ দফার ব্যাপারে পশ্চিমারা যদি কোনো নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করত বা এর কোনো কিছু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন হতো তখন আরো কয়েকজন অর্থনীতিবিদ সহকর্মীসহ আমার ডাক পড়ত এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সহায়তা করার জন্য। যা-ই হোক, ৬ দফা কর্মসূচির প্রায় সব দিকই আলোচকদলের সদস্যদের মধ্যে আলোচিত হয়েছে। ফলে আলোচনায় সময় আমাদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনায় তেমন প্রয়োজন ছিল না। আমার সঙ্গে বা আমাদের কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ প্রয়োজন হলেই করা হতো এবং এটা কোনো পূর্বনির্ধারিত ব্যাপার ছিল না। তাজউদ্দীন বা কামাল হোসেন খবর দিলে খুবই স্বল্প সময়ের নোটিশে তা অনুষ্ঠিত হতো।

এটা ব্যাপকভাবে ধারণা করা হতো এবং রাজনৈতিক আলোচনাকারীদের কাছ থেকে আমরা শুনতে পেরেছি যে অর্থনৈতিক ইস্যুতে আলোচনা ভালোই চলছে এবং একটি চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই আছে। এম এম আহমেদসহ অনেক বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত পশ্চিমাদের দল ৬ দফা কর্মসূচির অর্থনৈতিক দিক মেনে নিচ্ছে বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছিল। বৈদেশিক বাণিজ্যের আয় ও সাহায্য দুটি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে এবং বৈদেশিক নীতির বিষয়টি কেন্দ্রের হাতে থাকবে-এ ধরনের চুক্তি হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়েছিল।

ঢাকার স্টেট ব্যাংক অফিস রিজার্ভ ব্যাংক অব ইস্ট হিসেবে পরিচিতি পাবে এবং এর মাধ্যমেই বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব পৃথক করা হবে। ট্যাক্স সংগ্রহের বিষয়টিকে জটিল হিসেবে বিবেচনা করে এ ব্যাপারে আরো সময় লাগবে-এমন ধারণায়ও পৌঁছা গেছে এবং এটা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সে ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। এই সবকিছু তাত্ক্ষণিকভাবেই বাস্তবায়িত হবে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া দুই অঞ্চলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা দেবে-এমন সবকিছুই যেন ঠিকঠাক। অন্যদিকে দুই অঞ্চলের পার্লামেন্ট সদস্যরা পার্লামেন্টে বসার আগেই ৬ দফাও বাস্তবায়িত হবে। ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় শেষ পর্যায়ের সমঝোতা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সিদ্ধান্ত হয় ২৪ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিদল তাদের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিপক্ষদের সঙ্গে চূড়ান্ত বৈঠকে বসবে। কিন্তু তা আর হয়নি। পরিবর্তে এক দিন পর রক্তবন্যা বয়ে যায়।

একাত্তরে মার্চের দ্বিতীয়ার্ধে যে সমঝোতার আলোচনা চলছিল, সে ব্যাপারে হতাশাবাদী লোক হিসেবে আমি ছিলাম সন্দিহান। এতে কৃতিত্ব নেওয়ার কিছুই নেই কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানি পক্ষ এত মধুর ও যৌক্তিক আচরণ প্রদর্শন করা শুরু করেছে যে তা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি মনে করি যে আরো অনেকেই এমনটা ভেবেছে। কিন্তু সমঝোতাকারী দলের কাছ থেকে যত আশার কথা শোনা যাচ্ছিল, তা আমার ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে। আমি কিছুটা উদ্দীপিত বোধ করা শুরু করি এবং আমার মধ্যেও আশাবাদ দেখা দেয়। আমি ভেবেছিলাম যে হয়তো সামান্য কিছু সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হওয়ায় হয়তো শেষ পর্যন্ত পশ্চিমারা সমঝোতার পথ ধরেছে এবং ৬ দফা কর্মসূচি মেনে নিতে পারে।

আমার মনের মধ্যে যে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল তার অন্তত তিনটি কারণ রয়েছে। আমি আমার সহকর্মীদেরও বিভিন্ন সময় বিষয়টি বলেছি। আমার হতাশাবাদী মনোভাবের প্রথম কারণ ছিল বিভিন্ন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে নানা কমিশন ও কমিটিতে আলোচনার অভিজ্ঞতা। ৬ দফার তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের অনেক নমনীয় দাবির ব্যাপারে তারা কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল, তা আমি সহজেই মনে করতে পারি। এ অবস্থায় ৬ দফা দাবি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক ব্যাপারে ও সমঙ্দ পুনর্বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনো ক্ষমতা থাকবে না এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের-এটা পশ্চিমের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব বলে আমার মনে হয়নি।

আমার হতাশাবাদী মনোভাবের দ্বিতীয় কারণ ছিল আমি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকারী আমার এক কর্নেল আত্মীয়ের মাধ্যমে খবর পেয়েছিলাম যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রচুর সৈন্য ও যুদ্ধ সরঞ্জাম আসছে এবং সারা দেশে তাদেরকে যেভাবে মোতায়েন করা হচ্ছে, তা যুদ্ধ-প্রস্তুতির মতোই। তবে এটা অবশ্য তেমন গোপন কোনো বিষয় ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এটা জানতেন। পশ্চিমের এই প্রস্তুতির পেছনে শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে সমঝোতার চেষ্টা রয়েছে বলে আমি শুনেছি। ৬ দফা কর্মসূচির ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান যাতে অবস্থান নমনীয় করে, সে জন্য চাপ সৃষ্টিই এর উদ্দেশ্য। তবে এ ব্যাপারে ভিন্নমতটি হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা অসহযোগ আন্দোলনের সময় ‘জনগণের শক্তি’র বিষয়টি লক্ষ করে প্রতিরোধের চেষ্টা থেকে পিছিয়ে এসেছে। আর সৈন্য সমাবেশের কারণটি একটি যুদ্ধ শুরু করার জন্য ছিল না। এটা ছিল যদি গণআন্দোলন জঙ্গি রূপ ধারণ করে এবং আইন অমান্য আন্দোলনে পরিণত হয়, তবে বেসামরিক অবাঙালি লোকজনকে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাকে রক্ষা করতে। তবে আমার কাছে আগের মতটিই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে।

আমার নৈরাজ্যের তৃতীয় কারণ ছিল জি ডব্লিউ চৌধুরীর কাছ থেকে পাওয়া হুঁশিয়ারি বার্তা। এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহকর্মী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জি ডব্লিউ চৌধুরী তখন ইয়াহিয়া মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সেনাবাহিনীর কাছে তিনি এতই গ্রহণযোগ্য ছিলেন যে ইয়াহিয়ার বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদ হিসেবে বিবেচিত ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল’-এর সদস্যও ছিলেন। আদর্শগত ও রাজনৈতিক বিভেদের কারণে সামরিক শাসনের বছরগুলোতে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নির্বাচনের পরপরই এ সময় ইসলামাবাদ সফরে গেলে তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাত্ করার আগ্রহ প্রকাশ করায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। তার মতে ৬ দফা কর্মসূচির ক্ষেত্রে কোনো আপস না করার যে চ্যালেঞ্জ শেখ মুজিব দিয়েছেন তা মোকাবিলার কৌশল ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল নিয়েছে। নির্বাচনে ব্যাপক বিজয়ের মধ্য দিয়ে ৬ দফা কর্মসূচির ব্যাপারে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে গেছেন বলে শেখ মুজিব যে ঘোষণা দিয়েছেন, সে ব্যাপারে সেনাবাহিনী সচেতন ছিল। অন্যদিকে সেনাবাহিনী সব সময়ই বিশ্বাস করত এবং ধরেই নিয়েছিল যে অন্যসব নির্বাচনী ইশতেহারের মতো ৬ দফাও অনেক নমনীয় করা যাবে। তাদের প্রত্যাশা ছিল যে শেখ মুজিব তার দাবির ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য নমনীয়তা দেখবেন। আর শেখ মুজিব যদি তার নির্বাচন-পরবর্তী বক্তব্য অনুযায়ী ৬ দফা দাবি থেকে সরতে রাজি না হন, তবে সেনাবাহিনী তাকে দাবি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করবে। চৌধুরী আমাকে এটা নিশ্চিত করেছেন যে এটা কোনো ফাঁকা হুমকি নয়। চৌধুরী শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি জানতেন এবং ভেবেছেন যে আমার উচিত এই সতর্কবাণীর ব্যাপারে সজাগ হওয়া।

চৌধুরীর কাছ থেকে আমি যে পরামর্শ পেয়েছিলাম, সে ব্যাপারে আরো নিশ্চিত হলাম পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর এডমিরাল আহসানের বক্তব্যে। লাহোর থেকে ঢাকায় আসার সময় প্লেনে তার সঙ্গে আমার দেখা। আমি নিশ্চিত যে শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি সমের্ক তিনি অবহিত। তিনি যা বলতে চাইলেন তা খুবই সহজ; শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতার পরামর্শ দেওয়া উচিত এবং তাকে আরো নমনীয় হতে হবে। শেখ মুজিব যদি পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব ছাড়া অন্য প্রদেশগুলোর রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে তবে তার ফল ভালো হবে না। শেখ মুজিবের দেওয়া বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি এ কথা বলেছেন। শেখ মুজিব তার বক্তব্যে পশ্চিম পাকিস্তানের মাইনরিটি প্রদেশগুলোর কাছ থেকে সম্ভাব্য সমর্থন আদায়ের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব এমন ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন যে যখন পার্লামেন্ট বসবে তখন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের মাইনরটি প্রদেশগুলোর সদস্যদের এটা বোঝাতে সক্ষম হবেন যে ৬ দফা বাস্তবায়ন হলে সবগুলো প্রদেশই লাভবান হবে। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন সূত্রে এই তথ্য শেখ মুজিবের কাছে পৌঁছেছে। তিনি সম্ভবত এ ধরনের হুমকি ও পাল্টা হুমকিকে যেকোনো দরকষাকষির ক্ষেত্রে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন।

আমার কাছে মনে হয়েছে, শেখ মুজিব এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে যদি কোনো সামরিক অভিযান হয়ও তবে তা হবে অতীতের মতোই সীমিত। যা-ই হোক, পিছিয়ে আসা আর হয়নি। জাতীয়তাবাদের যে শক্তি শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে পড়েছে তাকে আর পেছনে ফেরানো যায় না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সে ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন। এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, যেকোনো ধরনের ব্যাপক সামরিক অভিযান দেশটিকে ভেঙে ফেলবে। এই অবস্থায় সামরিক বাহিনী বিচার-বিবেচনা করে ৬ দফা কর্মসূচিকে গ্রহণ করতে পারে। দেশটিকে পুরোপুরি বিভক্ত করার চেয়ে একটি কনফেডারেশনের ধারণা তারা মেনে নিতে পারে।

মার্চ ’৭১-এ যে সমঝোতার চেষ্টা চলছিল সে ব্যাপারে আমি এই নৈরাশ্য ও আশার দোলাচলে দুলছিলাম। আর যা-ই হোক একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতার আশা করা তো আর অবাস্তব কিছু ছিল না। অনেক ‘অপ্রত্যাশিত’ কিছুই ইতিহাসে সম্ভব হয়েছে। তবে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে পশ্চিমাপক্ষের সমঝোতা আলোচনা ও শেষ সময়ের ‘মধুর যৌক্তিক আচরণ’-এর বিষয়টি আসলে ছিল সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়ার কৌশল মাত্র। শেষ পর্যন্ত যে ৬ দফা কর্মসূচিতে পশ্চিমাদের ভোগ করা সুযোগ-সুবিধার অবসানের কথা বলা হয়েছে তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। একটি রাষ্ট্র রাখতে গিয়ে যদি পশ্চিমের যথাযথ অর্থনৈতিক লাভ না হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো-পশ্চিম পাকিস্তানের আমলাতন্ত্রে এমন চিন্তা-ভাবনার গুটিকয়েক লোকও ছিলেন। পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টি ইতিমধ্যেই অনেক কমে এসেছিল; ষাটের দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টি ছিল উল্লেখযোগ্য। পূর্ব পাকিস্তানের দাবি যদি মানা হয় তবে দেশকে অখণ্ড রাখার জন্য পশ্চিমকে অনেক মূল্যই দিতে হবে। তবে এটা পশ্চিমের মূলধারার সামরিক, রাজনৈতিক ও বেসামরিক নেতৃত্বের ভাবনা ছিল না। এই ইস্যুতে যদি পশ্চিমে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হতো তবে আমি নিশ্চিত যে তারা পূর্ব ও পশ্চিম একত্রে রাখার জন্য এই অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ প্রত্যাখ্যান করত। তারা শুধু পাকিস্তানকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক ও কৌশলগত লাভকেই বিবেচনায় নিত, বিশেষ করে চিরশত্রু ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে। সমঙ্রতি পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত হামদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইয়াহিয়া ও তার সামরিক ও বেসামরিক পরামর্শদাতারা ৬ দফা কর্মসূচি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে দেখেননি। এটা সমঙ্ূর্ণ ভুল ধারণা।

আইয়ুবের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ৬ দফা কর্মসূচি যাচাই-বাছাই করে দেখেছেন এবং এটা তাদের কাছে গভীর উদ্বেগের বিষয় বলেই বিবেচিত হয়েছে। এমনকি ১৯৬০ সালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে আমরা যে মেমোরেন্ডাম দিয়েছিলাম, সেখানেও ৬ দফার মূল বিষয়গুলো প্রতিফলিত হয়েছিল। এটা অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে এবং এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল কঠোরভাবে নেতিবাচক। ইয়াহিয়া ও তার সামরিক সরকারের জন্যও কাজ করেছেন একই অর্থনৈতিক উদ্যোক্তারা। বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সেনাবাহিনীর অনেকেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে শেষ পর্যন্ত ৬ দফা পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা যাবে। ‘নিপীড়িত জাতি’কে (আইয়ুব খান তার বই ফ্রেন্ডস অ্যান্ড নট এ মাস্টারস-এ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে নিপীড়িত জাতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন) মোকাবিলায় যে সামরিক বিচার-বিবেচনা, সে অনুযায়ী তারা ভেবেছিলেন যে কৌশলগতভাবে শক্তি প্রয়োগ করা গেলে এটা খুব কঠিন কাজ হবে না। তারা বুঝতে পারেননি যে এর ফলে রাজনৈতিকভাবে ক্ষুব্ধ জনগণের সঙ্গে সামরিক সংঘাত অনিবার্য। এমনকি তারা ভেবেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ব্যাপকসংখ্যক উদ্বাস্তু দেশ ত্যাগ করলেও ভারতের হস্তক্ষেপ এড়ানো যাবে।

৬ দফা কর্মসূচির ব্যাপারে শেখ মুজিব কেন আপস করেননি এই প্রশ্নের সাধারণ উত্তর হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য আকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থ রক্ষা করে পাকিস্তানকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখার আর কোনো উপায় ছিল না। আসলে ’৭১ সালেই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তান একজন নেতার পেছনে কিছু সঠিকভাবে উপস্থাপিত দাবির সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। আপস করে পাকিস্তানের সঙ্গে আরো দীর্ঘ সময় থাকার ব্যাপারটি কোনো ফল বয়ে আনত না, বরং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে মোক্ষম সময়টি হরিয়ে যেত, দেশব্যাপী জনগণের মধ্যে যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল তা হারিয়ে যেত। যেকোনো ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে একটি আপস আরো অনেক আপসের দিকে নিয়ে যেত। বিভিন্ন কারণের সমন্বয়ে ও একজন অনন্য নেতার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বে যে অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠেছিল পশ্চিমারা তা ভেঙে ফেলতে পারত। পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনের ভবিষ্যত্ এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়ত।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত