বিজ্ঞাপন
default-image

ইয়াহিয়া খানকে পদগর্নি

২ এপ্রিল, ১৯৭১ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে যে চিঠি লিখেছেন

সম্মানিত প্রেসিডেন্ট,

ঢাকায় আলোচনা ভেঙে যাওয়ার খবর এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক প্রশাসনের চরম ব্যবস্থা গ্রহণ ও সশস্ত্র শক্তি প্রয়োগের খবর সোভিয়েত ইউনিয়নে গভীর আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে।

যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে পাকিস্তানের অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, ভোগান্তি ও দুস্থাবস্থায় সোভিয়েত জনগণ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। এম রহমান ও অন্যান্য রাজনীতিবিদ, যাঁরা সম্প্রতি সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সমর্থনে বিজয়ী হয়ে এসেছেন, তাঁদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন সোভিয়েত ইউনিয়নে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। সোভিয়েত জনগণ সব সময়ই পাকিস্তানের জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ ও উন্নতি কামনা করেছে এবং যেসব জটিল সমস্যা দেশ মোকাবিলা করেছে, গণতান্ত্রিকভাবে এর সমাধানে যখনই সমস্যা এসেছে, সোভিয়েত জনগণ আনন্দ প্রকাশ করেছে।

পাকিস্তানি জনগণের এই সংকটের দিনে প্রকৃত বন্ধু হিসেবে কিছু কথা না বলে পারছি না। আমরা বিশ্বাস করি, পাকিস্তানে শেষ দিকে যে জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছে, কোনো ধরনের বল প্রয়োগ না করে রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান করা সম্ভব এবং তা-ই করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর অত্যাচার, অবদমন ও রক্তপাত অব্যাহত রেখে সমাধানকে আরও কঠিন করে তোলা হবে এবং তা পাকিস্তানের সব মানুষের মৌল স্বার্থের প্রচণ্ড ক্ষতি করে ছাড়বে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েত প্রেসিডিয়ামের পক্ষে আপনাকে জানানো আমাদের কর্তব্য যে অবিলম্বে রক্তপাত বন্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর নিপীড়ন কমিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ দেখুন। আমরা মনে করি, কেবল তাতেই জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা এবং আঞ্চলিক শান্তি রক্ষা করা সম্ভব হবে। সোভিয়েত জনগণ শান্তিপূর্ণ সমাধান সানন্দে গ্রহণ করবে।

বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণার মানবিক নীতিমালা অনুসরণ করে আমরা এই আপিল জানাচ্ছি, আমরা পাকিস্তানের বন্ধুপ্রতিম জনগণের সম্মতিতে তাদের সবার জন্য এই আপিল পেশ করছি।

প্রেসিডেন্ট সাহেব, আমরা আশা করব, এ চিঠির প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবনে আপনি সক্ষম হবেন। আমাদের একান্ত প্রত্যাশা, অবিলম্বে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক।

এন. পদগর্নি

মস্কো, ক্রেমলিন ২ এপ্রিল, ১৯৭১

default-image

নিক্সনকে আঁদ্রে মালরো

ফরাসি দার্শনিক-লেখক আঁদ্রে মালরো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে যে চিঠি লেখেন, তার অংশবিশেষ

যখন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী অর্থাৎ আপনার সেনাবাহিনী ভিয়েতনামের নগ্নপদ যোদ্ধাদের পরাস্ত করতে ব্যর্থ হলো, আপনি কেমন করে বিশ্বাস করেন, স্বাধীনতার জন্য উদ্বেল একটি দেশ এক হাজার ২০০ মাইল দূর থেকে এসে ইসলামাবাদ পুনরুদ্ধার করতে পারবে?

বঙ্গোপসাগরে উড়োজাহাজবাহী রণতরী পাঠানো—যখন পৃথিবীর নিয়তি অনিশ্চিত—এটা কোনো নীতি হতে পারে না। হতে পারে কেবলই অতীতের ধ্বংসস্তূপ।

(১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ লে ফিগারো তে প্রকাশিত)।

default-image

টাইমস সম্পাদককে স্টোনহাউস

জন স্টোনহাউস ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই চিঠি দ্য লন্ডন টাইমস -এর সম্পাদককে লেখা, ৮ জুন ১৯৭১ প্রকাশিত।

মর্মন্তুদ অপরাধ

পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে মানবতার বিরুদ্ধে যে ভয়াবহ অপরাধ করে যাচ্ছে, তার সাক্ষ্য মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বাস্তবিকই দেশ ছেড়ে পালানো বাস্ত্তত্যাগীদের যে স্রোতধারা, তা-ই প্রমাণ করে তাদের অপরাধকর্ম এখনো চলছে।

এ জনস্রোত সামলে নেওয়ার যে অতিকায় সমস্যা, তা লাঘব করতে ভারত সরকারকে সাহাঘ্য করতে হবে। এটা ঠিক। কিন্তু ৪০ লাখ শরণার্থী হচ্ছে দুর্যোগের লক্ষণ, দুর্যোগের কারণ নয়। দৃঢ়ভাবে গণহত্যা বন্ধের উদ্যোগ না নিয়ে ক্ষতস্থানে কেবল মলমের ছোঁয়া লাগিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় বিবেককে আর কতকাল ঘুম পাড়িয়ে রাখবে? পাকিস্তানের জন্য প্রদেয় সাহাঘ্য কেটে শরণার্থীদের জন্য দিয়ে দেওয়ার আলোচনা প্রশংসনীয় কিন্তু যথেষ্ট নয়।

জন স্টোনহাউস

এমপি

default-image

তাজউদ্দীনকে ইন্দিরা গান্ধী

৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী

হিজ এক্সিলেন্সি, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আপনি ৪ ডিসেম্বর যে বার্তাটি পাঠিয়েছেন, তা আমাকে এবং ভারত সরকারে আমার সহকর্মীদের বিশেষভাবে স্পর্শ করেছে। বার্তাটি পাওয়ার পর আপনারা যেভাবে আত্মনিবেদিত হয়ে বাংলাদেশকে পরিচালনা করছেন, সেই দেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি ভারত সরকার পুনরায় বিবেচনা করে। আমি হৃষ্টচিত্তে আপনাকে জানাতে চাই, বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে তার আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ সকালে এ বিষয়ে আমি আমাদের সংসদে একটি বিবৃতি দিয়েছি। বিবৃতির অনুলিপি সংযুক্ত করছি।

বাংলাদেশের মানুষকে অনেক ভুগতে হয়েছে। আপনার তরুণ ছেলেরা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য আত্মবলিদানের সংগ্রামে লিপ্ত। ভারতের জনগণও একই আদর্শের প্রতিরক্ষায় লড়ে যাচ্ছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে এই শ্রেষ্ঠতম উদ্যোগ এবং আত্মদান ভালো কাজের জন্য আমাদের আত্মনিবেদনকে আরও শক্তিশালী করবে এবং দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্ব অক্ষুণ² রাখবে। যা হোক, পথ যত দীর্ঘই হোক, আত্মদান যত বেশিই হোক, আমাদের দুই দেশের মানুষের ভবিষ্যতে ডাক পড়বে, আমি নিশ্চিত আমরা বিজয়ীই হব।

ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে, আপনার সহকর্মীদের এবং বাংলাদেশের বীর জনতাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানানোর সুযোগ নিচ্ছি।

আপনার মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিজ এক্সিলেন্সি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আমার সর্বোচ্চ সম্মানের নিশ্চয়তা জ্ঞাপন করবেন।

হিজ এক্সিলেন্সি মিস্টার তাজউদ্দীন আহমদ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী

মুজিবনগর

আপনার একান্ত

(স্বাক্ষরিত)

ইন্দিরা গান্ধী

(দীর্ঘ বিবৃতিটি এখানে সংযুক্ত ক

সিনেটর স্যাক্সবিকে জন রোহ্‌ড

জন রোহ্‌ড ইউএসএআইডির পূর্ব পাকিস্তান অংশে কর্মরত ছিলেন। সিনেটর স্যাক্সবিকে লেখা তাঁর চিঠিটি যুক্তরাষ্ট্র কাঁপিয়ে দিয়েছে। সমর্থন জুগিয়েছে স্বাধীনতা-সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশকে। চিঠিটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।

হাডসন, ওয়াহিও ১৭ এপ্রিল ১৯৭১

মাননীয় উইলিয়াম বি স্যাক্সবি

নিউ সিনেট অফিস বিল্ডিং

ওয়াশিংটন ডিসি

প্রিয় সিনেটর স্যাক্সবি,

দুদিন আগে আমার স্ত্রী ও আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। ইউএসএআইডির ডাক্তার হিসেবে আমি গত তিন বছর সেখানে কর্মরত ছিলাম। ২৫ মার্চ সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাবলি আপনার জানা আছে, এটা আমি নিশ্চিত। কিন্তু পুরোপুরি সেন্সরশিপ আরোপ, সাংবাদিকদের বহিষ্কার করা, পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর প্রচারণা এবং দাবিয়ে রাখা—সব মিলিয়ে সে দিনের পর পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটেছে, সে খবর জানা খুবই কষ্টকর। সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই আমেরিকার কনসাল জেনারেল এবং তাঁর অধীন কর্মচারীরা সব ঘটনার বাস্তব বিবরণ—ফার্স হ্যান্ড রিপোর্ট পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন। এসব প্রতিবেদন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সংগ্রহ করা হতো, পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানোর আগে যাচাই করা হতো। পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশ্যে বলছে, তাদের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। কিন্তু প্রতিদিন আমি তথ্যবহুল প্রতিবেদন ঢাকা থেকে পাঠাতে দেখেছি। করাচিতে কর্মরত আমেরিকান কনসাল আমাকে বলেছেন, অতি সম্প্রতি তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের এসব বিবরণ পেতে শুরু করেছেন, অথচ ঢাকা কনস্যুলেট একেবারে শুরু থেকে প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে।

যদিও কনসাল ব্লাডের (আর্চার ব্লাড) প্রতিবেদনে বর্তমান পরিস্থিতি বিস্তারিতভাবে বিবৃত, আমি কতগুলো পর্যবেক্ষণের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ২৫ মার্চ রাতে আমি ও আমার স্ত্রী ছাদের ওপর থেকে আর্টিলারি ও মর্টারের গোলার আগুনের লাল শিখায় দেখেছি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংক বের হয়ে আসছে। গোলা বর্ষিত হচ্ছে জনাকীর্ণ বস্তি ও বাজারের ওপর। দুদিনের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ও মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণের শব্দের মধ্যে যখন কারফিউ ভাঙল, আমরা শহরের ভেতর গাড়ি চালিয়ে এগোতে থাকলাম। যারা শহর ছাড়ছে, তাদের ভিড় ঠেলে গুলশান থেকে মহাখালী আসার পথে দেখলাম, রেললাইনের ধারের ঝুপড়িগুলো আগুনে পোড়া। কাছাকাছি বসবাস করা আমার এক বাঙালি বন্ধু দেখেছেন, সেনাসদস্যরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে আর যখন একটি পরিবার ছুটে বের হয়ে আসছে, তখন তাদের কুকুরের মতো গুলি করে মেরেছে। আমরা যখন তাকেসহ ১২ জনের পরিবারটিকে আমাদের বাসায় আশ্রয় দিতে চাইলাম, তিনি রাজি হলেন।

পুরোনো শহরে আমরা নয়াবাজারে ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে হাঁটছিলাম। এখানে হিন্দু ও মুসলমান কাঠুরেরা কাজ করত, এখন সেখানে কিছু লোহা, পাত ও ধিকিধিকি জ্বলা ধ্বংসাবশেষ। শাঁখারি বাজারের হিন্দু দোকানদার ও কারিগর যারা তখনো বোমার ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে জীবিত, মরিয়া হয়ে আমার কাছে সাহাঘ্য চাইল— অভিযানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেনাবাহিনী এলাকার সবাইকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ চালায়। একজনের পেটে গুলি লাগে। আমরা পৌঁছার মাত্র আধঘণ্টা আগে মারা যায়। অন্যরা রাস্তায় পড়ে আছে, পচছে। যেদিন আমাদের ঢাকা ছাড়তে হলো, তার আগের দিন শাঁখারি বাজার গিয়ে দেখলাম, হিন্দুদের বাড়ির ওপর উদু‌র্ হরফে মুসলমানদের নাম লিখা। ২৯ মার্চ আমরা রমনা কালীবাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। ঢাকার কেন্দ্রে রমনা রেসকোর্সের ভেতর এ পুরোনো গ্রামটিতে প্রায় আড়াই শ মানুষ বাস করত। দেখলাম, মেশিনগানের গুলিতে ও আগুনে পোড়া পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের স্তূপ। সে দিনই অতিভোরে তাদের হত্যা করা হয়েছে, আমি ঘটনার ক ঘণ্টা পর এ দৃশ্যের ছবি তুললাম।

সদরঘাট, শাঁখারিপট্টি, রায়েরবাজার, নয়াবাজার ও ঠাঁটারি বাজারে হাজার হাজার মানুষের বাড়িঘর, ভিটি পর্যন্ত পোড়া।

২৯ তারিখে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রদের আবাসন জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলাম। সেনাবাহিনীর ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। জগন্নাথ হলের নিবাসী সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। যেদিক দিয়ে ট্যাংক গিয়েছে, ভাঙা দেয়াল চোখে পড়ল। হলের সামনে ট্যাংক চলাচলের চিহ্ন এবং গণকবর। একজনের সঙ্গে কথা হলো—তাকে মৃতদেহ টেনে বের করতে বাধ্য করা হয়েছে, তিনি এক কবরে ১০৩ জনের লাশ গুণেছেন। বাইরে ডর্মিটরির দেয়ালে বড় বড় ছিদ্র, ভেতরে রুমে রুমে তখনো ধোঁয়া আর মেঝে রক্তাক্ত। আমরা ইকবাল হলেও ট্যাংক আক্রমণের চিহ্ন দেখলাম, সেখানে মৃতদেহগুলো পড়ে আছে, তখনো কবর দেওয়া হয়নি।

পরের দুই সপ্তাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ অধ্যাপকসহ পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে নিধন করা হলো। তাঁদের মধ্যে রয়েছে দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জি সি দেব, পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, ইংরেজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. নাকভি, ইতিহাস বিভাগের প্রধান ড. আলী।

অধ্যাপকদের পরিবারের অনেক সদস্য গুলিবিদ্ধ হন। এসবের পুরো দলিলীকরণ খুব কঠিন কাজ, ঢাকা ছাড়ার সময় সেনাবাহিনী তন্নতন্ন করে তল্লাশি করে। তিনটি বহুল প্রচারিত পত্রিকা অফিস দ্য পিপল , ইত্তেফাক সংবাদ কার্যালয় পুড়িয়ে ফেলার পর সংবাদ পরিবেশনের ওপর পূর্ণ সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়।

প্রথম দুদিনের আক্রমণের পরও সামরিক বাহিনীর আক্রমণ অব্যাহত থাকে। পয়লা এপ্রিল খুব ভোরে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আর্টিলারি গোলাবর্ষণ চলে। সন্ত্রস্ত ঢাকা শহর থেকে পলায়নপর প্রায় এক লাখ মানুষ তখন জিঞ্জিরায়। রেডিও পাকিস্তান ক্রমাগত বলতে থাকে, ঢাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। কিন্তু আমরা দেখলাম, প্রায় জনশূন্য একটি শহর।

ঢাকার উপশহর গুলশান, যেখানে আমরা থাকতাম দেখলাম, শিশু পার্কের সামনে থেকে দায়িত্বরত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস সদস্যদের নিরস্ত্র করা হয়; কাছের একটি বাজারে সেনারা খাবারের দোকানে লুটপাট চালায়। ইপিআর সদস্যদের ‘নিয়ে যাওয়া’র জন্য বলপূর্বক একটি ট্রাকে উঠিয়ে দেওয়া হয়—এর চূড়ান্ত পরিণতি মৃত্যু। হাজার হাজার বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর সদস্যের গণহত্যার চিত্র ক্যামেরা বন্দি করা হয়েছে। এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে দেখলাম, গুলশান লেকে কম বয়সী ছেলেরা সাঁতার কাটছিল, সেনাসদস্যরা সেখানে তিনবার গুলি করে। প্রায় প্রতি রাতে আমার বাসার আশপাশে গোলাগুলির শব্দ শুনি। আমার বাসায় আশ্রয় নেওয়া মোট ২৬ জন মানুষের আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দেয়।

অনেক সুনির্দিষ্ট নৃশংসতার বিবরণ আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব; কিন্তু আমরা পেছনে যেসব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের রেখে এসেছি এতে তাদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে। এটা এখন স্পষ্ট, পূর্ব পাকিস্তানে জংলি আইনের রাজত্ব চলছে—নিরস্ত্র জনতাকে হত্যা, বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত বিনাশ এবং হিন্দুদের নিঃশেষ করে দেওয়ার কাজ বেশ এগোচ্ছে।

পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জনতার ওপর যে অনৈতিক আঘাত করে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে কোনো ধরনের বিবৃতি না দেওয়াতে মনে হচ্ছে বরং তাদের সমর্থনই করছে। আমাদের পাকিস্তানি বাণিজ্যিক উড়োজাহাজে উঠিয়ে আনা হয়েছে। এ উড়োজাহাজ বোঝাই পাকিস্তানি সেনা ও সামরিক রসদ নামানোর পর আমাদের উঠানো হয়। আমেরিকার সাহাঘ্য নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানে কাজে লাগছে। তেহরানে পাকিস্তানের স্থানীয় সহায়তা না পাওয়ায় আমি বার্তাটি পাঠাতে পারিনি।

এই সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করা কিংবা বাঙালিদের ওপর অকথ্য অত্যাচার বন্ধ করার সামর্থ্য আমাদের সরকারের নেই—এটা পুরোপুরি মেনে নিয়েও পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে অমানবিক আচরণ পাচ্ছে, অন্তত তার নিন্দা জানানোর জন্য আপনি কংগ্রেস ও প্রেসিডেন্টের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবেন, এ আমার আরজি।

কোনো রাজনৈতিক বিবেচনাই মানবিক ভূমিকাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না—ব্যক্তির জীবনের মূল্য সরকারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আমেরিকান বিশ্বাস পুনরুক্তি করতে হচ্ছে।

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, যার পেছনে রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮ শতাংশ মানুষের সমর্থন—প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন; যে দেশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বড়াই করে, এ ঘটনায় সে দেশের জেগে ওঠার কথা।

আমাদের নিবেদন, পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক জনগণের এ ট্র্যাজিক হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আপনি সক্রিয়ভাবে মুখ খুলুন।

আপনার একান্ত

জন ই রোহ্‌ড, এমডি

এ মর্মন্তুদ চিঠিটি সিনেটে উপস্থাপিত হয় ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল।

থিওডোরা ফস্টারের খোলা চিঠি

১২ আগস্ট, ১৯৭১। অক্সফাম আমেরিকার নির্বাহী পরিচালক থিওডোরা ফস্টার শরণার্থী সহায়তার জন্য যে চিঠি লেখেন, তা মানবিক সহায়তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই চিঠিই প্রচারপত্র হিসেবে বিলি করা হয়।

আগস্ট ১২, ১৯৭১ অক্সফাম আমেরিকা

ইনকরপোরেটেড

১০২৮, কানেক্টিকাট এভিনিউ, এনডব্লিউ, স্যুট ৫০৯

ওয়াশিংটন ডিসি ২০০৩৬

প্রিয় বন্ধু,

ধরুন, আপনাকে এবং সঙ্গে আরও ৭০ লাখ আমেরিকানকে (নিউইয়র্ক সিটির প্রায় সবাই) হঠাৎ পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে মেক্সিকো চলে যেতে হলো। সঙ্গে আর কিছু নেই, পিঠের ওপর কেবল কিছু কাপড়। আপনি কি সাহাঘ্য ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবেন? আর আপনি কি আশা করেন যে মেক্সিকো আপনার এবং আর সবার দায়িত্ব নিতে পারবে?

ভারতে পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের মধ্যে এখন ঠিক এ রকম একটি অবস্থা বিরাজ করছে। মরিয়া হয়ে ওঠা এই শরণার্থীদের খাবার, আশ্রয় ও জরুরি চিকিৎসা প্রদানের যে বোঝা ভারত সরকারের ওপর চেপেছে, তা তারা সাধ্যমতো বহন করে চলেছে; কিন্তু ভারত তো একা এ কাজ সামলাতে পারবে না।

আমরা যারা ধনবান দেশে বাস করি, ক্ষুধা ও অসুখের কারণে মৃত্যুর হাত থেকে শত-সহস্র নিরপরাধ শিশু ও বয়স্ক মানুষকে বাঁচাতে আমরাই একমাত্র ভরসা। অনেক আমেরিকান, কানাডিয়ান ও ব্রিটিশ অক্সফামের মাধ্যমে তাঁদের সাহাঘ্য পাঠাতে ছুটে এসেছেন। অক্সফাম একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, ১৯৪২ সাল থেকে দুর্যোগকবলিত মানুষকে সহায়তা করে আসছে। অক্সফাম লক্ষ রাখবে, যাতে আপনার ডলারটি এই সংকটে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে।

আপনার চেক অনুগ্রহ করে অক্সফাম-আমেরিকা, স্যুট ৫০৯, ১০২৮, কানেক্টিকাট এভিনিউ, এনডব্লিউ, ওয়াশিংটন ডিসি-২০০৩৬ ঠিকানায় পাঠান। আপনার দান কর রেয়াতযোগ্য।

আক্ষরিকভাবেই আজ জীবন ও মৃত্যুর ক্ষমতা আপনার হাতে। আপনার কলম হাতে নিন এবং জীবনের পক্ষে একটি ভোট দিন!

আপনার একান্ত

থিওডোরা সি ফস্টার

এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর

default-image

নিক্সনকে সিনেটর ফ্রাংক চার্চ

২২ জুন ১৯৭১ নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদদাতা ট্যাড শুলক একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশ করলেন।

পাকিস্তানি পতাকাবাহী একটি মালবাহী জাহাজ সামরিক সরঞ্জামবোঝাই অবস্থায় নিউইয়র্ক থেকে করাচির উদ্দেশে রওনা করতে যাচ্ছে। এ ধরনের সরঞ্জাম পাঠাতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

বিষয়টি উদ্বেগজনক। প্রথম থেকেই বলা হচ্ছে, পাকিস্তান সরকার আমেরিকান অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যায় ব্যবহার করছে। সেদিনই সিনেটর ফ্রাংক চার্চ মার্কিন সিনেটে বিষয়টি উত্থাপন করে জানালেন, তাঁর কাছে প্রামাণিক দলিলপত্র রয়েছে যে দুটি মালবাহী জাহাজ সুন্দরবন ও পদ্মা ৮ ও ১২ জুন নিউইয়র্ক বন্দর ছেড়ে যাওয়ার কথা। বিশেষ করে পদ্মা সেদিন বিকেলেই বন্দর ছেড়েছে। তিনি প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেছেন, যেন সেদিনের চালানটি বন্ধ করার উপযুক্ত নির্দেশ দেন। ২৩ তারিখে জাহাজটি মন্ট্রিয়েল ডকে পৌঁছার কথা। তিনি বলেন, কোস্টগার্ড যদি যুক্তরাষ্ট্রের জলসীমায় জাহাজটিকে আটকাতে সমর্থ না হয়, তাহলে কানাডা সরকারের সাহাঘ্য নিয়ে নিষিদ্ধ সরঞ্জাম পাঠানোর উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র সিনেট

ওয়াশিংটন ডিসি

২২ জুন, ১৯৭১

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১০ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত