২৬ মার্চ থেকে ৬ ডিসেম্বর; একাত্তরে এর মাঝে সময় চলে গেছে আট মাসেরও বেশি। স্বাধীনতার ঘোষণার পর এই সময়ে মুক্তির জন্য যুদ্ধ যেমন দিনে দিনে জোরদার হয়েছে, দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতাও বেড়েছে। কোটি খানেক শরণার্থী দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে পাশের দেশ ভারতে। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠনের পর এই সরকারের নেতৃত্বেই পরিচালিত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ। সীমান্ত তখন মিলেমিশে একাকার। শরণার্থীশিবির, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ—সবই চলছে ভারতের সীমান্ত ঘিরে। অনানুষ্ঠানিকভাবে কলকাতার ৮, থিয়েটার রোডে পরিচালিত হতো অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়। ৩ ডিসেম্বর যখন সরাসরি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, পরিস্থিতি পাল্টাল দ্রুতই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহাঘ্য-সহযোগিতা ও সমর্থন সবকিছু থাকলেও তখনো আইনগতভাবে ভারতের স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশ নামের কোনো দেশ। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অর্থ বিষয়টিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবেই দেখার মতো। ভারতের সেনাবাহিনী কোন ভূ-খণ্ডে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছে—পাকিস্তানের, না বাংলাদেশের?
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরুর পরদিনই ৪ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে চিঠি লিখলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার দেশের বিরুদ্ধে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সরাসরি আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আপনাকে জানাতে চাই যে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী যেকোনো সেক্টর ও ফ্রন্টে বাংলাদেশে পাকিস্তানের আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্ত্তত রয়েছে। আমরা যদি আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তবে পাকিস্তানের সামরিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের যৌথ অবস্থান আরও জোরদার করা সম্ভব। এই পরিস্থিতিতে আমরা আবারও আমাদের দেশ ও সরকারকে ভারত সরকারের স্বীকৃতির জন্য আপনার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।’ বাংলাদেশের এই অনুরোধের প্রতি ইন্দিরা গান্ধী সাড়া দিলেন এভাবে—
‘আমি পার্লামেন্টে এই তথ্য দিতে পেরে আনন্দিত যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং বাংলাদেশ সরকারের বারবার করা অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারত সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ ভারতের পার্লামেন্টে একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর দেওয়া এই বিবৃতির পর ইন্দিরা গান্ধী সেই দিনই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে লেখা এক চিঠিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা জানিয়ে দেন। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অন্য কোনো দেশের স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ। তারিখটি ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, স্বীকৃতিদাতা দেশটি ভারত।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন জানানো হয়েছিল বাংলাদেশের অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠন হওয়ার পরপরই। ভারতের স্বীকৃতির জন্য দাবি উঠেছিল দেশটির ভেতর থেকেও। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল একাত্তরের মে মাসেই। ‘বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় স্বাধীনতার জন্য মরণপণ সংগ্রামের প্রতি ভারতের আশু ও জরুরি কর্তব্যের কথা বিবেচনা করিয়া এই বিধানসভা ভারত সরকারের নিকট দাবি জানাইতেছে যে, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও তাহার সরকারকে স্বীকৃতি এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় কার্যকরী সাহাঘ্য দিতে হইবে।’ একাত্তরের ৮ মে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী এই প্রস্তাব আনলে সর্বসম্মতিতে এই প্রস্তাব পাস হয়। ভারত সরকার এ জন্য অপেক্ষা করেছে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
‘মে মাসের মাঝামাঝি, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের পশ্চিম বাংলা ও উত্তর-পূর্বে আশ্রয় নিতে আসা শরণার্থীদের সংখ্যা বাড়তে লাগল বানের বেগে। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ৫৫ থেকে ৭০ লাখ শরণার্থীর কারণে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং পশ্চিম বাংলা ভীষণ জনসংখ্যার চাপে পড়ে যায়। এই রাজ্যগুলোতে সম্পদের সংকট দেখা দেয়। তার পরও পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য সাধারণ সমর্থন অব্যাহত রইল, কিন্তু স্বাধীনতাযুদ্ধকালে কূটনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেকোনো পদক্ষেপের ব্যাপারেই ভারত ছিল সদা সতর্ক। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়তা এবং প্রতিরোধ আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে গেলেও ভারত কিন্তু তখনো মুজিবনগর সরকারকে কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি।’ ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব জে এন দিক্ষিত এই কথাগুলো লিখেছেন তাঁর লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড: ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশান বইতে (ইউপিএল, ১৯৯৯)। মুক্তিযুদ্ধে সব সাহাঘ্য-সহযোগিতার পরও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে কেন সময় নিল ভারত, তার জবাবও তিনি দিয়েছেন তাঁর বইতে। ‘মিসেস গান্ধীর প্রারম্ভিক এবং সহজাত প্রতিক্রিয়াই ছিল বাংলাদেশকে মুক্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান এবং সেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে সেনাবাহিনী পাঠানো। যাহোক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্মরণ সিং এটাও মাথায় রেখেছিলেন যে এর বিশ্বাসযোগ্যতা ও রাজনৈতিক নিভুর্লতা যেন কখনোই প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। স্মরণ সিংয়ের মাথায় ছিল, ভারতকে যেন কখনোই বড় কোনো পরাশক্তি বা জাতিসংঘের সামনে কোনোরকম দোষারোপের দায় নিয়ে দাঁড়াতে না হয়, যাতে তারা কখনোই বলতে না পারে, ভারত প্রতিবেশী একটি দেশের ব্যাপারে অযাচিত নাক গলিয়েছে, দেশটিকে বিভক্ত করেছে কিংবা ধ্বংস করেছে আঞ্চলিক সুসম্পর্ক।’
৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের শুরু, ৪ ডিসেম্বর ভারতের স্বীকৃতি চেয়ে আবার ইন্দিরা গান্ধীর কাছে অনুরোধ, ৬ ডিসেম্বর প্রত্যাশিত স্বীকৃতি—এমন অবস্থায় কী চলছিল মুজিবনগর সরকারে, তার বিবরণ পাই অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ফারুক আজিজ খানের স্পি্রং ৭১ (ইউপিএল, ১৯৯৮) বইতে। ‘৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর প্রায় তিন দিন কেটে গেছে। ভারতের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্বীকৃতি চেয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ৪ ডিসেম্বর চিঠি লিখেছেন। অবশেষে ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশ সরকারকে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বীকৃতি দিল। বিকেল নাগাদ যখন রেডিওতে এ খবর শোনা গেল, তখন আমরা যাঁরা কয়েকজন তখনো আমাদের অফিস প্রাঙ্গণে ছিলাম, তখন তাঁদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের তথ্য কর্মকর্তা আলী তারেক ও কয়েকজন উৎসাহী তরুণ তড়িঘড়ি করে ৮ থিয়েটার রোডের মূল ভবনে বাংলাদেশের একটি পতাকা ওড়ালেন। এ সময় গগনবিদারী বিজয়ের স্লোগান উঠল সেখানে। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সচিবালয়ে লাল-সবুজের পতাকা উড়ল। তখন উত্তর দিক থেকে শান্ত বাতাস বইছিল।’
১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের আগে স্বীকৃতি মিলেছিল দুটি দেশের কাছ থেকে। ভারতের পর ভুটানের স্বীকৃতি পাওয়া যায় ৮ ডিসেম্বর। বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তান’ যুদ্ধের পরিচিতি থেকে মুক্তি দিয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি, করেছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর কমান্ডের কাছে।
২২ মার্চ, ২০১১, ঢাকা
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১১ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত