বিজ্ঞাপন
default-image

পঁচিশ মার্চের রাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্বরতার আলোকচিত্র ধারণ করেছিলেন বুয়েটের প্রয়াত অধ্যাপক ড. নূরূল উল্লা। এটিই একমাত্র ভিডিও দৃশ্য। তাঁর জবানিতে স্মৃতিচারণ:

সাতই মার্চের পরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কিছু ছেলে এল। ওঁরা বলল, স্যার একটি অয়্যারলেস স্টেশন তৈরি করতে হবে।’ এরপর ওঁরা একদিন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সোফার ওপরে তিনজন বসে ছিলেন। মাঝখানে বঙ্গবন্ধু। তাঁর ডানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বাঁ পাশে তাজউদ্দীন সাহেব। পরিচয় শেষে বঙ্গবন্ধু আমাকে এক কোণে ডেকে নিলেন। বললেন, ‘নূরূল উল্লা আমাকে ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিতে হবে। আমি যাওয়ার বেলায় শুধু একবার আমার দেশবাসীর কাছে কিছু বলে যেতে চাই। আমি শেষবারের মতো ভাষণ দিয়ে যাব।’ ফিরে এসে আমাদের তড়িৎকৌশল বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকের কাছে সব কথা খুলে বললাম। শুরু হলো আমাদের কাজ। তৈরি হলো ট্রান্সমিটার। যদিও এর ব্যবহারের সুযোগ ঘটেনি। এই সঙ্গেই আমার মাথায় ধারণা এল, যদি কোনো হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ বা গোলাগুলি হয়, তাহলে তা আমি ক্যামেরায় তুলে ফেলব এবং সেই থেকেই বিভাগের ক্যামেরাটি আমার সঙ্গে রাখতাম।

২৬ মার্চ সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যবর্তী সময়ে ক্যামেরা চালু করি। জানালা দিয়ে লক্ষ করলাম যে, জগন্নাথ হলের সামনেই মাঠে কিছু ছেলেকে ধরে বাইরে আনা হচ্ছে। এবং তাদেরকে লাইনে দাঁড় করানো হচ্ছে। তখনই আমার সন্দেহ জেগে যায় এবং আমি ক্যামেরা অন করি। দেখলাম একজন বুড়ো দাড়িওয়ালা লোক রয়েছে। সে বসে পড়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছে। তাঁর দাড়ি দেখিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল যে সে মুসলমান। কিন্তু বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী তার কোনো কথাই শুনতে চায়নি।

তাকে গুলি করে মারা হলো। মাঠের পূর্ব পাশে পাকিস্তানি বাহিনী একটা তাঁবু বানিয়ে ছাউনি করেছিল। সেখানে দেখছিলাম, ওরা চেয়ারে বসে বেশ কয়েকজন চা খাচ্ছে আর হাসি-তামাশা ও আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ছে। যাদেরকে আমার চোখের সামনে মারা হয়েছে ও যাদের মারার ছবি আমার ক্যামেরায় রয়েছে, তাদের দিয়ে প্রথমে হলের ভেতর থেকে মৃতদেহ বের করে আনা হচ্ছিল। মৃতদেহগুলো এনে সব এক জায়গায় জমা করা হচ্ছিল এবং ওদেরকে দিয়ে লেবারের কাজ করানোর পরে আবার ওদেরকেই লাইনে দাঁড় করিয়ে এক সারিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মনে হচ্ছিল একটা করে পড়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, প্রায় ৭০-৮০ জনের মৃতদেহ এক জায়গায় জমা করা হয়েছিল।

যুদ্ধকালীন নয় মাস প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত আমার আতঙ্কের মধ্যে কেটেছে। কখন কে জেনে ফেলে, কখন আমি ধরা পড়ে যাই বা কখন এটা এসে নিয়ে যায়—এমনি মানসিক যন্ত্রণায় আমি ভুগছিলাম।

সূত্র: বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১১ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত