বিজ্ঞাপন

রাধানগর ছিল মুক্তিবাহিনীর ৫ নম্বর সেক্টরভুক্ত এলাকা। অক্টোবর পর্যন্ত এ এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে প্রথাগত আক্রমণ পরিচালনা সম্ভব হয়নি। এ সময় ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরে প্রথাগত আক্রমণ করার জন্য নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের ওপর দায়িত্ব পড়ে।

আমি ছিলাম জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলের ডেলটা কোম্পানির অধিনায়ক। আমাদের ব্যাটালিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর শাফায়াত জামিল। অক্টোবরের মাঝামাঝি ভারতের তেলঢালা থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ৫ নম্বর সেক্টরের সদরদপ্তরে সমবেত হই। পৌঁছেই আমরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ছাতকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ পরিচালনা করি। প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর তাত্ক্ষণিক নির্দেশে আমাদের এ আক্রমণ করতে হয়। কিন্তু কয়েকটি কারণে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এক. পথঘাট না চেনা, দুই. রেকি না করা, এবং তিন. দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার ক্লান্তি। এরপর ২৩-২৪ অক্টোবর আমরা গোয়াইনঘাটে প্রথাগত আক্রমণ করি। আমাদের পক্ষেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গোয়াইনঘাট দখলে আমরা ব্যর্থ হই। তবে এ কথা বলতেই হবে, অপারেশন দুটি করার মাধ্যমে আমরা পাকিস্তানিদের রণকৌশল ও প্রস্তুতি সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা পাই এবং আমাদের অভিজ্ঞতা হয়। এর আলোকে নির্ধারণ করা হয় আমাদের পরবর্তী করণীয়।

default-image

৪ নভেম্বর, বেলা দুইটার মতো হবে। আমি সহযোদ্ধাদের নিয়ে হাদারপাড়ে ছিলাম। তখন বিএসএফের দুজন কুরিয়ার আমাদের অবস্থানে আসেন। তাঁরা মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং গিলের একটি ব্যক্তিগত চিঠি আমাকে দেন। ওই চিঠির মাধ্যমে তিনি আমাদের ডাউকির বিএসএফের সীমান্ত ঘাঁটিতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। চিঠিতে আরও লেখা ছিল শাফায়াত জামিল সেখানে আমাদের অপেক্ষায় আছেন। নির্দেশ অনুসারে আমরা পরদিন সেখানে পৌঁছাই। এ সময় আমাদের আলফা কোম্পানিও সেখানে পৌঁছায়।

শাফায়াত জামিল আমাকে সঙ্গে নিয়ে কর্নেল রাজ সিংহের কাছে যান। ওখানে আমরা পরবর্তী কার্যক্রম বিষয়ে কথা বলি। সিদ্ধান্ত হয় রাধানগরের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণের।

রাধানগরের যুদ্ধ নিয়ে লেখার আগে পাঠকের সুবিধার্থে ভৌগোলিক ও সামরিক গুরুত্ব সম্পর্কে বলা প্রয়োজন। বর্তমান সিলেট বিভাগের আন্তর্জাতিক সীমানায় ভারতের কয়েকটি রাজ্য আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম। বাংলাদেশ থেকে ভারতের এসব রাজ্যের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের জন্য সিলেট-তামাবিল-ডাউকি-শিলং মহাসড়ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত যুদ্ধকালে এ সড়ক আয়ত্বে রাখার অর্থ বাংলাদেশের গোটা সিলেট বিভাগসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ ও ভৈরব পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা।

default-image

এ কারণেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সিলেট শহর থেকে শুরু করে তামাবিল বিওপি পর্যন্ত সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলে। এর মধ্যে রাধানগর ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাধানগর উচ্চবিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ধাপে ধাপে রাধানগরকে তারা দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে পরিণত করে। রাধানগরের প্রতিরক্ষা ছিল বিরাট এলাকাজুড়ে। এর আওতায় ছিল সুলতান মেম্বারের বাড়ি, ইসলামপুর-মুরা-কুমিল্লা বস্তি, কাফাউরা গ্রাম, জাফলং বাজার, জাফলং চা-বাগানের অংশবিশেষ ও ছোটখেল গ্রাম (মানচিত্র দেখুন)।

এখানে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। ছোটখেল গ্রামে ছিল তাদের কমান্ডপোস্ট বা প্রতিরক্ষাব্যবস্থার হেডকোয়ার্টার। এক অবস্থান থেকে আরেক অবস্থানে যাওয়ার জন্য ছিল মজবুত সুড়ঙ্গ। বাংকার ছিল মজবুতভাবে তৈরি। প্রতিটির ভেতরে ছিল থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। পেছনের দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও তারা যাতে এ কমপ্লেক্সে থেকে যুদ্ধ করতে পারে। সরবরাহ ছাড়া একটানা তিন-চার মাস যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থাই এখানে ছিল। এটা আমরা রাধানগর কমপ্লেক্স দখল করার পর বুঝতে পারি।

সিলেট শহর অভিমুখে অভিযান পরিচালনায় পাকিস্তানিদের রাধানগর কমপ্লেক্সে রেখে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অগ্রসর হওয়ার বিষয়টি হতো আত্মঘাতী। তাই রাধানগর দখলের সিদ্ধান্ত হয়। আমরা রণকৌশল নিই পাকিস্তানিদের রাধানগর ও ছোটখেল অবস্থানকে অবরোধ করে চূড়ান্ত আক্রমণ পরিচালনার।

পরিকল্পনামতো আমার দলের নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগর কমপ্লেক্সকে সামনে রেখে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল গণবাহিনীর কিছু মুক্তিযোদ্ধা। ৭ নভেম্বর আমার উপস্থিতিতে লুনি গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৮-২০ জনের একটি টহল দলকে আক্রমণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। তার পর থেকে বিরতি দিয়ে দিয়ে যুদ্ধ চলতে থাকে। ৮-৯ নভেম্বর লুনি গ্রাম, ১১ নভেম্বর ঘোরা গ্রাম, ছাত্তারগাঁ, দুয়ারীখেল, ১৫ নভেম্বর ছাত্তারগাঁ ও ঘোরা গ্রাম, ১৬ নভেম্বর ছাত্তারগাঁ ও দুয়ারীখেল, ১৮ নভেম্বর ছাত্তারগাঁ ও ঘোরা গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়।

২৪ নভেম্বরের মধ্যে ঘোরা, দুয়ারীখেল, ছাত্তারগাঁ, লুনি, জাফলং চা-বাগান, কাফাউড়া ও বাউরবাগ থেকে আমরা উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব দিক দিয়ে রাধানগর ও ছোটখেল অবরোধ করে ফেলি। এটা করার পর ২৫ নভেম্বর দুপুরে আমাদের জানানো হয় মিত্রবাহিনীর ৫/৫ গোর্খা রেজিমেন্ট পরদিন ভোরে রাধানগর ও ছোটখেলে একযোগে আক্রমণ চালাবে। তাদের একটি কোম্পানি ছোটখেল, দুটি কোম্পানি রাধানগরে আক্রমণ করবে। আমাদের আলফা কোম্পানি রাধানগর এবং ডেলটা কোম্পানির একাংশ ছোটখেল আক্রমণে তাদের প্রটেকশন দেবে। এ সিদ্ধান্তের কথা আমরা আগে থেকে জানতাম না। কারণ, যুদ্ধ পরিকল্পনায় এটা ছিল না।

২৬ নভেম্বর ভোর সাড়ে পাঁচটায় ৫/৫ গোর্খা রেজিমেন্ট রাধানগর ও ছোটখেল অবস্থানে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল রাও। মুহূর্তের মধ্যে গোটা এলাকা আর্টিলারির গোলার আঘাত ও শব্দে প্রচণ্ড ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে। গোলাবর্ষণের পর গোর্খারা সরাসরি আক্রমণ শুরু করে। ছোটখেলে গোর্খাদের সঙ্গে ছিল আমার অধীনে ডেলটা কোম্পানির একটি প্লাটুন। তাদের দায়িত্ব ছিল গোর্খাদের রুট অব উইথড্রল নিরাপদ রাখা এবং দক্ষিণ দিক থেকে সম্ভাব্য প্রতি-আক্রমণ প্রতিহত করা। গোর্খাদের এ কোম্পানি ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় তবে ছোটখেল দখল করে।

গোর্খাদের যে দুটি কোম্পানি রাধানগরে আক্রমণ করেছিল তারা লক্ষ্যবস্তুর ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারেনি। তারা ধানখেত দিয়ে অ্যাসল্ট লাইন তৈরি করে এগোনোর চেষ্টা চালায়। তখন পাকিস্তানি বাহিনী সড়কের ওপরের সেতুসংলগ্ন অবস্থান এবং কাছাকাছি অন্যান্য অবস্থান থেকে ছয়-সাতটি মেশিনগান ও কয়েকটি এলএমজি দিয়ে নিখুঁত নিশানায় গুলিবর্ষণ শুরু করে। গোর্খারা লাইন অব ফায়ারে পড়ে যায়। তাদের একজন কোম্পানি কমান্ডার মেজর এস পি সিং এবং লেফটেন্যান্ট দেবপাল সিংসহ চারজন অফিসার ও বিভিন্ন র্যাঙ্কের ৬৭ জন সৈনিক শহীদ হন। আহত হন শতাধিক। উদ্ধারের ব্যবস্থা না থাকায় মাঠজুড়ে শহীদদের মরদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে।

অন্যদিকে দখল করা ছোটখেলও গোর্খারা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানিরা পুনঃসংগঠিত হয়ে ছোটখেলে প্রতিহামলা চালায়। এ আক্রমণ এত ব্যাপক ও ক্ষিপ্র ছিল যে গোর্খারা কোনোভাবেই তা প্রতিহত করতে পারেনি। পরে তারা ছোটখেল থেকে আমাদের প্লাটুনের সহায়তায় পশ্চাত্পসরণ করতে বাধ্য হয়। এখানেও শহীদ হন ৩৬ জন।

মিত্রবাহিনীর এ বিপর্যয়ে চারদিকে শোকের ছায়া নেমে আসে। পাকিস্তানিদের মনোবল দেখে ভারতীয়রা তো বটেই, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাও ঘাবড়ে যান। খবর পেয়ে মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন। পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে তিনি কর্নেল রাওকে অবশিষ্ট সেনাদের নিয়ে আবার রাধানগর আক্রমণের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে শাফায়াত জামিলকে আমার ডেলটা কোম্পানি নিয়ে ছোটখেল আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করতে বলেন। যুদ্ধ পরিচালনার ভার পড়ে মিত্রবাহিনীর কর্নেল রাজ সিংহের ওপর।

কর্নেল রাজ সিং মেজর শাফায়াত জামিলকে অবিলম্বে ছোটখেল আক্রমণের নির্দেশ দেন। কিন্তু তিনি ছাতক ও গোয়াইনঘাট এবং রাধানগর ও ছোটখেল আক্রমণের ব্যর্থতার আলোকে প্রথাগত (কনভেনশনাল) আক্রমণ করতে রাজি হননি। এ ঘটনায় কর্নেল রাজ সিং তাঁকে তাত্ক্ষণিক ব্যাটালিয়ন (তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) কমান্ডের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন।

যা হোক, ২৬ নভেম্বর আমার অধীনে ডেলটা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল লুনি, দুয়ারীখেল, গোরা, ছাত্তারগাঁ ও শিমুলতলা গ্রামে। দুপুরে পাকিস্তানিরা আমাদের এই অবস্থানে আকস্মিক আক্রমণ করে। তখন দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। আমরা সফলতার সঙ্গেই আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হই। পাকিস্তানিদের আক্রমণ ছিল অনেকটা চিনা ওয়েভ পদ্ধতির। অর্থাত্ কয়েক স্তরের। প্রথম দিকের আক্রমণ কোনোভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছিল না। কিছুটা ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে আমরা আক্রমণ প্রতিহত করি। সারা রাত যুদ্ধ হয়। পরদিন ২৭ নভেম্বর থেমে থেমে যুদ্ধ চলে।

এ দিকে গোর্খাদের পরাজয় ও আমাদের বেশ ক্ষয়ক্ষতিতে সবার মধ্যে ছিল শোকের ছায়া। এ জন্য খণ্ডযুদ্ধ চলাবস্থায় আমি প্রতিটি অবস্থানে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙা করি। এসব করতে দুপুর হয়ে যায়। বিকেল চারটার দিকে কর্নেল রাজ সিং আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি আমাকে ছোটখেল আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। তাঁর এ নির্দেশ আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই। এরপর আক্রমণের কৌশলগত সবদিক অর্থাত্ আক্রমণের ধরন, অ্যাসল্ট ফরমেশন, লাইন অব অ্যাডভান্স, এফইউপি, এইচ আওয়ার, স্ট্রেন্থ অব দ্য অ্যাটাকিং ফোর্স ইত্যাদি নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করি। সিদ্ধান্ত হয় ২৮ নভেম্বর ভোরে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করার।

প্রতিক্ষিত সময় অর্থাত্ ভোর সাড়ে পাঁচটায় সুরক্ষিত ও ভারী অস্ত্রসজ্জিত এক কোম্পানি পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মাত্র এক কোম্পানি প্লাস মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমরা আক্রমণ করি। প্রথাগত যুদ্ধের সাধারণ নিয়ম অনুয়ায়ী তিন গুণ যোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ করতে হয়। আমাদের ভরসা ছিল মহান আল্লাহ তাআলা এবং অদম্য মনোবল।

যা হোক, ২৬ নভেম্বর আমার অধীনে ডেলটা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল লুনি, দুয়ারীখেল, গোরা, ছাত্তারগাঁ ও শিমুলতলা গ্রামে। দুপুরে পাকিস্তানিরা আমাদের এই অবস্থানে আকস্মিক আক্রমণ করে। তখন দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। আমরা সফলতার সঙ্গেই আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হই। পাকিস্তানিদের আক্রমণ ছিল অনেকটা চিনা ওয়েভ পদ্ধতির। অর্থাত্ কয়েক স্তরের। প্রথম দিকের আক্রমণ কোনোভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছিল না। কিছুটা ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে আমরা আক্রমণ প্রতিহত করি। সারা রাত যুদ্ধ হয়। পরদিন ২৭ নভেম্বর থেমে থেমে যুদ্ধ চলে।

এ দিকে গোর্খাদের পরাজয় ও আমাদের বেশ ক্ষয়ক্ষতিতে সবার মধ্যে ছিল শোকের ছায়া। এ জন্য খণ্ডযুদ্ধ চলাবস্থায় আমি প্রতিটি অবস্থানে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙা করি। এসব করতে দুপুর হয়ে যায়। বিকেল চারটার দিকে কর্নেল রাজ সিং আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি আমাকে ছোটখেল আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। তাঁর এ নির্দেশ আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই। এরপর আক্রমণের কৌশলগত সবদিক অর্থাত্ আক্রমণের ধরন, অ্যাসল্ট ফরমেশন, লাইন অব অ্যাডভান্স, এফইউপি, এইচ আওয়ার, স্ট্রেন্থ অব দ্য অ্যাটাকিং ফোর্স ইত্যাদি নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করি। সিদ্ধান্ত হয় ২৮ নভেম্বর ভোরে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করার।

প্রতিক্ষিত সময় অর্থাত্ ভোর সাড়ে পাঁচটায় সুরক্ষিত ও ভারী অস্ত্রসজ্জিত এক কোম্পানি পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মাত্র এক কোম্পানি প্লাস মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমরা আক্রমণ করি। প্রথাগত যুদ্ধের সাধারণ নিয়ম অনুয়ায়ী তিন গুণ যোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ করতে হয়। আমাদের ভরসা ছিল মহান আল্লাহ তাআলা এবং অদম্য মনোবল।

যা হোক মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সব মিলিয়ে প্রলয়ঙ্করী এক অবস্থা। মুক্তিযোদ্ধারা ‘আল্লাহ আকবর’ আর ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বাংকার টু বাংকার ফাইট করে সামনে এগিয়ে যান। কোনো কোনে অবস্থানে তাঁরা বেয়নেট চার্জ করেন। অপ্রতিরোধ্য মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধ করতে পারেনি। ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী নিহত কয়েকজনের লাশ ফেলে পালিয়ে রাধানগরের দিকে চলে যায়। চারদিকে তখন রক্তের বন্যা।

সকাল সোয়া সাতটার দিকে পাকিস্তানিরা তিন দিক থেকে প্রতি আক্রমণ শুরু করে। এ সময় শাফায়াত জামিল আহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ প্রতিহত করেন। পাকিস্তানিরা পুন পুন আক্রমণ চালাতে থাকে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতায় তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

কথা ছিল রাধানগর মুক্ত করার জন্য দ্বিতীয় ফেজে মিত্রবাহিনী পাকিস্তানিদের আক্রমণ চালাবে। কিন্তু সে আক্রমণ ২৯ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত হয়নি। এরপর আর প্রতীক্ষায় না থেকে আমি আমার ডেলটা, তৃতীয় বেঙ্গলের আলফা ও গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাধানগরে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম। ছোটখেল দখল করার পর উজ্জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা যেন আমার এ সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। আমার নির্দেশ পাওয়া মাত্র তাঁরা বিভিন্ন দিক দিয়ে পাকিস্তানিদের রাধানগর অবস্থানে আক্রমণ চালাল। এক ঘণ্টার মধ্যে গোটা এলাকা ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিল। সন্ধ্যার মধ্যেই বেশ কিছু এলাকা মুক্ত হয়ে গেল।

রাত ১০টায় পাকিস্তানিরা হঠাত্ ছোটখেল আক্রমণ করে বসে। এ আক্রমণ ছিল কল্পনাতীত। রাত প্রায় সাড়ে ১১টা পর্যন্ত আক্রমণ পাল্টা-আক্রমণ চলে। অবশেষে এক সময় পাকিস্তানিদের দিক থেকে গোলাগুলির তীব্রতা কমতে থাকে। রাত ১২টায় একদম বন্ধ হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি পাকিস্তানিরা রণেভঙ্গ দিয়েছে।

আমি মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দিলাম রাধানগরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। তাঁরা এগিয়ে যেতে থাকলেন। ৩০ নভেম্বর সকাল সাতটার মতো হবে। এ দিন ও ক্ষণটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই মুক্তিযোদ্ধারা গোটা রাধানগর শত্রুমুক্ত করে রাধানগর উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমিও সেখানে উপস্থিত হই। মুক্তিযোদ্ধাদের সব উপদলের কমান্ডাররা ফাঁকা গুলি ছুড়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানায়। এ যেন এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

লে. কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খান

বীর বিক্রম: মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের অন্যতম কোম্পানি কমান্ডার; মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৩ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত