বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশ এখনো অতীতের সঙ্গে ফয়সালা করে ওঠেনি আর অতীতও কখনোই তাকে ছেড়ে যায়নি। যে সমাজে মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং যেখানে বিশালসংখ্যক মানুষ তার শিকার হয়েছে, এমন সন্ত্রস্ত সমাজে অতীতের বিষয় নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু করা এক জটিল ব্যাপার। অতীত সেখানে বর্তমান ও ভবিষ্যেক তাড়া করে ফেরে। এ রকম এক ক্ষতবিক্ষত সমাজের পক্ষে সম্ভব নয় অতীতের ক্ষত ভুলে যাওয়া বা যারা দায়ী তাদের ক্ষমা করা। তা তখনই সম্ভব, যখন অতীতের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার পথ বের করা হয়। কিন্তু প্রায় চার দশকে পা দেওয়া বাংলাদেশ তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। একজন খ্যাতনামা বিশ্লেষকের ভাষায় বললে, এটাই বাংলাদেশের ‘আদি পাপ’।

সামাজিক নিপীড়নের কিছু অন্তর্নিহিত লক্ষণ রয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মগুলোকেও তা পীড়িত করতে থাকে। খুবই ভুল হবে যদি ভাবা হয় যে সরাসরি নির্যাতিতদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে তাদের উত্তরসূরিদের মধ্যে আতঙ্কের ঘোর, যাতনা, দুঃখ কিংবা হাহাকার কমতে থাকবে। তা হয় না। একমাত্র অপরাধের ‘সুবিচারই’ যাতনার নিষ্কাশন ঘটানোর নিশ্চয়তা দেয় এবং বাংলাদেশের এখন সেটাই দরকার।

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চালচলন দেখে মনে হচ্ছে যে তারা দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যাখ্যাত হওয়া ১৯৭১ সালের অপরাধের বিচার শুরুর প্রক্রিয়া হাতে নিচ্ছে না। তা হলে বলতে হবে যে আগেকার সরকারগুলোর মতো এই সরকারও সাময়িক রাজনৈতিক সুবিধার জন্য একাত্তরের ভাবাবেগকে ব্যবহার করতে চাইছে। অথচ এই সরকারের দুই মূল কারিকাশক্তি প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধান তাঁদের শাসনের গোড়াতেই জনগণের মধ্যে একাত্তরের অপরাধের সুবিচারের বিরাট আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছিলেন। তাঁদের কথায়, জনগণের মধ্যে চাপা থাকা আবেগ ও কষ্টের অনুভূতির ঝরনা কপাট খুলে ঢলের মতো বেরিয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে অনেকের মধ্যে আশা জেগেছে যে এবার বোধহয় দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তরা সুবিচার পাবে।

একাত্তরের অপরাধ

কীভাবে কেবল ‘যুদ্ধাপরাধ’ ও ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ প্রসঙ্গই একাত্তরের একমাত্র প্রসঙ্গ হয়ে উঠল, তার অর্থ উদ্ধার করা খুবই কঠিন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই হোক বা আর যা-ই হোক, সব সংগঠন, সংবাদপত্র, অন্যান্য গণমাধ্যম এবং এ-বিষয়ক আলোচনায় ‘বিশেষভাবে’ যুদ্ধাপরাধের ওপরই জোর দেওয়া হয়। ব্যাপারটা যেন এ রকম যে ১৯৭১ সালে কেবল যুদ্ধাপরাধ ছাড়া আর কোনো অপরাধের ঘটনা ঘটেনি! বাংলাদেশে এখন কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য রব ওঠা এবং কেবল এর ওপরই নজর থাকার ফলে অভিযুক্ত ও দোষীদের অনেকেই আইনের খুঁটিনাটির মধ্যে যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা নিয়ে ঘোরপ্যাঁচ খেলার সুযোগ পাচ্ছে।

বাস্তবে একাত্তরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় যে অপরাধটি ঘটেছিল সেটি যুদ্ধাপরাধ নয়, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। পৃথিবীতে এর তুল্য জঘন্য অপরাধের কথা আর জানা নেই। ১৯৭১ সালে নাগরিকত্ব, জাতীয়তা, বর্ণ ও ধর্ম পরিচয়ই যুদ্ধের শিকারদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরেরা অভিসন্ধিমূলকভাবেই বাঙালিদের নৃতাত্ত্বিক ও জাতিগত পরিচয়কে নিশানা করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বাঙালিদের ধ্বংস করা। আর ধর্মের জন্য বিশেষভাবে নজর ছিল হিন্দু বাঙালিদের প্রতি। কখনো যদি তদন্ত করে অপরাধের প্রকৃতি উন্মোচিত হয় এবং তা যদি আইনের খাপের মধ্যে মিলিয়ে দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে, এ অপরাধ ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশন এবং ১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্টে বর্ণিত গণহত্যার সংজ্ঞার সঙ্গে ভালোভাবেই মিলে যায়।

এর পরের স্তরের অপরাধটি সংঘটিত হয়েছিল অন্য নির্যাতিতদের বিরাট একটি অংশের ওপর। এটি হলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। সংক্ষেপে, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এর অর্থ হলো, ব্যাপকবিস্তৃতভাবে অথবা একটানা ও সংগঠিতভাবে কোনো বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর সচেতনভাবে আক্রমণ করা। অন্য ভাষায় বললে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হলো বড় আকারে নিরীহ বেসামরিক মানুষদের হত্যা করা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে বড় আকারের আক্রমণ পরিচালনা ও অমানবিক কার্যকলাপ চালানো। ১৯৭১ সালে, বেশির ভাগ আক্রান্তরা ছিল নিরস্ত্র জনসাধারণ, সশস্ত্র যোদ্ধা নয়। যারা অস্ত্র বহন করত তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অন্য আইন প্রযোজ্য, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই বেসামরিক জনসাধারণকে আক্রমণ করা যেতে পারে না।

সর্বোচ্চ অপরাধের দায়

ওপরে বলা অপরাধের কোনো একটিও যে করেছে বা আদেশ, উসকানি, সহায়তা, পক্ষ নেওয়া, সাহায্য, ইন্ধন, মদদ অথবা তাতে অন্য কোনোভাবে অবদান রাখাসহ সজ্ঞানে এ ধরনের অপরাধ বিস্তারে ভূমিকা রাখা যে-কাউকে ব্যক্তিগতভাবে এর জন্য দায়ী করা উচিত। তা হলেও, খেয়াল রাখতে হবে, যাতে যারা পরিকল্পনা করেছিল বা সংগঠিত করেছিল অথবা আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর মতো অপরাধী সংগঠন চালাত, তাদের বিষয়েই বেশি নজর দেওয়া হয়। কারণ সংঘটিত অপরাধের সর্বোচ্চ দায়দায়িত্ব এদেরই। সুতরাং এদের শাস্তি দেওয়ায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকা উচিত এবং তা করা উচিত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই।

বিচারের দায়িত্ব

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন তথা আন্তর্জাতিক অপরাধ, গণহত্যার অপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ইত্যাদির জন্য প্রণীত আইন অনুসারে তদন্ত ও বিচার রাষ্ট্রের ‘ঐচ্ছিক’ বিষয় নয়, ‘দায়িত্ব’। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে সরকারের পয়লা কর্তব্য হচ্ছে গণহত্যা তদন্তে কমিশন গঠন করা এবং তার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে দায়ীদের তদন্ত করে বিচারের মুখোমুখি করার ব্যবস্থা করা।

১৯৭৩ সালের ১১ মে, বাংলাদেশের গণহত্যা প্রশ্নে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে ভারতের বিরুদ্ধে ঠিক এ যুক্তিই পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছিল। ওই তারিখে জাতিসংঘের সদস্য-রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ-মীমাংসায় হল্যান্ডের হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের বিচারিক সংস্থা বিশ্ব আদালতে (আইসিজে) পাকিস্তান একটি মামলা করে। ভারতের হাতে আটক ১৯৫ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীকে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর ঠেকাতে এ মামলা করা হয়েছিল।

মামলার আরজিতে পাকিস্তানের বক্তব্য ছিল এই যে, “১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বরের ‘কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব জেনোসাইড’-এর আলোকে বর্তমানে ভারতের হেফাজতে থাকা এবং পাকিস্তানি ভূখণ্ডে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করার দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন অথবা যেকোনো সংখ্যক পাকিস্তানি নাগরিকের বিচার করার সম্পূর্ণ অধিকার পাকিস্তানেরই রয়েছে। অন্য কোনো সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষ এ ধরনের বিচারকার্য করার উপযুক্ত পক্ষ নয়।’’

পাকিস্তান এও বলে যে, ‘‘উপরিউক্ত যুদ্ধবন্দীদের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য গণহত্যার অভিযোগ, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ কিংবা ‘যুদ্ধাপরাধের’ ধারণা তাদের ওপর প্রযোজ্য নয়।” অন্যভাবে বললে, পাকিস্তান স্বীকার করে নিল যে বাংলাদেশে অবস্থানরত শীর্ষস্থানীয় সামরিক নেতৃত্ব ওই ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দী ‘গণহত্যা চালিয়েছে’। এভাবে তারা বাংলাদেশ যে অভিযোগ করে আসছে তাতেই আরও জোর দিল। পাকিস্তানের এ চেষ্টা কাজে লাগেনি কারণ, ভারত এ বিষয়ে আইসিজের এখতিয়ার স্বীকার করেনি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার দায়ের বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান তার অভিযুক্ত নাগরিকদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। একই কাজ বাংলাদেশও করেছে, অথচ গণহত্যাটি সংঘটিত হয়েছিল তার ভূখণ্ডে তার নাগরিকরদের ওপর। পরিণামে বঞ্চিত হয়েছে নিযুত লক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।

তাই বাংলাদেশ সরকার কোনো অজুহাতেই একাত্তরের অপরাধের তদন্ত ও বিচারের দায় এড়াতে পারে না। আগের সরকারগুলোর ব্যর্থতা কিংবা বর্তমান সরকারের সময়স্বল্পতা অথবা অন্য কোনো কিছুর ওজর তোলা উচিত নয়। সরকারের এভাবে দায়িত্ব এড়ানোর অর্থ বাংলাদেশে অপরাধের দায়মুক্তির যে সংস্কৃতি মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, প্রতিরোধের বদলে তাকে বরং আরো জোরদার করে।

এক অপরাধ, দুই আইন

এটা এখনো এক রহস্য যে একই অপরাধের জন্য কেন বাংলাদেশ দুই ধরনের আইন প্রণয়ন করল। স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক সপ্তাহের মাথায়, ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি, প্রেসিডেন্টের আট নম্বর অধ্যাদেশে ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইন’ নামে একটি আইন প্রণীত হয়। এটি করা হয়েছিল মূলত ‘কতিপয় ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গ অথবা কোনো সংগঠনের সদস্য হিসেবে, যারা প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দালালি করেছিল, যে সেনাবাহিনী বেআইনিভাবে ও নৃশংস শক্তি দিয়ে বাংলাদেশে দখলদারি কায়েম করেছিল এবং যেসব ব্যক্তি গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনে সাহায্য ও সমর্থন যুগিয়েছিল’, তাদের বিচারের উদ্দেশ্যে। অন্যভাবে বললে, এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল দালালদের বিচার।

অপর আইনটি পাস হয় এর প্রায় দেড় বছর পর, ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই তারিখে। এটি ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩। এর উদ্দেশ্য ছিল ‘সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা অথবা তাদের সহযোগী বাহিনীর’ সদস্যদের জন্য, যারা সাতটি বড় ধরনের অপরাধ করেছিল। এর মধ্যে আছে: মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ। এটা অনেককে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছিল এ জন্য যে, ওইসব অপরাধের মূল হোতাদের বিচারে এ আইনটি করতে কেন দীর্ঘ সময় লেগে গেল আর কেনই বা স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই স্থানীয় দালালদের বিচারের জন্য আইন তৈরি হয়ে গেল!

কার্যত একই অপরাধের জন্য দালাল ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জন্য আলাদা আইন করা হয়েছিল। যদিও বাস্তবে সশস্ত্র বাহিনীর একজন সদস্যকেও আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন আইন ১৯৭৩-এর আওতায় আনা না গেলেও কয়েক হাজার দালালকে ঠিকই ধরা হয়েছিল।

কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই এই দ্বিচারিতা আইনের অধীনে সবার মর্যাদা সমান, আইনের এই মৌল প্রপঞ্চের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। এবং পরিণামে, বিশেষ করে যাদের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ১৯৭৩ প্রণয়ন করা হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধীদের সেই ১৯৫ জনকে পাকিস্তানে ফিরে যেতে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দালাল আইনের ধারও কিছুটা কমে গেল। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের জন্য যদি একটিমাত্র আইন থাকত এবং তার জন্য পর্যাপ্ত সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো ওই আইনের আরও তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা আমরা দেখতে পেতাম।

বিচার না করা কিংবা ‘সাধারণ ক্ষমা’

দালাল আইনে সে সময় বেশ কয়েকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। এসবের মাধ্যমে ডা. এম এ মালেকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মুখ্য সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। অপরাধে লিপ্ত হওয়া এবং সহযোগিতার জন্য জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরও এ আইনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আরও অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলে এবং অন্য কয়েক হাজার লোককে আটক করা হয়।

সরকার প্রথমবারের মতো ১৯৭৩ সালের ১৬ মে দালাল আইনের অধীনে সাজাপ্রাপ্ত ও অভিযুক্ত সুনির্দিষ্ট কিছু লোককে ক্ষমা প্রদান করে। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর, আরেক দফা সাধারণ ক্ষমায় যাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ ও আগুন লাগানোর অভিযোগ নেই, এমন অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্তদেরও ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। এ রকম গণহারে মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল পুরাতন বিবাদ মিটিয়ে ফেলে সবাইকে আবার দেশগঠনে সামিল করা কিন্তু এর ফল হয় ঠিক বিপরীত।

এ কাজে ১৯৭১ সংঘটিত অপরাধের জন্য যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেই ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কোনো আলাপ-পরামর্শ করা হলো না। এভাবে একতরফা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে রোপিত হলো প্রবাদকথিত ‘আদি পাপের’ বীজ। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য কেবল পুঁটি মাছেরাই নয়, রাঘব-বোয়ালেরাও কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে গেল।

এই সাধারণ ক্ষমার আদেশ আইনগতভাবেও ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সংবিধানের ৫৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে বিচারাধীনদের নয়, রাষ্ট্রপতি কেবল তাদেরই ক্ষমা করতে পারেন, যাদের সাজা দেয়া হয়েছে। সাধারণ ক্ষমার এ বিকৃতির ফলে সরকার কার্যত সব রকম তদন্তকাজ বন্ধ করে এবং অন্যদেরও ছেড়ে দেয়। শাস্তিপ্রাপ্তদের এভাবে ছেড়ে দেওয়া ছিল বেআইনি।

বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অভিযোগের তদন্ত করতে অনিচ্ছার অর্থ সরকার অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করতে চায় না। একে নমনীয়তা বা সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন বলে না। এই সাধারণ ক্ষমার আদেশের জন্য পরবর্তী সরকারগুলোর ওপরও বিচারের জন্য কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা রইল না। তবে এই মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত চালানোয় সাধারণ ক্ষমার আদেশ কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। কেবল তা-ই নয়, এ আদেশের জায়গায় নতুন আরেকটি আদেশ জারি করে দিলেই চলে।

কিন্তু যা করা হয়েছিল

এ গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বাংলাদেশের জনগণের জীবন, সম্পদ ও ভবিষ্যতের ওপর কী রকম কম্পনক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, তার পরিমাপ কেউ করতে পারে না। যুদ্ধ-পরবর্তী নতুন সরকারও যন্ত্রণা ও দুঃখের সুনামির মাত্রা সম্পর্কে কোনো ধারণাই করতে পারেনি। জনগণকে যে বিপর্যয় ও দুঃখের সাগর পাড়ি দিতে হয়েছে তারা তার অংশীদার হতে পারেননি। এ বিষয়ে সামাজিক স্তরে অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন সক্রিয় রয়েছে কিন্তু কেউই নির্যাতিতদের সংগঠিত করেনি, তাদের কথা শুনতে চাননি। মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যায় যারা ক্ষতিগস্ত হয়েছে এবং এর প্রভাব যাদের ওপর পড়েছে, তাদের জন্য সরকারের তরফ থেকেও নেওয়া হয়নি কোনো ‘পদক্ষেপ’। কিন্তু তা না করা হলেও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কবল থেকে স্থানীয় দালালদের বাঁচাতে তাদের আটক করে রাখা হয়। অনেকের বিরুদ্ধে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালও গঠন করা হয়। কতিপয় মূল দালালের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। এর পেছনে প্রাথমিক সমর্থন থাকলেও আইনগতভাবে এটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এ ধরনের নাগরিকত্ব হরণ কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তির অংশ হিসেবে করা হয়নি, করা হয়েছে নির্বাহী আদেশে। এর অবশ্যম্ভাবী কার্যফল হিসেবে পরে সবার নাগরিকত্বই ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

সাধারণ ক্ষমার মধ্যে বিবাদ-মীমাংসার যে উচ্চাশা ছিল তা ভেঙে পড়ে অ-বিচারের চাপের কাছে। বিচার না হওয়ায় কিংবা ক্ষমার কারণে যারা ছাড় পেয়েছে তারা আবার সংগঠিত হয় এবং একপর্যায়ে বাংলাদেশের অস্তিত্বের মূলে যে উদার ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা ছিল তার বিরোধিতা দাঁড় করায়। আজকের ইসলামপন্থীরা হলো সেই ব্যক্তিবর্গ, যারা সাধারণ ক্ষমার দ্বারা লাভবান হয়েছে। তারা এখনো তাদের পুরোনো সংগঠনগুলোরই নেতৃত্ব দেয় এবং বিশ্বাস রাখে সেই একই মতাদর্শে।

কার্যত গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার কেউই কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ বা সান্ত্বনা পাননি। এমনকি হারানো সম্পত্তিও অনেক ক্ষেত্রে ফিরে আসেনি। নির্যাতিতদের বাধ্য করা হয় নিজে থেকেই উঠে দাঁড়াতে এবং জীবন চালিয়ে যেতে। সংগ্রাম ও জীবন উত্সর্গের স্মারক হিসেবে কিছু স্মৃতিসৌধ অবশ্য নির্মিত হয়েছে। এমনকি নিহতদের মধ্যেও বিভাজন করা হয় প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস পালনের মাধ্যমে। অথচ অন্য লাখ লাখ শহীদের জন্য জাতীয় শোক ও স্মরণে কোনো একক দিবস নেই। আজতক বাংলাদেশ নির্যাতনবিরোধী দিবস বা গণহত্যা দিবস বলে কোনো কিছু ঘোষণা করেনি।

উপসংহার

যাঁরা ভেবেছিলেন নিহতদের গায়েব হয়ে যাওয়া এবং নির্যাতিতদের কণ্ঠ বিলীন হয়ে যাওয়ার পর বিচারের দাবিও মরে যাবে, তাঁরা ভুল ভেবেছিলেন। জাতি এখন আবার একাত্তরের গণহত্যার বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। যে অতীতকে অনেকে পাশ কাটাতে চেয়েছে, সেই অতীত আবার বড় শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে।

অতীতের সঙ্গে বর্তমানে বোঝাপড়া এখনো বাকি আছে বাংলাদেশের। নইলে ১৯৭১ প্রশ্নে যে উত্তেজনা ও সংঘাতের ফাটল সমাজে রয়েছে, অন্য কোনো সময় তা আরও বিস্তৃত হতে পারে। একাত্তরের ক্ষত এতই গভীর যে বিচার ছাড়া তা সহসা শুকানোর নয়। নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্তদের মনে করিয়ে দিতে হবে যে তাদের যন্ত্রণা অন্যরাও বোধ করে এবং অন্যরাও তার অংশীদার। এ বিষয়ে যাবতীয় কার্যকলাপ তাদের লক্ষ্য করে এবং তাদের কেন্দ্র করেই হওয়া উচিত।

একাত্তরের অপরাধের বিচার ছাড়া কোনো প্রতিকারই যথেষ্ট নয়। সংঘাত-পরবর্তী সমাজে শান্তি আসার একমাত্র শর্তই হলো বিচার। সরকার যদি একটি গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও উন্নত বাংলাদেশ চায়, তাহলে তাদের অবশ্যই দায়িত্ব এড়ানোর পথ পরিহার করতে হবে। তাদের উচিত অতীতের দায় মেটানো। নচেত্ সব উদ্যোগই বিভ্রম বলে গণ্য হবে।

সারা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের বলছে, বিচারই উত্তম সান্ত্বনা এবং বলছে যে বিচার ছাড়া শান্তি হয় না।

ড. আহমেদ জিয়াউদ্দীন: আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ও বেলজিয়ামে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা।

ইংরেজি থেকে ভাষান্তর ফারুক ওয়াসিফ

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৮ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত