বিজ্ঞাপন
default-image

ভূমিকা

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ২৫ মার্চের আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখে বাঙালি প্রথমে হতচকিত হয়ে পড়লেও দ্রুত তারা সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিক, বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী। এই প্রতিরোধের ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মাত্র তিন দিনে গোটা বাংলাদেশ করতলগত করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। জনগণ শুধু বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধই করেনি, কয়েকটি এলাকা থেকে তাদের তাড়িয়েও দেয়।

এ রকম একটি এলাকা চুয়াডাঙ্গা। এখানকার জনগণ কীভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তার বিবরণ থাকছে এই রচনায়। সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন রচিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র এ ধরনের মানুষদের অন্বেষণ করে তাঁদের সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেছিল। তার একটি সম্পাদনা করে এখানে প্রকাশ করা হলো। ১৯৭১ সালে ডা. আসহাবুল হক চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এমপিএ নেতা ছিলেন।

গ্রন্থনা ও সম্পাদনা: তারা রহমান

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সকাল থেকে আমরা চুয়াডাঙ্গার নেতারা খুব ব্যস্ত ছিলাম। সেদিন এখানে একটি সভা হয়েছিল। সেখানে কুষ্টিয়ার এসপিসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতা উপস্থিত ছিলেন। কাজ শেষে অনেক রাতে বাসায় ফিরে খেয়ে রাত দুইটার দিকে আমি বিছানায় গিয়েছিলাম। এই সময় কলবেল বেজে উঠলে বেরিয়ে দেখি, আবদুল আজিজ। তার কাছে শুনলাম, কুষ্টিয়া পুলিশের ওয়্যারলেস থেকে খবর এসেছে চুয়াডাঙ্গায়। পাকিস্তানি আর্মি যশোর থেকে কুষ্টিয়ায় এসে পুলিশ লাইনকে সারেন্ডার করতে বলছে। তখন প্রশাসনিক সদর দপ্তর কুষ্টিয়া হলেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল চুয়াডাঙ্গা। আমার মনে হলো, চুয়াডাঙ্গাও আক্রান্ত হতে পারে। এ অবস্থায় সবাইকে খবর পাঠিয়ে আমি রাতে বাসায় না থেকে শহরের বাইরে চলে গেলাম। সকালে খোঁজ নিয়ে জানলাম, চুয়াডাঙ্গায় পাকিস্তানি সেনা আসেনি।

সকাল নয়টার দিকে শহরে ঢুকেই লক্ষ করলাম, লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত। তবে সবার মাঝে উত্সুক্যও আছে। দেখলাম, বাংলাদেশের পতাকার সংখ্যা যেন কিছু কমে গেছে। আমার কর্মীসহ যাঁদের সঙ্গে দেখা হলো তাঁদের বললাম, পার্টি অফিসের সামনে সবাই এসো। তখন আমাদের পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইউনুস আলী। আমি ছিলাম সভাপতি। সহসভাপতি আবুল হাশেম, শহর সম্পাদক মির্জা সুলতান রাজা। আমি ওদের বললাম, মাইক দিয়ে বাজারের ভেতরে লোক ডাকো। এখনই মিটিং শুরু হবে।

কিছুক্ষণের মধ্যে চৌরাস্তার মোড়টা মানুষে-মানুষে ভরে গেল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেটা থানাসংলগ্ন জায়গা। থানার দিকে তাকিয়ে দেখছি পাকিস্তানি সেনারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সভায় শুধু আমিই বক্তব্য রাখলাম। উপস্থিত জনতাকে বললাম যে ৭ মার্চ শেখসাহেব আমাদের বলেছেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। এটা একটা পথ। অথবা আর একটা পথ আছে, সেটা হচ্ছে আত্মসমর্পণ করা। যদি আমরা আত্মসমর্পণ করি, তাহলে বাংলাদেশে নারী-পুরুষ সব ক্রীতদাস হয়ে যাবে। আর যদি এটাকে মোকাবিলা করতে যাই, চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে যাই, তাহলে আমাদের জীবন শুধু নয়, সর্বস্ব দিয়ে আমাদের পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করার জন্য তৈরি থাকতে হবে। এ অবস্থায় আপনারা রায় দেন, আমরা কী করব? আমি রাজনীতি করেছি আপনাদের সঙ্গে নিয়ে। তখন শ্বাসরুদ্ধকর একটা অবস্থা। মানুষ উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। আমি বারবার জিজ্ঞেস করছি।

মাঝখানে এক লোক উঠে দাঁড়ালেন। তাঁকে আমি চিনি না। তাঁর গায়ে যে পোশাক তাতে বোঝা যায় তিনি ক্ষেতমজুর নন, আবার বড় জমির মালিকও নন। সেই লোক দাঁড়িয়ে আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় একটা কথা বললেন, ‘একবার রুখে দাঁড়ান গো মিয়া।’ সত্যি কথা বলতে কি, আমিও এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আমি বললাম, আপনারা কি সবাই শুনেছেন? উনি বলছেন রুখে দাঁড়ানোর জন্য। এর বিরুদ্ধে যদি কেউ থাকেন তো বলেন। কিন্তু কেউ কিছু বললেন না। তখন আমি বললাম, ওনার রায়ের ওপর আমি এখানে দাঁড়িয়ে আজকে আপনাদের সাক্ষী রেখে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। আপনারা নিজ নিজ গ্রামে যাঁরা যেখানে ফিরে যাবেন, তাঁদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনাদের গ্রামে যারা আনসার আছে তাদের পাঠিয়ে দেন চুয়াডাঙ্গায়। ট্রেন্ড মুজাহিদ যাঁরা আছেন, তাঁদের পাঠিয়ে দেন চুয়াডাঙ্গায়। মিটিং এখানেই শেষ।

এদিকে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, কুষ্টিয়ায় তো পাকিস্তানি সেনারা চলে এসেছে। এখন চুয়াডাঙ্গা কীভাবে মুক্ত রাখা যায়। এরপর পার্টি অফিসে গেলাম। সেখানে কয়েকটি মোটরসাইকেল দেখতে পেলাম। তার একটি ঝিনাইদহ রোডে, আর একটি মেহেরপুর রোডে পাঠালাম। তাদের বললাম, তোমরা এখান থেকে যেতে যেতে আশপাশের প্রতিটি গ্রামের মানুষকে ডেকে গাছের ডাল কেটে রাস্তা বন্ধ করে দিতে বলো। আর দুটি মোটরসাইকেলের মধ্যে একটিকে উত্তর ও পূর্ব আর অন্যটিকে দক্ষিণ ও পশ্চিমে পাঠালাম। তাদের কয়েকটি গ্রামের নাম জানিয়ে বললাম, তোমরা গ্রামগুলো ঘুরে ইমিডিয়েটলি আনসারদের চুয়াডাঙ্গায় চলে আসতে বলো। আমাদের আহ্বানে আনসার-মুজাহিদরা টাউন হলে আসতে লাগল। সেখানে তাদের জন্য রান্নারও ব্যবস্থা হলো।

দুপুরের দিকে আমার মোটরসাইকেল নিয়ে বের হলাম রাস্তায় গাছ ফেলা হয়েছে কি না দেখার জন্য। এরপর আওয়ামী লীগের অফিসে এসে শুনলাম, চুয়াডাঙ্গা ইপিআর উইংয়ের বাঙালি কমান্ডার মেজর ওসমান আমার কাছে লোক পাঠিয়েছিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে গেলাম। যেতেই তিনি বললেন, ‘আপনাকে আমি পাইনি, কিন্তু একটা কাজ করে ফেলেছি।’ এরপর ইংরেজিতে বললেন, ‘আমি অফিসারদের একটি সভা ডেকেছি।’ আমি তাঁকে স্বাগতম জানিয়ে বললাম, এটা খুব ভালো করেছেন। তিনি বললেন, মিটিংয়ের তো সময় হয়ে গেছে। আমি বললাম, চলেন। সেই মিটিংয়ে আমি ছাড়াও আমাদের দলের আরও কয়েকজন গেলেন।

মিটিংয়ে মেজর ওসমান আমাকে বললেন, আপনি আমাদের সিনিয়র। আমাদের করণীয় কী আপনি বলুন। আমি তাঁদের বললাম, আমরা সকাল নয়টা ৩০ মিনিটে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছি। এখন থেকে মেজর ওসমান আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান। তিনি সবার ওপরে। আনসার, পুলিশ, ইপিআর, মুজাহিদ সবার তিনি প্রধান। সরকারি কর্মচারীদের বললাম, আপনারা যাঁরা সরকারি কর্মচারী আছেন, তাঁদের জন্য একটা অপশন আছে। যাঁরা পাকিস্তানের পক্ষে অপশন দিতে চান দিতে পারেন। কিন্তু সে রকম কেউ ছিল বলে মনে হলো না। ওসমান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কি সরকার গঠন করবেন?’ আমি বললাম, না, আমরা একটা কর্মীবাহিনী গঠন করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে চাই। ওসমান বললেন, ‘আপনি আমাকে বাহিনীর প্রধান করেছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বে আপনি আছেন। একটা উপদেষ্টা কমিটি হোক এবং আপনি তাঁর প্রধান উপদেষ্টা হন। আপনার কাছ থেকেই আমার নির্দেশনা নিতে হবে।’

মিটিং শেষ হতে শেষ বিকেল হয়ে গেল। তখন ওসমান ইপিআর জওয়ানদের একটা বিশেষ জায়গায় ব্যারিকেড দিতে বললেন। চুয়াডাঙ্গায় আসার পথে একটা কালভার্টের মুখে জলাভূমি আছে, সেখানেও ব্যারিকেড দেওয়ার জন্য আমি কয়েকজনকে বললাম। এভাবে আমাদের ২৬ তারিখের কাজ শেষ হলো। ২৭ তারিখ সকালবেলা আমরা আবার একত্র হলাম ইপিআরের উইং হেডকোয়ার্টারে। ওখানে সেদিন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হলো আনুষ্ঠানিকভাবে। আমি এবং ওসমান দুজন পতাকা উঠিয়ে দিলাম। পাশাপাশি ওখানে পশ্চিম পাকিস্তানের জওয়ান যারা ছিল, তাদের আমরা আটক করে রাখলাম। এ কাজ করতে তেমন বেগ পেতে হলো না। অপারেশনাল হেডকোয়ার্টার করা হলো ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড ডাকবাংলোয়। প্রথমেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কুষ্টিয়াকে মুক্ত করতে হবে। এর মধ্যে মেহেরপুর-ঝিনাইদহে টেলিফোন করে আমি বলেছি তারা যেন রাস্তার দিকে নজর রাখে। আমাদের তখন কাজ হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বেশিসংখ্যক আনসার মুজাহিদ জোগাড় করা। সবাইকে তাঁদের খুঁজে নিয়ে আসতে বললাম। সন্ধ্যায় আমরা একটা পর্যালোচনা সভায় বসলাম। সেখানে মেজর ওসমান ও ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী একটা কর্মপরিকল্পনা পেশ করলেন। আমরা সেটা গ্রহণ করলাম। ২৮ তারিখ সকাল থেকে ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়ে আমাদের যে বাহিনী তার কর্মকাণ্ড শুরু হলো। ইপিআর ছাড়া অন্যদের কাছে থ্রি নট থ্রি রাইফেল ছিল। আর ইপিআরদের কাছে রাইফেল ছাড়াও কিছু অটোমেটিক গান এবং ট্যাংকে আঘাত হানার মতো একধরনের বিশেষ অস্ত্র ছিল। টু ইঞ্চি বা থ্রি ইঞ্চি মর্টার লঞ্চারও তাদের বোধহয় দু-তিনটা ছিল।

সে সময় আমাদের আনুষঙ্গিক সুবিধাদি খুব কম ছিল। কিন্তু আমাদের জনসমর্থনের অভাব ছিল না। ২৮ তারিখ সকাল থেকে কুষ্টিয়া অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হলো। বিকেলে চুয়াডাঙ্গা থেকে ট্রাকে করে আমাদের বাহিনীকে কুষ্টিয়ার দিকে পাঠালাম। আমরা চিন্তা করলাম, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যদি পথে আমাদের বাহিনীর দেখা হয়ে যায়, তাহলে এরা সব ধ্বংস হয়ে যাবে। সুতরাং আমরা মেহেরপুর-ঝিনাইদহের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে ক্যানেলের ধার দিয়ে যে রাস্তা ছিল, সে রাস্তা দিয়েই তাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। রাজশাহীর বিপরীত দিকে অর্থাত্ পদ্মা নদীর দক্ষিণ অঞ্চল থেকে শুরু করে একদম মেহেরপুর পর্যন্ত অনেক বর্ডার আউট পোস্ট বা বিওপি আছে। সেগুলোতে আমরা ওয়্যারলেসে বার্তা পাঠালাম যে স্থানীয় আনসারদের হাতে বিওপি হ্যান্ডওভার করে দিয়ে তোমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওখানে চলে এসো।

পাশাপাশি আর একটা দায়িত্ব—খাওয়াদাওয়া এবং যুদ্ধে কেউ আহত হলে চিকিত্সার ব্যবস্থা করা। চিকিত্সার ব্যবস্থা সেদিন পুরো করা গেল না। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমরা মনে করলাম, ওখানকার স্থানীয় লোকের ওপর কিছু দায়িত্ব দিতে হবে। কুষ্টিয়ার আইনুল ইসলাম আর আবদুর রউফ চুয়াডাঙ্গা এসেছিলেন। আইনুল ইসলামকে আমি তখনই মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে বললাম কুমারখালীতে। ওখানে এমপিএ কিবরিয়া সাহেব ছিলেন। তাঁর কাছে খবর পাঠালাম। কারণ আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল। সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের ওয়্যারলেস সেন্টার ছিল।

কিবরিয়া সাহেবকে খবর পাঠালাম, তারা যেন স্থানীয় আনসার ও পুলিশদের নিয়ে সেখানে আক্রমণ করেন। তাঁকে আরও বললাম, এ জন্য পাঁচ মিনিট সময় পাওয়া যাবে। কারণ, ওয়্যারলেস বার্তাটা ওখানকার পাকিস্তানি সেনারা যদি দিতে পারে, তাহলে ভীষণ একটা ঝুঁকির মুখে আমরা পড়ব। অন্যদিকে আবদুর রউফ চৌধুরীকে পাঠালাম বারোখাদায়। সেটা জংশন পয়েন্ট। ওখানে একটা রাস্তা মেহেরপুর থেকে কুষ্টিয়া গেছে। আর একটা রাস্তা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওদিক দিয়ে ঘুরে কুষ্টিয়া এসেছে। বারোখাদায় একটা স্কুল আছে। আমি আবদুর রউফ চৌধুরীকে বললাম, ওই স্কুলে ডাল-ভাত-খিচুড়ি যা পারো রান্না করে আমাদের যোদ্ধাদের খাওয়াও। দুই নম্বর হচ্ছে, যোদ্ধারা অবস্থান নেবে পোড়াদহে। তাকে বলা হলো পোড়াদহের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে। ওখানে অপারেশন কমান্ডার হিসেবে গেছেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী। এসব করে আমি হেডকোয়ার্টারে থাকলাম।

কুষ্টিয়া মুক্ত করার জন্য আমাদের বাহিনীকে পাঠানোর পর আমি একটুখানি আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে একটা কাজ অন্তত করা গেল। যুদ্ধের ৬০ ভাগ হয় যুদ্ধক্ষেত্রে, বাকিটা প্রচারণা। মিডিয়ার মাধ্যমেও যুদ্ধ করতে হয়। তা ছাড়া যুদ্ধে জেতা যায় না। এই দীক্ষাটা আমি পেয়েছিলাম আমার রাজনৈতিক গুরু এম এন রায়ের কাছ থেকে। তখন মনে হলো, এখন আমাদের বহির্বিশ্বে যোগাযোগ করা দরকার। চুয়াডাঙ্গা কৌশলগতভাবে তখন একটা ভালো অবস্থানে ছিল। সে সময় চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়েই কলকাতার টেলিফোন লাইনটা ছিল। ভাবলাম, এ লাইনটা আমরা যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করতে পারি। অবশ্য এ বুদ্ধিটা আমাকে দিয়েছিল টেলিফোন বিভাগেরই কয়েকজন কর্মী। তারপর এক্সচেঞ্জের অফিসারকে ডেকে বললাম, আমাকে কলকাতার কারও সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে দেন। তাঁরা কাজে নেমে পড়লেন। ২৯ তারিখ ঠিক নয়টা ২৫ মিনিটে আমার টেলিফোন বাজল। ধরার পর অপারেটর বলল, ‘স্যার, কলকাতায় কার সঙ্গে কথা বলবেন?’

এদিকে চুয়াডাঙ্গা থেকে ফোন পেয়ে কলকাতা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিসে হইচই পড়ে গেছে। সবাই বলছে, জয় বাংলা থেকে ফোন এসেছে। আমি তাদের সব কথা টেলিফোনে শুনছি। আমার মনে হলো, আমি তো ইচ্ছা করলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয়বাবুর সঙ্গেই কথা বলতে পারি।

অজয় মুখার্জির সঙ্গে আমার একটা পরিচয় ছিল। তিনি আমাকে চিনতেন। আমি কলকাতা এক্সচেঞ্জকে বললাম, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। তারা কিছুক্ষণ চেষ্টার পর অজয়বাবুর সঙ্গে সংযোগ করে দিল। আমি তাঁকে বললাম, আমি জয় বাংলা থেকে বলছি। তিনি খুব অবাক হয়ে গেলেন। তাঁকে আরও বললাম, আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। আমি আপনার মাধ্যমে কলকাতাসহ গোটা ভারতের রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবীদের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি সাহায্যের জন্য। আমরা রাজনৈতিক সমর্থন চাই। তাঁর সঙ্গে কথা শেষ করেই কলকাতা এক্সচেঞ্জকে বললাম, গৌর কিশোর ঘোষ বলে একজন সাংবাদিক আছেন, তাঁর টেলিফোন নম্বর আমি জানি না। যেখানেই তাঁকে পাওয়া যাক, আপনারা তাঁর সঙ্গে আমাকে একটু যোগাযোগ করে দেন।

সে সময় কলকাতা এক্সচেঞ্জে যারা কাজ করছিল, তাদের কাছে সত্যিই আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব। তারা তার সঙ্গেও যোগাযোগ করিয়ে দিল। গৌর কিশোর ঘোষের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। গৌর তখন বিখ্যাত সাংবাদিক, আনন্দবাজার গ্রুপের সঙ্গে জড়িত। সে তো আমার টেলিফোন পেয়ে খুব অবাক। তাকে বললাম, তোমাকে একটা কাজ দিচ্ছি, এই কাজটা করতে হবে। সে বলে, কী? আমি বললাম, ওখান থেকে দৈনিক চারজন করে সাংবাদিককে চুয়াডাঙ্গায় পাঠাতে হবে। তাঁদের নাম একটা কাগজে লিখে তুমি সই করে দেবে, যাতে আমরা বুঝতে পারি।

গৌর এ ব্যবস্থা করেছিল ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। সে নিজেও এক দিন এসেছিল। শফিউদ্দীন নামে ওয়াপদার একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন এখানে। তিনি চুয়াডাঙ্গা কলেজের প্রিন্সিপাল ফুলে হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে দর্শনা সীমান্তে গিয়ে সাংবাদিকদের নিয়ে আসতেন। আমার বাড়িতে একটা সংবাদ সম্মেলনের জায়গার ব্যবস্থা করেছিলাম। সেখানে তাঁরা অপেক্ষা করতেন। তাঁরা প্রশ্ন করতেন আমাকে। যেটা উত্তর দেওয়ার সেটা আমি দিতাম। যেদিন চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলা হয়, সেদিন অনেক বিদেশি সাংবাদিক এখানে এসেছিলেন। ফ্রান্স টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান ও সাংবাদিকও ছিলেন। তাঁদের তোলা ছবি বিদেশি টেলিভিশনে প্রচারিত হয়।

২৯ তারিখ সারা দিন এভাবে কেটে গেল। এর মধ্যে ফিল্ড টেলিফোনও স্থাপন করা হলো। সেই ফিল্ড টেলিফোনের অপারেটর ছিল জয়নাল। তার সঙ্গে একটা হিন্দু ছেলে ছিল। ৩০ মার্চ সকাল বেলা খবর পাওয়া গেল, ২৯ মার্চ বারোখাদায় আমাদের যে বাহিনীর পৌঁছানোর কথা ছিল তারা সেখানে সময়মতো পৌঁছায়নি। সীমান্ত এলাকায় যত ইপিআর ছিল, তারা সবাই এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেনি। কাজেই অপারেশনটা পিছিয়ে দিতে হয়েছে। ফলে একটা দিন আমরা সময় পেলাম। এ সময় আমার মনে আর একটা ভাবনা এল। যদি আমাদের ছেলেরা কেউ আহত হয়, তাহলে তাদের চিকিত্সার ব্যবস্থা করা দরকার। এ ব্যবস্থা আমরা প্রথমে পুরোপুরি করতে পারিনি। ভাবলাম, এখন করা যায়। চুয়াডাঙ্গা থেকে তিনজন চিকিত্সককে কিছু গজ, ব্যান্ডেজ এবং ওষুধপত্র অর্থাত্ ফার্স্ট এইডের জিনিসপত্র দিয়ে আর একটা দল বারোখাদায় পাঠালাম। তাদের গ্রুপ লিডার হিসেবে থাকলেন ডা. শামসুজ্জোহা কোরেশী। তাঁর সঙ্গে থাকলেন ডা. আফিল উদ্দীন এবং ডা. এম আর জোয়ারদার। তাঁদের পাঠিয়ে দিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, আর কী কী হতে পারে বা ঘটতে পারে।

৩০ মার্চ ভোররাতেই আমাদের যোদ্ধারা কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আমাদের একটি দল তাদের ওপর আক্রমণ করে। পরে তাদের সঙ্গে মেহেরপুর থেকে আসা যোদ্ধারা যোগ দেয়। আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল আমাদের যোদ্ধাদের পেছনে হাজার হাজার লোক থাকবে। তারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সশস্ত্র যোদ্ধাদের অনুসরণ করবে। আমি আইনুল আর আবদুর রউফ চৌধুরীকে বলেছিলাম, তোমরা এই যোদ্ধাদের পেছনে জনসমর্থন জোগাড় করবে প্রতিটি জায়গায়। আর যোদ্ধাদের বলেছিলাম, ওখানে গেলে অজস্র লোক তোমাদের সঙ্গে থাকবে। তোমাদের একজনের সঙ্গে ১০, ২০, ২৫, ৫০—যত পারো লোক নেবে। একটা করে গুলি হবে আর ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ আওয়াজ হবে, স্লোগান হবে। প্রতিটি জায়গায় এই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। আমাদের যুদ্ধের মূল হাতিয়ার সেদিন ছিল সেটাই।

ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী তাঁর বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেন কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর। নায়েক সুবেদার মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে একদল যোদ্ধা কুষ্টিয়া মোহিনী মিলে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওয়্যারলেস টিমের ওপর আক্রমণ করে। অপর দল আরেক দিক থেকে। তিন দিকের আক্রমণে এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে পাকিস্তানি বাহিনী বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। পুলিশ লাইন এবং মোহিনী মিলে বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এরপর তারা জিলা স্কুলে সমবেত হতে চেষ্টা করে।

৩১ মার্চ আমাদের যোদ্ধারা চারদিক থেকে জিলা স্কুলে আক্রমণ করে। সারা দিনের যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর অনেকে হতাহত হয়। বাকিরা পালাতে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়ে। তার মধ্যে এক অফিসার ছিল। তার নাম সম্ভবত আতাউল্লা শাহ। যোদ্ধারা তাকে আমার কাছে নিয়ে আসে। তার কাছে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা এত আধুনিক অস্ত্র নিয়ে হারলে কী করে? তখন সে বলেছিল, ‘আমরা দেড় শ লোক ২০ হাজার লোকের বিরুদ্ধে কী লড়াই করতে পারি!’ তার মানে হচ্ছে, ওই যে একটা করে গুলি আর একটা করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান হয়েছে, সারা কুষ্টিয়া শহর সেই স্লোগান শুনতে পেয়েছে। এতেই পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছে। তারা যুদ্ধ তো দূরের কথা, কোনো প্রতিরোধই করতে পারেনি। এভাবে আমরা কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত করলাম। ১ এপ্রিল কুষ্টিয়ামুক্ত হলো। আমাদের মনোবল আরও বেড়ে গেল।

(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)

সুত্র: ২৬ মার্চ ২০০৯ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত