বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালিদের একটি জনযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার জন্য এক পরিপূর্ণ সংগ্রাম। দ্রুতগতিতে বিষয়টি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সংকট থেকে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে রূপান্তরিত হয়। বস্তুত, ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থার কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রেও ছিল বাংলাদেশ এবং ডিসেম্বরে নিরাপত্তা ও সাধারণ পরিষদে আলোচনা-বিতর্ক, প্রস্তাব পাস, সর্বোপরি স্থায়ী সদস্যদের ভেটো প্রদান ইত্যাদি চিত্তাকর্ষক ঘটনাবলিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল জাতিসংঘের রণাঙ্গন। অর্থাত্, জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দিকটি বিশ্লেষণ করলে মুক্তিযুদ্ধের গভীরতা ও বহুমাত্রিকতার দিকটি অনুধাবন করা যায়। সাধারণভাবে দেখা যাবে যে বৃহত্-ক্ষুদ্রনির্বিশেষে প্রতিটি রাষ্ট্র জাতিসংঘে ‘ভূরাজনীতি’ ও তাদের ‘জাতীয় স্বার্থ’ অনুযায়ী ভূমিকা পালন করেছে, তবে এর ভেতরেও ছিল নানামুখী দ্বন্দ্ব ও ভিন্নমত। আবার মানব জাতির সর্ববৃহত্ ফোরাম হিসেবে জাতিসংঘ নিজেও বাংলাদেশ সংকটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুটো পর্যায়ে এই ভূমিকা প্রতিফলিত হয়। প্রথমত, ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের ভরণপোষণ ও দুর্ভিক্ষ রোধে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা; দ্বিতীয়ত, ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধ বন্ধ ও রাজনৈতিক প্রশ্নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ।

জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট ১৯৭১-এর মার্চের দিকে ঢাকা থেকে জাতিসংঘের কর্মীদের প্রত্যাহার করে নিলেও গণহত্যা বন্ধে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। তবে ১ এপ্রিল সাংবাদিকদের চাপের মুখে মহাসচিবের এক মুখপাত্র উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে মানুষের যে মৃত্যু হয়েছে সে বিষয়ে উ থান্ট অবশ্যই অবগত আছেন। ১২ মে উ থান্ট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে লেখা এক পত্রে লেখেন যে ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর ঢাকা থেকে জাতিসংঘের যেসব কর্মকর্তা ফেরত এসেছেন তাঁদের মাধ্যমে ও অন্যান্য সূত্র থেকে তিনি এক নেতিবাচক পরিস্থিতির আঁচ পেয়েছেন। তিনি ইয়াহিয়াকে জানান যে পাকিস্তানের সম্মতি পেলে জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থাগুলো ভূমিকা রাখতে পারে।

অন্যদিকে, ভারত সরকারও জাতিসংঘে পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থীদের সাহায্যের আবেদন জানায়। জুলাই মাসের শুরুতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রধান ইরানি নাগরিক প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান ঢাকা সফর শেষে দিল্লিতে যান। যেখানে তিনি সংবাদ সম্মেলনে জানান যে পূর্ব বাংলায় যতক্ষণ ভয়ের কারণসমূহ বিদ্যমান থাকবে, ততক্ষণ শরণার্থীরা ভারত থেকে ফেরত যাবে না। ৫ মে জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রিন্স আগা খান শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় ভারত ও মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেন। ১৯৭১-এর ২৮ জুলাই জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রতিনিধি জন আর কেলি ঢাকায় আসেন।

২ আগস্ট জাতিসংঘ গঠন করে ইউনিপোরও বা ইউনাইটেড নেশনস ইস্ট পাকিস্তান রিলিফ অপারেশন। বলা হয়, এই মিশন মানবিক বিপর্যয় রোধে কাজ করবে, শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করবে না। ২৩ আগস্ট ফ্রান্সের পররাষ্ট্র বিভাগের কর্মকর্তা পল মার্ক হেনরিকে এর প্রধান করা হয়। ৩ নভেম্বর পল মার্ক হেনরি ঢাকায় পৌঁছে রিলিফ কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন। তবে জাতিসংঘের প্রেরিত ত্রাণসামগ্রী পূর্ব বাংলার দুর্গত মানুষের কমই কাজে এসেছে, বরং অনেক সময় জাতিসংঘের যানবাহন পাকিস্তানি সেনারা দখলে নিয়ে যেত। এ জন্য ৫ মে ১৯৭১ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে পূর্ব বাংলায় জাতিসংঘের ত্রাণসামগ্রী লুণ্ঠনের জন্য পাকিস্তান সরকারকে অভিযুক্ত করেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে জাতিসংঘ ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্যে তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং জাতিসংঘ সৃষ্টির পর এটি ছিল সবচেয়ে বড় মানবিক সাহায্য। ২৩ এপ্রিল জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন শরণার্থীদের জন্য সাহায়তা কামনা করেন। এর ফলে মহাসচিব উ থান্ট ১৯ মে বিভিন্ন দেশের সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও জনগণের প্রতি বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। উ থান্টের এ আবেদনের পর বাংলাদেশ সংকট যেমন আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছিল, তেমনি জুন ১৯৭১ পর্যন্ত ভারত জাতিসংঘ ও অন্যান্য উত্স থেকে ২৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার সাহায্য পেয়েছিল।

বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানে জাতিসংঘ মহাসচিব ১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসের আগে দু-একটি বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু এতে কোনো সাফল্য আসেনি। তবে ডিসেম্বরের শুরুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশ। যেমন ৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হলে ৪ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক বসে। সভার শুরুতে সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিক দুটো প্রস্তাব করেন: ১. বাংলাদেশের মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর একটি পত্র নিরাপত্তা পরিষদের ডকুমেন্ট হিসেবে বিলি করা হোক; ২. বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে পরিষদে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হোক। তবে চীনা প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া বিরোধিতা করে বলেন, বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানোর অর্থ হলো একটি সদস্যরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা। প্রাথমিক বিতর্কের পর নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি, প্রথম প্রস্তাব অর্থাত্ নিরাপত্তা পরিষদের ডকুমেন্ট হিসেবে বিচারপতি চৌধুরীর পত্র বিলি করার দাবি মেনে নেন। কিন্তু দ্বিতীয় প্রস্তাব অর্থাত্ নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় বিচারপতি চৌধুরীর অংশগ্রহণের দাবি প্রয়োজনীয় সমর্থন না পাওয়ায় গ্রহণ করা হয়নি।

সোভিয়েত প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষদের কার্যপ্রণালীগত ৩৯ ধারা অনুযায়ী পরিষদের সভাপতির এই সিদ্ধান্তকে পুনরায় চ্যালেঞ্জ করেন। ইয়াকভ মালিক যুক্তি উত্থাপন করে বলেন যে যেহেতু নিরাপত্তা পরিষদের নয়টি সদস্যরাষ্ট্র অবনতিশীল পরিস্থিতি বিশেষভাবে বিবেচনার জন্য পরিষদের জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে, সেহেতু বিচারপতি চৌধুরীর অংশগ্রহণে বাধা কোথায়? গোটা পরিস্থিতির মৌল বৈশিষ্ট্য কী? বিষয়টি বিবেচনার আগে এই বৈশিষ্ট্য জেনে নেওয়া উচিত নয় কি? তিনি বলেন যে যদি পরিষদ পরিস্থিতির বাস্তবসম্মত পর্যালোচনা করতে চায়, তবে পরিষদের উচিত শুরুতেই বাঙালিদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনা। তিনি বলেন, বিচারপতি চৌধুরী হচ্ছেন সেই দলের প্রতিনিধি যে দলটি পাকিস্তানের সংসদীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে এবং প্রাদেশিক পরিষদের প্রায় সব কটি আসনেও জয়লাভ করেছে।

পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি সোভিয়েত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জোরালো আক্রমণ চালিয়ে বলেন, ‘কথিত’ প্রতিনিধিদলকে স্বীকৃতি দিলে নিরাপত্তা পরিষদ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতায় ‘ছুরিকাঘাত’ করবে। শেষ পর্যন্ত, মতভিন্নতার কারণে নিরাপত্তা পরিষদ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতাকে আমন্ত্রণ জানায়নি। তবে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিচারপতি চৌধুরীর লেখা পত্রটি নিরাপত্তা পরিষদে পাঠ করে শোনানো হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই পত্রটির অনন্যসাধারণ গুরুত্ব রয়েছে। এতে সংক্ষিপ্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, কারণ ও জাতিসংঘের ভূমিকা এবং কর্তব্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, কিন্তু তখন এই পত্রটিকে নিরাপত্তা পরিষদের দলিল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১৯৭১-এ দুই পরাশক্তির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নীতি ছিল পাকিস্তানঘেঁষা। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করেন। ডিসেম্বর মাসে যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি ভূরাজনৈতিক স্বার্থে তত্পর হয়ে ওঠেন। এই নীতির সূচনা হয়েছিল কিসিঞ্জারের চীন সফরের অব্যবহিত পর। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মাধ্যমে তার কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখল।

তবে মার্কিন কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ অনেকটা ব্যর্থ হয় এই জাতিসংঘেই, সোভিয়েত ভেটোর কারণে। নিরাপত্তা পরিষদে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপ প্রয়োগ ব্যর্থ হলে অধিকতর বৃহত্ পরিসরকে যুক্তরাষ্ট্র বেছে নেয় এবং নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ ছয়টি অস্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র উপমহাদেশের পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ সংকটকে সাধারণ পরিষদে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়। এ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সক্রিয় কূটনৈতিক তত্পরতা যখন নিউইয়র্কের জাতিসংঘ ভবনে চলছিল তখন ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপও অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে এর যথার্থ উপযোগিতা নিয়ে একমত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এই সমন্বিত ও পরিকল্পিত উদ্যোগের কারণেই সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিমূলক একটি প্রস্তাব বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হয়ে যায়। এভাবে, একটি নৈতিক চাপ তৈরি হলেও, সাধারণ পরিষদের এই প্রস্তাবের প্রকৃতি ছিল সুপারিশমূলক, ফলে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব ভারত যখন কার্যত অস্বীকার করল তখন নিক্সন ও কিসিঞ্জার জুটির মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। ফলে সমগ্র পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ১২ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে একটি জরুরি সভা বসে। যেখানে নিক্সন, কিসিঞ্জার ও জেনারেল হেউগ উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা বোম্বাটে বা বলপ্রয়োগ কূটনীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁদের আশা ছিল যে চীন পাকিস্তানকে সহযোগিতা করবে। এতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিশ্চুপ থাকবে না, ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। অনেকে মনে করেন, নিক্সন ব্যক্তিগতভাবে এই ঝুঁকি গ্রহণে স্থিরচিত্ত ছিলেন।

নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির এই পরিকল্পিত ছক দুটি প্রায়োগিক ক্ষেত্রে লক্ষণীয়ভাবে প্রকাশ পায়। প্রথমত, ১২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় জাতিসংঘকে ব্যবহারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের উদ্যোগে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে (যুদ্ধবিরতির জন্য) পুনরায় নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশন বসে। ১৩ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে দ্বিতীয়বারের মতো একটি প্রস্তাব পাসের উদ্যোগ নেয় কিন্তু সোভিয়েত ভেটোর কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন জাতিসংঘে ভারতকে আগ্রাসী শক্তি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে তার মদদদাতা হিসেবে পুনঃ পুনঃ অভিযোগ করে, যা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। দ্বিতীয়ত, নিক্সন প্রশাসন পারমাণবিক জাহাজ এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে আটটি জাহাজের একটি ‘টাস্কফোর্স’ বঙ্গোপসাগরে পাঠানোর নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য ছিল দিল্লি ও মস্কোর ওপর চাপ প্রয়োগ করা। অর্থাত্ কূটনৈতিক ক্ষেত্রে জাতিসংঘ এবং সামরিক ক্ষেত্রে ‘এন্টারপ্রাইজ’-এ দুটি শক্তিশালী অস্ত্রকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম স্তব্ধ করতে প্রয়োগ করা হয়েছিল।

অবশ্য চীন প্রকাশ্যে যত বাগাড়ম্বর করেছিল কার্যক্ষেত্রে ঠিক ততটাই নিষ্ক্রিয় ছিল। কারণ চীন সামরিক সাহায্য নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি। জাতিসংঘে বাংলাদেশের অভ্যুদয়বিরোধী মার্কিন কূটনীতি সফল না হওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, পুঁজিবাদী বিশ্বের দুটি শক্তিশালী মিত্র ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে সহায়তা করেনি। তারা যেমন মার্কিন পক্ষ নেয়নি, তেমনি সোভিয়েত পক্ষেও যায়নি। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের এই নীরবতা এবং সোভিয়েত ভেটোর কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন জাতিসংঘকে ব্যবহার করতে পারেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত, মার্কিন সিনেট ও কংগ্রেসসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের সহানুভূতি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘের ভূমিকায় যে টানাপোড়েন, তা হয়েছিল বৃহত্ শক্তির, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তত্পরতার জন্য। তবে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর একটি পত্র নিরাপত্তা পরিষদের ডকুমেন্ট হিসেবে বিলি করা হয়েছিল, যেখানে সংক্ষিপ্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, কারণসমূহ ও জাতিসংঘের ভূমিকা এবং কর্তব্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। নিরাপত্তা পরিষদকে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়নি তার জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। দেশটি নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামবিরোধী বিভিন্ন প্রস্তাবের বিরোধিতা করে দুভাবে।

এক. সময় ক্ষেপণ করে, দুই. ভেটো প্রয়োগের মাধ্যমে। পরিষদে সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকুব মালিক বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক চলাকালে অধিবেশন মুলতবির কথা বলেছেন, যাতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মস্কোর সঙ্গে পরামর্শ করা যায়। ফলে যেখানে অধিবেশন দুই ঘণ্টার জন্য মুলতবি করার কথা তখন তা করা হয়েছে ১২ ঘণ্টা বা ২০ ঘণ্টার মতো। এই কৌশল যখন ব্যর্থ হয়েছে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় পথ অর্থাত্ ভেটো প্রয়োগ করেছে। ফলে ঢাকার পতনের জন্য যৌথ বাহিনী প্রয়োজনীয় সময় পেয়েছে। সর্বোপরি, ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের ফলে নিরাপত্তা পরিষদে অচলাবস্থা যেমন কেটে যায়, তেমনি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে সংকটের চূড়ান্ত সমাধানও হয়ে যায়। ফলে জাতিসংঘের ভেতরে ও বাইরে স্বস্তি ফিরে আসে।

ড. আশফাক হোসেন: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত