বিজ্ঞাপন
default-image

গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ-এর উপসংহারে আমি বলেছিলাম: ‘বাঙালি নাকি কোনো দিন স্বাধীন ছিল না! যে অর্থে আমরা “স্বাধীন” বা “স্বাধীনতা”র কথা ব্যবহার করি, তা দু’শ বছর আগে সে অর্থে ব্যবহূত হতো না। এখনো কথাটা খুব পরিষ্কার নয়। অর্থনৈতিক অর্থে ‘স্বাধীন’ শব্দটা আন্তর্জাতিক পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে কখনো ভাসছে, আবার কখনো ডুবছে। এই অর্থে পৃথিবীতে কয়টি স্বাধীন রাষ্ট্র আছে তা আমরা হাতের আঙুলে গুনতে পারব। ব্যাপক অর্থে সেই দেশকে প্রকৃত স্বাধীন বলা যেতে পারে, যে দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনে স্বাধীনতার আশীর্বাদ সহজে পরিলক্ষিত হয়। এই অর্থে স্বাধীন হতে আমাদের বহুযুগ অপেক্ষা করতে হবে। সাধারণ অর্থে “স্বাধীন” মানে রাজনৈতিক স্বাধীনতাই বোঝায়। বাংলার বাংলা যা অতীতে সমতট ও বঙ্গ বলে পরিচিত ছিলো তা অন্যান্য অঞ্চল থেকে সবচেয়ে কম পরাধীন ছিলো। রাঢ় ও বরেন্দ্রের ভাগ্য তেমন সুপ্রসন্ন ছিলো না, ওগুলোর ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেছে।

‘একটা দেশ স্বাধীন ছিলো কি না, তা নির্ণয় করতে হয়তো এটা জানা প্রয়োজন, যাঁরা দেশে রাজত্ব করতেন তাঁরা দেশের ছেলে ছিলেন কিনা, বা দেশের রাজা দেশের ছেলে না হলেও তিনি সেই দেশে বাস করতেন কিনা, রাজ্যে যা আয়-আমদানি হতো তা দেশে থাকত কিনা, বা দেশের মুখ্য কর্মগুলো দেশে, না বিদেশে কোথাও নিয়ন্ত্রিত হতো। এত কথা বলার দরকার এই জন্যে যে, ইতিহাসে আমরা দেখছি বিদেশ থেকে রাজা এনেও কোনো কোনো দেশ নিজেদেরকে পরাধীন ভাবেনি। ইংল্যান্ডে রোমান, ডেন, নর্মান-ফ্রেঞ্চ, ডাচ ও জার্মান রাজারা রাজত্ব করেছেন। সেই ইতিহাস আলোচনা করে ইংরেজরা মাতম করে না যে তারা স্বাধীন ছিল না।’

প্রথম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তাঁর ভাষণে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি জোট বহির্ভূত ও সক্রিয় নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে রচিত। বৃহত্ শক্তির আন্তর্জাতিক সংঘাতের বাইরে আমরা শান্তিকামী। আমরা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতিতে বিশ্বাসী এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব সৃষ্টিতে আগ্রহী। দেশ গড়ার কাজে কেহ আমাদের সাহায্য করতে চাইলে তা আমরা গ্রহণ করব। কিন্তু সে সাহায্য হতে হবে নিষ্কণ্টক ও শর্তহীন। আমরা জাতীয় সার্বভৌমত্বে ওসব জাতির সমমর্যাদার নীতিতে আস্থাশীল। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেহ হস্তক্ষেপ করবেন না—এটাই আমাদের কামনা।’

তিন বছরের মাঝে বাংলাদেশ যোগ দিয়েছিল কমনওয়েলথে, লাভ করেছিল জাতিসংঘের সদস্যপদ, হয়েছিল ইসলামিক জোট সম্মেলনে সাদরে আমন্ত্রিত, যোগ দিয়েছিল জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রমণ্ডলীর দলে। তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধিদের মাঝে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বোমেদিয়ান, সেনেগালের প্রেসিডেন্ট লিওপোল্ড সেনগর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। জাপান থেকে এসেছিল ৪৫ সদস্যের সুবৃহত্ একটি অর্থনৈতিক প্রতিনিধি দল। শেখ মুজিব এবং তাঁর নিযুক্ত বিশেষ প্রতিনিধিরা গিয়েছিলেন বেশ কটি দ্বিপক্ষীয় সফরে। বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত দেশ পাকিস্তান ভেঙে বেরিয়ে আসা, যুদ্ধ-উত্তর পুনর্গঠনে নাভিশ্বাস, নবগঠিত দরিদ্র একটি রাষ্ট্রের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই প্রতিষ্ঠা লাভ শেখ মুজিবের সফল পররাষ্ট্রনীতিরই পরিচায়ক।

মাত্র তিন বছরে ১৯৭৩ সালের আগস্টে কানাডার অটোয়ার কমনওয়েলথ সম্মেলন, সেই বছরেরই সেপ্টেম্বরে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন, ১৯৭৪-এর ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলন, সেই বছরের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ আর ১৯৭৫-এর মে মাসে জ্যামাইকার কিংসটনে কমনওয়েলথ সম্মেলনে শেখ মুজিব রেখেছিলেন তাঁর উপস্থিতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর।

১৯৭২ সালে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়াকুবু গওন আমাদের কমনওয়েলথের সদস্যপদ লাভের বিরোধী ছিলেন। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভকে বায়াফ্রার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণার উত্স হতে পারে বলে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলেন। জেনারেল ইয়াকুবু গওন শেখ মুজিবকে একটি অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা, বলুন তো, অবিভক্ত পাকিস্তান ছিল একটি শক্তিশালী দেশ। কেন আপনি সেই দেশটিকে ভেঙে দিতে গেলেন?’

হো হো করে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে নীরবতা ভাঙলেন শেখ মুজিব। ওই হাসির ফাঁকেই উত্তরটি ঠিক করে নেন। তিনি তর্জনী সংকেতে গম্ভীরভাবে বললেন, ‘শুনুন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি। আপনার কথাই হয়তো ঠিক। অবিভক্ত পাকিস্তান হয়তো শক্তিশালী ছিল। তার চেয়েও শক্তিশালী হয়তো হতো অবিভক্ত ভারত। কিন্তু সেসবের চেয়ে শক্তিশালী হতো সংঘবদ্ধ এশিয়া, আর মহাশক্তিশালী হতো একজোট এই বিশ্বটি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সবকিছু চাইলেই কি পাওয়া যায়?’

কথাটি বলেই তিনি তাঁর গলার সাদা চাদরটি হাতে নিয়ে তুলে দিলেন প্রেসিডেন্ট গওনের হাতে। তিনি বললেন, ‘এই নিন, বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে আমার এই ক্ষুদ্র উপহার।’

উপস্থিত সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে তিনি হেসে বললেন, ‘মহোদয়েরা, এটা ছাপবেন না যেন।’ নাইজেরিয়া তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।

তারপর শেখ মুজিব জোর আশা প্রকাশ করলেন যে কমনওয়েলথের সরকারপ্রধানগণ, পাকিস্তানিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং দুই দেশের মাঝে সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা বিষয়ে তাদের চিন্তা সরকারিভাবে ব্যক্ত করবেন। জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী মাইকেল ম্যানলি বললেন যে তাঁর মতে যুগ্ম ইশতেহারে বাংলাদেশের বক্তব্যটি ব্যক্ত হওয়া উচিত এবং কী ব্যক্ত হবে তার একটি খসড়া যেন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল প্রণয়ন করে। স্বাগতিক দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাইকেল ম্যানলি ছিলেন সেই সম্মেলনের সভাপতি। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই হ্যারল্ড উইলসন বললেন, বাংলাদেশের দাবি ব্রিটেন সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করে। তাঁর ভাষায়, ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যে দুই জাতিতে পরিণত একটি রাষ্ট্রের মাঝে সম্পত্তির যথাযথ বাটোয়ারা হয়নি।

তানজানিয়ার জুলিয়াস নিয়েরেরে অবশ্য প্রশ্ন করলেন, পাকিস্তান কমনওয়েলথ ক্লাবের সদস্য নয় এবং তাকে জড়িয়ে কোনো প্রস্তাব পাস করা কি ঠিক হবে? শেখ মুজিব তাঁর কালো চশমাটা অপসারণ করে স্থিরদৃষ্টিতে নিয়েরেরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ জুলিয়াস। কমনওয়েলথ একটি ক্লাব। কিন্তু আমি সেই ক্লাবেরই একজন সদস্য। অন্য সদস্যরা যদি সামান্য একটি প্রস্তাব পাস করে আমাকে সাহায্য না করেন তা হলে এই ক্লাবের সদস্য হওয়ার আমার কিই বা ছিল প্রয়োজন? একটি দরিদ্র দেশের রাষ্ট্রপ্রধান আমি। কেন তবে আমি অর্ধেক পৃথিবী পেরিয়ে এসেছি এই সম্মেলনে?’

হেসে জুলিয়াস নিয়েরেরে বলেন, ‘ঠিক আছে মুজিব। তুমি যা চাও তা-ই হবে।’

৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেন, ‘বিশ্ব শোষক আর শোষিত—এই দুভাগে বিভক্ত। শোষিতকে বাঁচাতে হবে।’ কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো শেখ মুজিবকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘মুজিব, শোষকের বিরুদ্ধে শোষিত বিশ্বের এই বাঁচার সংগ্রাম আমারও সংগ্রাম।’ এক পর্যায়ে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘সিআইএ সম্পর্কে সাবধান। সুযোগ পেলেই কিন্তু তারা আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘দেশের আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, বৈজ্ঞানিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ প্রমুখ পেশার লোককে সরকারি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করুন। এরা ভুলের পরে ভুল করে সঠিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, কিন্তু এরা কোনো ষড়যন্ত্র করবে না। আপনার মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের আরও কাজের দায়িত্ব দিন এবং সম্পূর্ণভাবে ওদের বিশ্বাস করুন। অন্যথায় আপনি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন।’

সম্মেলনে সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সল, কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো, তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নিয়েরেরে, কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরোদম সিহানুক ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে শেখ মুজিবের মতবিনিময় হয়।

একান্ত সাক্ষাতে সৌদি আরবের তত্কালীন বাদশা ফয়সল শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, ‘আমি শুনেছি যে, আসলে বাংলাদেশ আমাদের কাছ থেকে কিছু সাহায্যের প্রত্যাশী। অবশ্য সাহায্য দেওয়ার জন্য আমাদের কিছু পূর্বশর্ত আছে।’ এই কথার উত্তরে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমার তো মনে হয় না, বাংলাদেশ মিসকিনের মতো আপনাদের কাছে কোনো সাহায্য চেয়েছে। বাংলাদেশের পরহেজগার মুসলমানেরা পবিত্র কাবা শরিফে নামাজ আদায়ের অধিকার চাচ্ছে। পবিত্র কাবা শরিফে দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের নামাজ আদায়ের হক রয়েছে। এ ব্যাপারে আবার শর্ত কেন? আমরা আপনাদের কাছ থেকে ভ্রাতৃসুলভ সমান ব্যবহার প্রত্যাশা করি। এই দুনিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। তাই আমি জানতে চাই, কেন সৌদি আরব আজও স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।’

বাদশাহ ফয়সল বলেছিলেন, ‘সৌদি আরবের স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করতে হবে।’

জবাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আপনার দেশের নামটাও তো ইসলামিক রিপাবলিক অব অ্যারাবিয়া নয়। আপনার দেশটির নাম মরহুম বাদশাহ ইবনে সৌদের নামে কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়া রাখা হয়েছে। কই, আমরা কেউই তো এ নামে আপত্তি করিনি।’

এর পরও বাদশা বললেন, ‘তা ছাড়া আমাদের অন্য একটি শর্ত আছে, আর তা হচ্ছে অবিলম্বে সমস্ত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর মুক্তি দিতে হবে।’

শেখ মুজিব সৌদি বাদশাহর এই কথাটিরও প্রতিবাদ করে বললেন, ‘এটা তো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার। এই দুটো দেশের মধ্যে এ ধরনের আরও অনেক সমস্যা অমীমাংসিত রয়েছে। যেমন ধরুন, বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ পাকিস্তানি নাগরিকের পাকিস্তানে ফেরত আনা এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া পাঁচ লক্ষাধিক বাঙালিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো। বাংলাদেশের প্রাপ্য অর্থসম্পদ পরিশোধ করা—এমন বেশ কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। এসব মীমাংসা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। শুধু বিনা শর্তে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে না। আর সৌদি আরবই বা এত উদ্গ্রীব কেন?’

তখন বাদশাহ বললেন, ‘শুধু এটুকু জেনে রাখুন, সৌদি আরব আর পাকিস্তান একই কথা। পাকিস্তান আমাদের সবচেয়ে অকৃত্রিম বন্ধু। যা হোক, আমাদের দুটো শর্তের বিষয় চিন্তা করে দেখবেন। একটা হচ্ছে, বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা আর একটা বিনা শর্তে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি। আশা করি, এরপর বাংলাদেশের জন্য সাহায্যের কোনো কমতি হবে না।’

সৌদি আরবের বাদশাহর মতো লিবিয়ার নেতা কর্নেল গাদ্দাফিও অনুরোধ করেছিলেন বাংলাদেশের নাম বদলে যেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র রাখা হয়। শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সকলেই ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তা ছাড়া সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের একটি ভিন্নধর্মী চিন্তা-চেতনা, মনমানসিকতা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-ষষ্ঠাংশ অমুসলিম। সর্বোপরি আল্লাহতায়ালা তো শুধু আল মুসলেমিন নন, তিনি তো রাব্বুল আলামিন, সবকিছুরই স্রষ্টা, মহান। সুতরাং আপনার প্রস্তাব কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন শেষ করে শেখ মুজিব দেশে প্রত্যাবর্তন করেন ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩। কিছুদিন পরেই পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক শেষে ঘোষণা করা হয়, উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের বিচার বাতিল করা হলো। এই ঘোষণার কিছুদিন পরেই আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের প্রথম একটি দল ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ শেখ মুজিবের বক্তব্য পাকিস্তানের বেতার সম্মেলন কক্ষ থেকে সরাসরি প্রচার করা হয়: ‘মানুষ এখন বস্তুগত দিক থেকে বৃহত্তর শক্তি অর্জন করেছে, যা সে আর কখনো পারেনি। সে পৃথিবীকে ধ্বংস করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। আমরা যুদ্ধের জন্য শক্তির অপব্যবহার করতে দেখেছি, জনগণকে নিপীড়ন করতে দেখেছি। আমরা তাদের ন্যায়সংগত অধিকার অস্বীকার করতে দেখেছি। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে তাদের ফেলে দিতেও দেখেছি। আর এসব অকথ্য যাতনার চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে আছেন আমাদের প্যালেস্টাইনি ভাইয়েরা। আর এ জন্যই অতীতের তুলনায় আজ এই শক্তিকে প্রজ্ঞার সঙ্গে কাজে লাগানোর প্রয়োজন বেশি।...এই সম্মেলন শুধু আরব ভাইদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন আমাদের ঐক্য সংহত করার জন্যই নয়, বরং জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সঙ্গে এবং সারা বিশ্বের শান্তি ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোর সঙ্গে আমাদের একাত্মতা ঘোষণার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ ও সকল প্রকার শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে একাত্মতার ওপর জোর দিতে হবে।...অন্যায়ভাবে দখলকৃত আরব ভূমি অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে জেরুজালেমের ওপর।...আল্লাহর কৃপায় আমরা এখন আমাদের সম্পদ ও শক্তি এমনভাবে সুসংহত করতে পারি, যাতে আমাদের সকলের জন্য শান্তি ও ন্যায়বিচার অর্জন করা যায়। এই সাফল্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের সকল যৌথ প্রচেষ্টা সফল করুন।’

শেখ মুজিব কোনো আরব রাষ্ট্রপ্রধানের অনুগ্রহভাজন হওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে বারবার দৌড়ে যাননি। শীর্ষস্থানীয় আরব দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানেরাই বরং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার জন্য বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। কোনো আরব রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর আমলে বাংলাদেশের কোনো অভ্যন্তরীণ ব্যাপার কিংবা দেশের নামের আগে বিশেষ কোনো শব্দ সংযোজনের প্রস্তাব করারও সাহস পাননি। আরবরা শেখ মুজিবের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও আস্থা প্রদর্শন করতেন। ভিক্ষা নয়, আরব সাহায্য আসা শুরু হয়। সে সময় আরব আমিরাত বাংলাদেশ ব্যাংকে ৬০ লাখ দিনার বা ৭৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা জমা রাখে।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ শেখ মুজিব সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পর শুধু দেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ল না, এরপর বাংলাদেশে এমন কোনো স্বাধীনচেতা নেতা তার মতো মাথা উঁচু করে সকলের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে সমানে সমানে হয়ে কথা বলতে পারলেন না।

বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামি নীতিমালা সংযোজনের পরে আমাদের রাষ্ট্রপতিকে সৌদি আরবের বাদশাহ খালেদ অভিনন্দন জানান।

২৫ আগস্ট ১৯৯০ জাতীয় সংসদে একদিনের বিশেষ অধিবেশনে সৌদি আরবের বাদশাহের অনুরোধে তাঁর প্রতিরক্ষার সহায়তার উদ্দেশ্যে প্রতীকী সৈন্যদল পাঠানোর জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এক প্রস্তাবে বলা হয়: ‘এই পদক্ষেপ ওই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে এবং ইসলামি উম্মাহর সার্বিক স্বার্থরক্ষায় বিশেষভাবে সহায়ক হবে।’ সেই পদক্ষেপের প্রতিবাদে ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯০ আট দল, পাঁচ দল ও জনমুক্তি পার্টির ডাকে সারা দেশে অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। ২০০৮ সালের ১০ মার্চের খবর সৌদি রাজকুমার এবং উপপ্রধানমন্ত্রী সুলতান বিন আব্দুল আজিজ প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদকে মার্সিডিজ বেন্জ ৩৫০ একটি মোটরগাড়ি উপহার পাঠিয়েছেন। আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীরা পরকালের জন্য কতটা কী করেন তা আল্লাহ জানেন, কিন্তু ইহকালে ভোটারদের কাছে ধর্মভীরুতার ভাবমূর্তি তৈরি করতে তারা প্রায়ই ওমরাহ করে থাকেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে সৌদি আরব ও সালাফিয়া আদর্শের প্রভাব রয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। সৌদি আরবের পর আমাদের দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। ৫ আগস্ট ১৯৯৮ পাঁচ বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্ট নিডস অ্যাসেসমেন্ট (হানা) প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে মানবিক সহায়তা ও প্রয়োজন নিরূপণে কর্মসূচি বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করে। ১০ আগস্ট ১৯৯৮ বাংলাবাজার পত্রিকায় এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় এ বিষয়ে একটা ঢাক গুড় গুড় ব্যাপার ছিল। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাঁরা হানা চুক্তির ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মতে, ‘এটা কোনো চুক্তি নয়। এটি মন্ত্রণালয়ের রুটিন ওয়ার্কের অংশ। নৈতিকতার দিক থেকে এটি অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। ঠিকই আছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভবিষ্যতে এভাবে হুট করে কোনো কিছু যেন করা না হয়।’

বিশ্বের প্রধান শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিহত করা কঠিন ব্যাপার। মাদক পাচারকারী একজন দণ্ডপ্রাপ্ত মার্কিন তরুণীকে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দেন। মালয়েশিয়ার মাহাথির অনুরূপ ব্যাপারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ রক্ষা করেননি। ইরাক কুয়েত আক্রমণ করলে আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পক্ষ সমর্থন করি। রাষ্ট্রপতি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সম্মতিতে আমাদের আকাশসীমা, বিমানবন্দর, বিমানঘাঁটি ও সমুদ্রবন্দর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। ১৮ অক্টোবর ২০০১ সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক সহকারী শফি সামি বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের আলোকে জাতিসংঘ সনদ ও নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হাইকোর্টে এ নিয়ে একটা রিট আবেদন করা হয়। আফগানিস্তানে মার্কিন ও ব্রিটিশ হামলার বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও বাম রাজনৈতিক দল অবস্থান নেয়। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনো মন্তব্য করেনি। নভেম্বর ২০০১ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে বিএনপি সমর্থন জানায়।

কোরিয়ার যুদ্ধের কল্যাণে পাটজাতদ্রব্য রপ্তানি করে পাকিস্তান তার দন্তোত্গমের কালে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বিরাট সুযোগ পায়। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ ওপেকের কারণে পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধির ফলে এক বিরাট সংকটে পড়ে। সাধারণ কাপড় কাচা সাবান থেকে টিনের দুগ্ধজাত খাদ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশকে নিয়ে দেশে-বিদেশে বিবিধ তত্ত্ব ও তথ্য নিয়ে গবেষণাযজ্ঞ চলছে, তা কখনো-সখনো আমাদের বিভ্রমের সৃষ্টি করে। পরিসংখ্যান, রেখাচিত্র ও নানা সারণির মধ্যে আমরা ধান্ধায় পড়ি। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০১ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল বারকাত বলেন, ‘গত তিন দশকে বাংলাদেশে সরকারিভাবে ঋণ-অনুদান হিসেবে আনুমানিক এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক সাহায্য এসেছে। এর ৭৫ ভাগ নানাভাবে লুট হয়েছে। সেই ৭৫ ভাগের ২৫ ভাগ বিদেশি কনসালট্যান্সির নামে, ৩০ ভাগ আমলা, রাজনীতিবিদ কমিশন এজেন্ট, স্থানীয় পরামর্শক ও ঠিকাদার এবং ২০ ভাগ গ্রাম ও শহরের উচ্চবিত্তদের সাহায্যে ব্যয়িত হয়েছে।’

১৩ আগস্ট ২০০৩ বিআইআইএসের রজতজয়ন্তী বক্তৃতায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জোসেফ ই স্টিগলিজ বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে অথচ এরাই ঝুঁকি মোকাবিলায় সবচেয়ে কম প্রস্তুত। কারণ, তাদের কথা শোনার কেউ নেই। বরং আইএমএফ এদের ঝুঁকিকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে ভুল পরামর্শ চাপিয়ে দিয়ে সংকটকে তীব্র করে তোলে। বিশ্বায়ন অর্থনীতিকে গতিশীল করে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে, তবে তা আইএমএফের পরামর্শ বা নীতিমালার মধ্যে নয়।’ যেসব দেশ নিজের মানুষ ও মাটি এবং জলবায়ুকে হিসেবের মধ্যে নিয়ে নিজেরা তাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করে, তাদের উন্নয়নের হার তুলনামূলকভাবে ভালো। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে হারে আগে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটিয়েছিল, দাতাগোষ্ঠীদের তদারকিতে সে হার অনেক নিচে নেমে যায়।

বাংলাদেশের এ অর্থনৈতিক উন্নতির কারণ সম্পর্কে নানা ধরনের তত্ত্ব পেশ করা হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হয়তো এই যে বাংলাদেশের মানুষ নতুনকে খুব সহজভাবে গ্রহণ করেছে। সে নতুন বীজ, সেচ বা ভিন্ন উত্পাদন পদ্ধতিই হোক বা কর্মক্ষেত্রে অধিকতর নারীর অংশগ্রহণই হোক। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিকের যে উদয়াস্ত পরিশ্রম করার ক্ষমতা, তারও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অধিকতর সম্পৃক্ততা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে ঋণগ্রহীতা ও বিনিয়োগকারী হিসেবে নারীদের অবস্থান এবং তৈরি পোশাকশিল্পে নারীশ্রমিকদের অধিকতর অংশগ্রহণ দেশের অর্থনৈতিক আবহাওয়া বদলে দিয়েছে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানি লন্ডারিং বা টাকা ধোলাইবিরোধী আইন দেশে ও বিদেশে কার্যকর হওয়ার পর প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে হুন্ডি-প্রবণতা কমেছে।

বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০০০-২০০১ সালে দেখা যায়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য অনেক কমে গেছে। পাকিস্তানের তথাকথিত উন্নয়নের দশকে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল, ৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ তা সম্পূর্ণ দূর করতে সক্ষম হয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সত্তরের দশকে তিন শতাংশ, আশির দশকে চার শতাংশ এবং নব্বইয়ের দশকে পাঁচ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মোট কথা, প্রায় আড়াই দশক ধরে জাতীয় আয় বছরে শতকরা চার থেকে পাঁচ ভাগ হারে বেড়েছে। একই সঙ্গে দেশে এক শতাংশ হারে দারিদ্র্যবিমোচন হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যবিমোচনে দেশের এই যে অগ্রগতি, এটা সম্ভব হয়েছে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে সংস্কারের বদৌলতে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার বেড়েছে শতকরা দেড় ভাগ থেকে সাড়ে তিন ভাগ। তবে এ প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনার তুলনায় যথেষ্ট নয় এবং দেশের প্রত্যাশার সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ নয়। অর্জনযোগ্য সর্বাধিক উন্নয়নের হারের অনেক নিচে আমাদের প্রকৃত উন্নয়নের হার। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের স্বল্পতা, রাজস্ব আদায়ের স্বল্পতা এবং দুর্বল অবকাঠামো হচ্ছে অর্থনৈতিক অসাফল্যের মূল কারণ। তৈরি পোশাকনির্ভর রপ্তানি আয় প্রধানত সংরক্ষিত বাজারে বিক্রি হয়। দেশে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য ও পরিবেশ দূষণ এখনো ব্যাপক।

২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমা অর্ধেকে নামিয়ে ২৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ করতে হলে কৃষি খাতে চার শতাংশ এবং অকৃষি খাতে সাত শতাংশ হারে উত্পাদন বাড়াতে হবে। ২০০৭ সালে কৃষি উত্পাদনের হার ছিল তিন দশমিক ১৮ শতাংশ। ৮০ শতাংশ দরিদ্রের মধ্যে ৫৩ শতাংশই গ্রামের মানুষ, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কৃষি ও গ্রাম—এই দুই খাতে অবহেলা ও কম বিনিয়োগ করা হচ্ছে।

২০০৭ সালের আগস্টে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দারিদ্র্যবিমোচনে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের স্থান ভারতের পরে। ১৯৯১ সালে যেখানে ৫৭ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল এবং তা ২০০০ সালে ৪৯ শতাংশে নেমে আসে এবং সে হার ২০০০-২০০৫ সালে আরও কমে ৪০ শতাংশে স্থির হয়ে আছে।

গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক সচেতনতা বেড়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রগতি হচ্ছে। দেশে সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিনির্ভরতা অতি সামান্য হলেও হ্রাস পেয়েছে। গ্রামীণ পরিবারের উপার্জনকারীদের ৫২ শতাংশ আজ অকৃষি কর্মোদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ১৯৮৭-৮৮ সালে সে হার ছিল ৩৭ শতাংশ। কৃষিভিত্তিক বৃত্তি ১৬ শতাংশ কমেছে। কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা অর্ধেক কমেছে। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। যান্ত্রিক চাষ, যান্ত্রিক সেচ, রাস্তাঘাট, শিক্ষার প্রসার, সামাজিক ও পেশাগত চলমানতা নতুন চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করে এক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।

১৯৭৩-৭৪ সালে যখন প্রথম দারিদ্র্যের ওপর জরিপ করা হয়, তখন দেশের শতকরা ৭০ জন মানুষকে দুবেলা পেট পুরে খেতে প্রাণান্ত চেষ্টা করতে হতো। ১৯৯১-৯২ সালে এমন দুস্থ মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে শতকরা ৫৮ দশমিক আট এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে আরও হ্রাস পেয়ে শতকরা ৪৯ দশমিক আটে দাঁড়ায়। জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্পের সর্বশেষ জরিপে আমাদের দেশের দারিদ্র্যরেখা ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে।

১৯৯১-৯২ সালে যেখানে সর্বাধিক পাঁচ শতাংশ ধনী পরিবারের জাতীয় আয়ের অংশ ছিল ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২০০০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৬৬ শতাংশে। ধন বণ্টনের অসমতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলে এক শতাংশ লোক ২৭ ভাগ সম্পদের মালিক ছিল। ২০০৭ সালে এক শতাংশ লোক ৪০ ভাগ সম্পদের মালিক। ধনী ও হতদরিদ্রের মধ্যে নবজাত শিশু মৃত্যুর হারে বৈষম্য ৬৮ শতাংশ, পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু মৃত্যুর হারে এ বৈষম্য ৯৩ শতাংশ, প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশের ক্ষেত্রে এর হার ৪৬ শতাংশ ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ১৯৬ শতাংশ, শিশু পুষ্টিতে ধনী ও হতদরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য ১০৪ শতাংশ এবং মাতৃপুষ্টির ক্ষেত্রে এ বৈষম্য ৮৯ শতাংশ। এ বৈষম্য দূর করতে না পারলে বাংলাদেশে অন্তত চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষ গরিবই থেকে যাবে। বৈষম্যের কারণে ষড়রিপুতাড়িত সাধারণ ছাপোষা মানুষ যেকোনো সময় ক্ষোভে ফেটে পড়তে পারে। দুর্নীতি ও বৈষম্য যুগপত্ বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রবৃদ্ধির বদৌলতে উন্নয়নের গতি চুইয়ে চুইয়ে নিম্নবিত্তের দিকে যাবে বলে যে আশা করা হয়েছিল বাস্তবে তেমন দেখা যাচ্ছে না। আমাদের দারিদ্র্যের একটি বড় কারণ মূল্যস্ফীতি। কেননা মূল্যস্ফীতিই দারিদ্র্য বৃদ্ধির একটি বড় উত্স। এতে দরিদ্র লোকজন ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। দেশের সাধারণ মানুষের পোশাক-আশাক, কেনাবেচা ও হাবভাব দেখে মনে হয় দুস্থ মানুষের গায়ে একটু মাংস লেগেছে। সীমান্তবর্তী গ্রামাঞ্চলে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখা যায়, তা থেকে কেউ কেউ অনুমান করেন যে চোরাচালান এবং অবৈধ পাচার-ব্যবসার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে টাকাপয়সার বিনিময় বেড়েছে। গ্রামে টিনের বাড়ি এবং শহরে বহুতলবিশিষ্ট ইমারতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

খাদ্য-নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান চরম খারাপ অবস্থার খানিকটা ওপরে, কিন্তু গড় মানের নিচে। এ ছাড়া শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিঙ্গবৈষম্য দূর ও পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশ রয়েছে গড় মানের নিচে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাত ও শিক্ষায় লিঙ্গবৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান গড় মানের ওপরে। নারীর ক্ষমতায়ন এবং তথ্যবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ।

২০০৪ সালের তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে বাংলাদেশে আট ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। ভারত ও পাকিস্তানে এ সংখ্যা ১১। বাংলাদেশে সব প্রক্রিয়া শেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে লাগে ৩৫ দিন, ভারতে ৭১ দিন। ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় ব্যবসা-বাণিজ্য কম সময়ে শুরু করা গেলেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই এর জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে লাইসেন্স পেতে ১৮৫ দিন লাগে, আর সবচেয়ে বেশি সময় প্রয়োজন হয় ভারতে, ২৭০ দিন। আর এ জন্য বাংলাদেশে খরচ হয় মাথাপিছু আয়ের ২৯১ শতাংশ, ভারতে ৬৭৮ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ পাকিস্তানে এক হাজার ১৭০ শতাংশ। বাংলাদেশে শ্রম নিয়োগে কোনো অর্থ না লাগলেও কর্মচারী-কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করতে দিতে হয় ৪৭ সপ্তাহের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ।

ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করার একটি বড় উপাদান জমি। বাংলাদেশে জমি নিবন্ধনে প্রয়োজন হয় ৩৬৩ দিন এবং খরচ হয় মোট জমির মূল্যের ১১ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এটাই সর্বোচ্চ। পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করতেও বাংলাদেশে অনেক সময় লাগে। যেমন—আমদানি করতে বাংলাদেশে লাগে ৫৭ দিন, রপ্তানিতে ৩৬ দিন। আমদানি করতে ৩৮টি স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হয়, আর রপ্তানিতে ১৫টি।

বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বাণিজ্য উদারীকরণ করে আমাদের রপ্তানি বেড়েছে বলে যে দাবি করা হয়, তা কি সঠিক? তাদের পরামর্শ সঠিক হলে এত দিনে আমরা কৃষি থেকে বেরিয়ে এসে পুরোপুরি শিল্পনির্ভর হয়ে যেতাম। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ মেনে নিলে কৃষিক্ষেত্রে আমরা বড় বিপদে পড়তাম। ১৯৯৬-২০০১ সালে কৃষিক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়ায় আমরা যে সুফল পাই, তা ২০০১-০৬ সালে আমরা কৃষিকে অবহেলার জন্য ধরে রাখতে পারিনি।

দেশে ১৯৯২ সালে জন্মের হার ছিল ছয় দশমিক চার শতাংশ। ১৯৯৯-২০০০ সালে তা কমে তিন দশমিক শূন্য তিন শতাংশে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল তিন শতাংশ। ২০০১ সালে তা কমে এক দশমিক ৪৮ শতাংশে দাঁড়ায়। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশের জনমত সংঘবদ্ধ হয়েছে। সালিসের মাধ্যমে নারী নির্যাতন আর তেমন সহজ নয়।

২০০৭-০৮ সালের ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্থান ১৪০তম। গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩ বছর এক মাসে। বয়স্ক সাক্ষরতার হার ৪৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং স্কুল-কলেজে ভর্তির হার ৫৬ শতাংশ।

পাট ছিল পাকিস্তানের দুই অর্থনীতির পক্ষে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অস্ত্র। স্বাধীনতার পর উত্পাদন হতো প্রায় এক কোটি বেল পাট; এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ থেকে ৫০ লাখ বেল। যে দেশে বিশ্বের ৭০ শতাংশ পাট উত্পাদন হতো, যে দেশের আবহাওয়া পাট চাষের অনুকূল এবং চাষিরাও বিশেষভাবে দক্ষ, সেখানে পাটশিল্পের করুণ দশার জন্য কতখানি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত দায়ী তা নির্ণয় করা কঠিন।

১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, মন্ত্রী ও রাজনীতিকদের বিরদ্ধে যত অভিযোগ দায়ের করা হয়, তার মধ্যে তিনটি মামলা চূড়ান্তভাবে শেষ হয় এবং দোষী ব্যক্তি শাস্তি ভোগ করেন। প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের দলে টানার জন্য তাঁর জামিন দেওয়া-নেওয়া নিয়ে যে প্রহসনের সৃষ্টি হয়, তাতে আদালতের সুনাম ক্ষুণ্নই হয়। প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের মামলার শুনানি বিলম্বিত হয় সরকারের আইন পরামর্শকদের অনাপত্তিতেই।

১৯৪৭ সালের পর আমরা নানা ধরনের খনিজদ্রব্য আবিষ্কার এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও সাশ্রয়ের স্বপ্ন দেখে এসেছি। সে ক্ষেত্রে একটি পূরণ হয়েছে। ১৯৬২ সালের ২৩ আগস্ট তিতাস গ্যাস আবিষ্কৃত হয়। ১৯৬৮ সালের ১ এপ্রিল সেই গ্যাস তোলা শুরু হয়। বিদেশি স্বার্থান্বেষী পরামর্শকেরা বলেন, বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে এবং যেহেতু আমাদের যথেষ্ট প্রকৌশল জ্ঞান নেই, গ্যাস উত্তোলনের জন্য বিদেশে গ্যাস রপ্তানি করা উচিত। দেশি বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের ২০টি গ্যাসক্ষেত্রে মোট উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুদ ছিল ১৩ দশমিক ৭৯১ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। ব্যবহার করার মতো উত্তোলনযোগ্য গ্যাস রয়েছে নয় দশমিক ৮৩০ টিএসএফ। আগামী ৫০ বছরের জন্য ৪২ থেকে ৫৪ টিএসএফ গ্যাস মজুদ থাকা দরকার। নির্বাচিত সরকারের কেউ না কেউ বিজ্ঞের মতো বলেছেন, মাটির নিচে ধন রেখে লাভ কী? বেগুনগাছ কেটে মুলা চাষের পরামর্শ দেন। প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার সূচক এক সেমিনারে ২০০১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কানাডার অধ্যাপক ড. জন রিচার্ডস বলেন, ‘গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুত্ উত্পাদন বাংলাদেশের জন্য সর্বোত্তম পন্থা।’

২০০৪ সালের আগস্ট মাসে অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিজ বলেন, সরকার যদি এখন রপ্তানি করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে ১৫ থেকে ২০ বছর পর আবার গ্যাস আমদানি করতে হবে এবং রপ্তানি ও আমদানি কাজে দুবার গ্যাস সঞ্চালনে অযথা ব্যয়ভার বহন করতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষের অপ্রতিরোধ্য বিরোধিতায় এখন পর্যন্ত গ্যাস রপ্তানির কথা সাহস করে কেউ বলছে না। অশুভ তত্পরতার বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাবে, কিন্তু দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিতে কোনো ষড়যন্ত্র বরদাশত করবে না।

যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত সারা ও ভৈরব ব্রিজসহ সেতু ও কালভার্ট মেরামত করে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা হয়। গত কয়েক দশকে দেশ বহু রাস্তা ও ব্রিজ তৈরি হয়েছে। রাস্তায় গাড়ি চালাতে জ্বালানি তেলের যে ব্যয় হয়, তার সঙ্গে দাতা রাষ্ট্রগুলোর লাভজনক সম্পর্ক রয়েছে। নৌপথের উন্নয়নের জন্য সরকার বা দাতাগোষ্ঠী তেমন উত্সাহ দেখায়নি। ২০০৭ সালের মার্চের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর ১৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ বিলুপ্ত হয়ে এখন রয়েছে মাত্র ছয় হাজার কিলোমিটার। ২৩০ নদীর মধ্যে ১৭৫টির অবস্থা শোচনীয়।

রাজধানী এখন নানা ধরনের দুর্নীতির আখড়া। হাজারখানেক বাস চলে অবৈধভাবে। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত এক সূত্র অনুযায়ী ঢাকা মহানগরে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ লাইসেন্সবিহীন রিকশা ছিল। বুড়িগঙ্গা বা তুরাগ নদীতীরে এবং পথের পাশে অবৈধ স্থাপনার ইয়ত্তা নেই।

আমাদের পরামর্শদাতা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান, ডিআইএফডি যৌথভাবে আমাদের জন্য রাষ্ট্র সহায়তা কৌশল (সিএএস) তৈরি এবং আমাদের অর্থমন্ত্রীকে দারিদ্র্যবিমোচন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) তৈরি করতে অনুরোধ করছে। বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা দরিদ্র দেশগুলোকে যে সুপারিশ-উপদেশ বর্ষণ করে, তার জন্য তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। ভুল উপদেশের জন্য তাদের কোনো হিসাবদিহিও করতে হয় না।

দেশে-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলেও সস্তা শ্রমে মুনাফার জন্য বিদেশিরা যে বিনিয়োগ করছে তাতে বিশেষ কোনো কারিগরি বিদ্যা হস্তান্তর হচ্ছে না। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি হলে দেশে উন্নতি হবে না, যদি কাঠামোগত প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই না হয়।

বন্যা, প্লাবন, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডোর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সামরিক শাসনের মতো রাজনৈতিক দুর্যোগ বা অপদার্থ নির্বাচিত সরকারের নৈরাজ্যের মতো দুর্ভোগ কাটিয়ে বাংলাদেশের মানুষ একাধিকবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এই হতদরিদ্র দুঃখী মানুষের মধ্যে এমন একটা গতিময়তা এবং প্রাণবন্ততা রয়েছে, যা এ দেশকে শুধু রক্ষা করছে না, কখনোবা তাদের মুখে হাসিও ফোটাচ্ছে। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডের একটি ইন্ডিপেনডেন্ট থিংকট্যাংক ‘ড্রিমস’ এক জরিপ করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ।

বাংলাদেশ যদি সমৃদ্ধি লাভ করতে চায় তবে সন্ত্রাসের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হবে, অন্যদের অবিচার ও নিপীড়ন থেকে যতদূর সম্ভব সমাজের প্রতিটি সদস্যকে রক্ষা করতে হবে এবং যথাযথ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যবসা ও বাণিজ্যে সহায়তা, চুক্তির দায়দায়িত্ব পালন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং লেনদেনের খরচ কমানোর জন্য দুর্নীতিকে ন্যূনতম স্তরে সীমিত করার লক্ষ্যে দেশে ফলপ্রদ ও যথার্থ আইন থাকতে হবে। আমি অন্যত্র বলেছি, ‘বাংলাদেশ যদি স্বাধীনসত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করতে চায়, যার পূর্বাভাস সংবিধানের প্রস্তাবনায় বিধৃত রয়েছে, তবে তাকে আরও সতর্ক হতে হবে এবং প্রয়োজনে বাজারকে নিয়মিত করতে, মুক্ত-বাণিজ্যের আতিশয্যকে নিবৃত্ত করে শ্রমিক ও ভোক্তার অধিকার এবং সকলের জন্য মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য কার্যকর আইন প্রণয়ন করতে হবে। কারণ, আমাদের জন্য কেবল অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের উদারীকরণ যথেষ্ট নয়, অসুবিধাগ্রস্ত এবং অনগ্রসর মানুষের জন্য আমাদেরকে অবশ্যই সামাজিক সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।’

বড় দুর্দিনের সময় শেখ মুজিবের স্বাধীনচেতা পররাষ্ট্রনীতির জন্য বাংলাদেশ তলাহীন ঝুড়ি হওয়া সত্ত্বেও ধীরে ধীরে প্রায় স্বনির্ভরতার পথে এগোয়। অভ্যুদয়কালে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা ছিল আজ তা অনেক কমেছে। প্রবাসীদের প্রেরিত টাকার সদ্ব্যবহার করতে পারলে পরনির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে আরও কমবে।

৩ ডিসেম্বর ২০০৭ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সুবর্ণ জয়ন্তীতে অর্থনীতিবিদরা বলেন, ‘বিদেশী সাহায্য অনেক কমেছে, মানসিক নির্ভরতা রয়ে গেছে।’

একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পরনির্ভরতা আপেক্ষিক ব্যাপার। যদি সেই পরনির্ভরতায় রাষ্ট্রটির উন্নয়ন ব্যাহত না হয়, স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ না হয় তবে আশঙ্কার কিছু নেই। দুর্ভাবনার কথা তখনই উঠবে যখন রাষ্ট্রটি ব্যর্থ, অকার্যকার বা ভঙ্গুর হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের সেই আশঙ্কা নাই। জয় বাংলা।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৮ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত