বিজ্ঞাপন
default-image

৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জহির আলম খান ২৩ মার্চ ১৯৭১ তারিখ সকালে কুমিল্লা থেকে সি-১৩০ বিমানযোগে ঢাকা এসে পৌঁছান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করার বিশেষ মিশন নিয়ে তিনি ঢাকা এসেছেন, কিন্তু তখনও এ বিষয়ে বিশেষ কিছু জানেন না। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়, দিনক্ষণ ঠিক করার বিষয়টি নির্ভর করছিল অপারেশন সার্চলাইটের জন্য সেনাবাহিনীর সার্বিক প্রস্তুতির ওপর। বিমানবন্দর থেকে কর্নেল জহির সরাসরি মার্শাল ল হেডকোয়ার্টার্সে কর্নেল এস ডি আহমেদের সঙ্গে দেখা করেন।

কর্নেল আহমেদ কর্নেল জহিরকে পর দিন (২৪ মার্চ) কিংবা তারও পরের দিন (২৫ মার্চ) শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনা তৈরি করতে বলেন। কর্নেল জহির এ কাজে কমান্ডো ব্যাটালিয়নের জাংজু কোম্পানিকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। ২৩ মার্চ রাতেই তিনি কোম্পানি কমান্ডার মেজর বেলাল ও কোম্পানির দুই প্লাটুন কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুমায়ুন ও ক্যাপ্টেন সাঈদকে নিয়ে বেসামরিক গাড়িতে করে শেখ মুজিবের বাড়ি রেকি করতে যান। তাঁরা দেখতে পান, একদল বাঙালি পুলিশ প্রহরী বাড়িটির নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। এ ছাড়া প্রচুর সাধারণ মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে বাড়ির সামনে অবস্থান নিয়ে আছে।

default-image

কর্নেল জহির ২৪ মার্চ সকালে শেখ মুজিবের বাসভবনের আশপাশের বাড়ি ও রাস্তা রেকি করেন। এরপর নির্দেশ অনুযায়ী বেলা ১১টার সময় তিনি যান মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর কাছে। জেনারেল রাও কর্নেল জহিরকে ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের কথা বলেন। এ জন্য কর্নেল জহিরকে তিনি একজন কর্মকর্তাসহ বেসামরিক গাড়িতে করে শেখ মুজিবের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করতে বলেন। কর্নেল জহির শেখ মুজিবের বাড়ির প্রহরী ও চারদিকের জনসাধারণকে প্রতিরোধ করার জন্য এক কোম্পানি সেনা প্রয়োজন হবে বলে জানান। জেনারেল রাও কর্নেল জহিরের মতামত প্রত্যাখ্যান করে তাঁকে নির্দেশমতো কাজটি সমাধা করার আদেশ দেন। কর্নেল জহির আবারও এক কোম্পানি সেনা ছাড়া এ কাজ করা সম্ভব নয় বলে জানান। জেনারেল রাও উত্তেজিত হয়ে কর্নেল জহিরকে তাঁর দপ্তর থেকে বিদায় করে দেন। কর্নেল জহির সারা দিনই আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করে কিছুটা লুকিয়ে লুকিয়ে থাকেন।

মেজর জেনারেল এ ও মিঠ্ঠা (কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল) একই দিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। কর্নেল জহির জেনারেল মিঠ্ঠার পূর্বপরিচিত ছিলেন। রাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করে তিনি গত দুই দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাপঞ্জি বর্ণনা করেন। সবকিছু শুনে জেনারেল মিঠ্ঠা ২৫ মার্চ সকাল নয়টায় কর্নেল জহিরকে ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সে আসতে বলেন।

পর দিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে আসে ২৫ মার্চ ১৯৭১, বৃহস্পতিবার। এই দিনটির পর থেকে বাঙালির ইতিহাস দ্রুতই ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করবে।

সকাল ৮টা ৩০ মিনিট

ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সে কর্নেল আকবরের (কর্নেল জি এস) দপ্তরে জেনারেল রাওয়ের সঙ্গে কর্নেল জহিরের দৈবক্রমে দেখা হয়ে যায়। আগের কথার সূত্র ধরে তাঁদের মধ্যে বাগিবতণ্ডাও হয়। জেনারেল মিঠ্ঠা সে সময় ছিলেন লে. জেনারেল টিক্কা খানের দপ্তরে। তিনি বেরিয়ে এলে কর্নেল জহির তাঁকে সব কিছু জানান। জেনারেল মিঠ্ঠা কর্নেল জহিরকে তখন নিয়ে যান সেনাবাহিনী-প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খানের কাছে। কর্নেল জহিরের কাছে সব কিছু শুনে জেনারেল হামিদ জেনারেল রাওকে ফোন করে কর্নেল জহিরের সব চাহিদা পূরণের নির্দেশ দেন। কর্নেল জহিরের চলে যাওয়ার আগে জেনারেল হামিদ স্পষ্ট ভাষায় বলে দেন, যাতে শেখ মুজিবের গায়ে একটিও আঁচড় না লাগে। তিনি আরও বলেন, শেখ মুজিবের যেকোনো ক্ষতির জন্য কর্নেল জহির দায়ী থাকবেন।

সকাল ১০টা

কর্নেল জহির জেনারেল রাওয়ের দপ্তরে গিয়ে তাঁর চাহিদা অনুযায়ী তিনটি পাঁচটনি ট্রাক ও শেখ মুজিবের বাড়ির নকশা নেন। শেখ মুজিবের পেছনের বাড়িটি ছিল জাপানি কাউন্সিলরের। অভিযানকালে যাতে কূটনৈতিক কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয়, সেটিও তাঁকে বিবেচনায় রাখতে বলা হয়।

দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট

শেখ মুজিবের বাড়ি ও আশপাশের এলাকার মডেল বানিয়ে কর্নেল জহির কোম্পানি ও প্লাটুন কমান্ডারদের অপারেশনের বিভিন্ন দিক ও কার কী করণীয় তা বুঝিয়ে দেন। ক্যাপ্টেন সাঈদকে দেওয়া হয় শেখ মুজিবের বাড়িতে পৌঁছানোর সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার দায়িত্ব। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় শেখ মুজিবের বাড়ির এক কোনা দিয়ে ঢুকে চারদিকের দেয়াল ঘিরে ফেলার। পেছন দিকের দেয়ালটিকে বেশি গুরুত্ব দিতে বলা হয়, যাতে কেউ সেটি টপকে জাপানি কাউন্সিলরের বাড়িতে চলে যেতে না পারে। ১২ জনের একটি দল নিয়ে মেজর বেলালকে পুরো বাড়ি তল্লাশির এবং শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। দলগুলোকে সন্ধ্যার পর তেজগাঁও বিমানবন্দরের প্রধান ফটকে একত্র হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেখান থেকে রাত ১২টায় যাত্রা শুরু করে ফার্মগেট, আসাদগেট, মিরপুর রোড হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে পৌঁছানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়।

বেলা ৩টা

শেখ ফজলুল হক মনি শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর শয্যাকক্ষে দেখা করেন। কিছুক্ষণ পর লন্ডনের আওয়ামী লীগ নেতা জাকারিয়া চৌধুরী শেখ মুজিবের সঙ্গে একান্তে আলাপ করে যান।

বিকেল ৫টা

তীর-বল্লম-ডামি রাইফেলসহ রায়েরবাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একটি সশস্ত্র মিছিল ৩২ নম্বরে এলে শেখ মুজিব দোতলা থেকে ওদের সালাম গ্রহণ করেন। অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান ও বিখ্যাত পাকিস্তানি সাংবাদিক মাজহার আলী শেখ মুজিবের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন। শেখ মুজিব তাঁদের সম্ভাব্য সামরিক আক্রমণের শঙ্কা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, সে রকম কিছু হলে এর ফল ভালো হবে না। তাতে বহু লোক মারা পড়বে এবং তাঁর কবরের ওপর স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নেবে। বিকেলের মধ্যেই শেখ মুজিব সবাইকে তাঁর বাড়ি থেকে বিদায় দিতে থাকেন। পাঁচটার পর থেকে তাঁর বাড়িতে থমথমে ভাব নেমে আসতে থাকে।

সন্ধ্যা ৭টা

বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে যান।

ক্যাপ্টেন হুমায়ুনকে দুজন কমান্ডোসহ বেসামরিক পোশাকে শেখ মুজিবের বাড়ির আশপাশে লক্ষ রাখার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তেজগাঁও বিমানবন্দরে একটি বোয়িং বিমান চালু করে রাখা হয়। বিমানটি বিকেল চারটায় পাকিস্তান থেকে উড়ে এসেছিল। রাত আটটায় ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে বিমানটি পাকিস্তান উড়ে যায়।

রাত ৮টা

সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এইচ এম কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। শেখ মুজিব জানান, তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার বদলে বরং গ্রেপ্তার বরণ করতে প্রস্তুত আছেন। এরপর রাত সাড়ে আটটায় সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব সৈয়দপুর, রংপুর ও জয়দেবপুরে নিরীহ মানুষ হত্যার প্রতিবাদে ২৭ মার্চ হরতাল ঘোষণা করেন। সংবাদ সম্মেলনের পর অন্য নেতারা শেখ মুজিবের কাছ থেকে বিদায় নেন।

রাত ৯টা

বিমানবন্দরের পেছনের দিকে ছোট ফটকে কমান্ডো কোম্পানি এসে পৌঁছায়। রাত ১০টায় ক্যাপ্টেন হুমায়ুন সংবাদ পাঠান, সাধারণ মানুষ মিরপুরে বেশ কয়েকটি সড়কে প্রতিবন্ধকতা দিয়েছে। এ খবরে কর্নেল জহির পরিকল্পনায় দুটি পরিবর্তন আনেন। যাত্রা শুরুর সময় তিনি ১২টা থেকে এগিয়ে রাত ১১টা করেন এবং কোম্পানির সব রকেট লঞ্চার ক্যাপ্টেন সাঈদের প্লাটুনে জমা করেন। শেখ মুজিবের বড় ছেলে শেখ কামাল বাড়ি ছেড়ে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হন। রাত সাড়ে ১০টায় কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম শেষবারের মতো শেখ মুজিবকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আত্মগোপনের জন্য অনুরোধ করেন।

শেখ মুজিব তাঁদের অনুরোধ উপেক্ষা করেন। তিনি তাঁদের বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন। রাত ১১টায় শেখ মুজিবের সঙ্গে ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজ দেখা করতে আসেন। তাঁদের বিদায় দিয়ে শেখ মুজিব চলে আসেন দোতলায়। জাকারিয়া চৌধুরীর ছোট ভাই ঝন্টু সরাসরি দোতলায় উঠে এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। তিনি আসন্ন আক্রমণের কথা জানিয়ে শেখ মুজিবকে বাসা ছাড়ার জন্য করুণভাবে অনুরোধ করেন। নিরাপত্তার জন্য শেখ মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং জামাতা এম এ ওয়াজেদ মিয়া বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। শেখ মুজিবের সঙ্গে বাড়িতে থেকে যান তাঁর স্ত্রী এবং দুই ছেলে শেখ জামাল ও শেখ রাসেল।

পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন সেনাদল ঢাকা সেনানিবাস থেকে শহরের দিকে এগোতে শুরু করে। পদাতিক বাহিনী, সাঁজোয়া বাহিনী ও গোলন্দাজ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। রাত ১১টায় একটি জিপ ও তিনটি পাঁচটনি ট্রাকসহ কর্নেল জহির যাত্রা শুরু করেন তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে। সামনের জিপটির হেডলাইট জ্বালিয়ে রেখে বাকিগুলোর বন্ধ রাখা হয়, যাতে কেউ গাড়ির সংখ্যা বুঝতে না পারে। মিরপুর সড়কে পৌঁছানোর পর কমান্ডো দল প্রথম সড়ক অবরোধের মুখোমুখি হয়। সেখানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছিল কিছু গাড়ি উল্টে দিয়ে। রকেট লঞ্চার দিয়ে সেখানে ফায়ার করা হলে কয়েকটা গাড়িতে আগুন লেগে যায়। এরপর পাঁচটনি ট্রাকের উইঞ্চ দিয়ে গাড়িগুলো সরিয়ে দিয়ে এগোনোর মতো ফাঁক বের করা হয়। কমান্ডো দল ২০০ গজ এগুনোর পর মুখোমুখি হয় আরেকটি প্রতিবন্ধকতার। সেটি তৈরি করা হয়েছিল দুই ফুট ব্যাসের পাইপ দিয়ে। ট্রাকের উইঞ্চ দিয়ে সেটিও সরিয়ে দিয়ে তারা এগোতে থাকে।

আবদুল মালেক উকিল মাইজদী থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। তাঁর কথা বলার প্রচেষ্টা সফল হয় না। রাত ১১টার পর শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে গোলাগুলি শুরু হয়। গুলির শব্দ পেয়ে রেহমান সোবহান শেখ মুজিবের খোঁজ নেওয়ার জন্য ফোন করেন। তাঁদের মধ্যে কোনো কথা হয় না। তবে তিনি জানতে পারেন, শেখ মুজিব বাড়িতেই আছেন।

রাত ১২টা

কমান্ডো দল আরও ২০০ গজ এগিয়ে শেখ মুজিবের বাড়ির কাছাকাছি এসে তৃতীয় প্রতিবন্ধকতার সামনে পড়ে। এটি ছিল তিন ফুট উঁচু ও চার ফুট প্রস্থ ইটের একটি দেয়াল। কমান্ডোরা ট্রাকের ধাক্কায় দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করে। তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। রাত তখন ১২টা। নষ্ট করার মতো সময় আর নেই। কর্নেল জহির ক্যাপ্টেন সাঈদকে তার প্লাটুনের কমান্ডো দিয়ে ইট সরিয়ে গাড়িগুলো নিয়ে শেখ মুজিবের বাড়ির সামনে আসতে বলেন। বাকি কমান্ডোদের নিয়ে তিনি হেঁটে শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে রওনা হন। রাত সোয়া ১২টায় পরিকল্পনামতো ক্যাপ্টেন হুমায়ুন তাঁর দল নিয়ে শেখ মুজিবের বাড়িতে ঢুকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেন। তাঁদের গোলাগুলিতে একজন পুলিশ প্রহরী মৃত্যুবরণ করেন। বাড়িতে থাকা অন্যান্য বেসামরিক লোকজন ও পুলিশ প্রহরীরা পালিয়ে যান। মেজর বেলালের তল্লাশি দল তল্লাশি শুরু করলে বেসামরিক এক লোক দা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে একজন কমান্ডোকে আঘাত করেন। কমান্ডোরা তাঁকে গুলি করলে তিনি আহত হন।

রাত ১২টা ৩০ মিনিট

নিচতলার পর ওপরতলায় তল্লাশির সময় কমান্ডোরা একটি ঘরে মানুষের আওয়াজ পায়। মেজর বেলাল দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে শেখ মুজিবকে অক্ষত অবস্থায় ঘর থেকে বের করে আনেন। এ সময় দোতলার বারান্দা থেকে কেউ কমান্ডোদের দিকে এক রাউন্ড গুলি করে। গুলি মারার জায়গা লক্ষ্য করে কমান্ডোরা এসএমজির বাস্ট ফায়ার করে, সঙ্গে একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে। কর্নেল জহির শেখ মুজিবকে স্যালিউট করে তাঁকে জানান, তাঁর ওপর শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে। শেখ মুজিব কর্নেল জহিরকে বলেন, ‘গুলি করার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি শুধু আমাকে একটি টেলিফোন করলেই আমি চলে আসব।’ শেখ মুজিবকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

ক্যাপ্টেন সাঈদ ততক্ষণে প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে গাড়িগুলো নিয়ে ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছেছেন।

রাত ১টা

অপারেশন শেষে কর্নেল জহির বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সে তা জানান। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে প্রথমে নির্মীয়মাণ জাতীয় সংসদ ভবনে আনা হয়। এখানে কর্নেল এস ডি আহমদ শেখ মুজিবকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এই ভবনে যেখানে আপনার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রবেশের কথা, সেখানে আপনি কয়েদি হয়ে এলেন।’ সে রাতে শেখ মুজিবকে সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে রাখা হয়। পরদিন জেনারেল মিঠ্ঠার নির্দেশে শেখ মুজিবকে আদমজী পাবলিক স্কুলে আনা হয়। পাকিস্তান পাঠানোর আগে পর্যন্ত শেখ মুজিব এখানেই অবস্থান করেন।

রাত ১টা ৩০ মিনিট

৫৭ ব্রিগেডের বি এম মেজর জাফর বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দেন. ‘বড় পাখিটি খাঁচায় পোরা হয়েছে। অন্যেরা নীড় ছেড়ে ভেগেছে।’ রাত দুটোয় ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল চৌধুরী মোজাফ্ফর আলী খান শেখ মুজিবের বাড়িতে এসে সেখানে তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালান।

২৫ মার্চ ১৯৭১ ইতিহাসের পাতায় চলে গেল। ২৬ মার্চের সূর্যোদয়ের তখনো বেশ কিছু সময় বাকি। ঢাকা শহরসহ সারা দেশে অপারেশন সার্চলাইটের তাণ্ডব তখন চলছে। পাকিস্তানি জেনারেলদের হাতেই পূর্ব পাকিস্তান নামের প্রদেশের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেল। তখন জন্ম নিতে চলেছে একটি নতুন দেশ—বাংলাদেশ।

[email protected]

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৮ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত