বিজ্ঞাপন
default-image

১২ ডিসেম্বর আমার অধীন মুক্তিযোদ্ধা দলের একাংশ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লালপুর হয়ে মেঘনা নদী অতিক্রম করে রায়পুরায় পৌঁছায়। আমি আমার হেডকোয়ার্টার দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে রাখি। ১২ ডিসেম্বর রাতটি আমরা রায়পুরায় কাটাই। ১৩ ডিসেম্বর সকালে আমরা নরসিংদী অভিমুখে রওনা হই। সেদিনই বিকেলে আমরা নরসিংদীতে পৌঁছাই। সেখানে রাতযাপন করে পরদিন ঢাকা অভিমুখে রওনা হই। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলকে নির্দেশ দিলাম, তারা যেন তারাবোর দিকে না গিয়ে ভুলতা থেকে মুরাপাড়া, রূপগঞ্জ হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। ১৪ ডিসেম্বর আমার সব ফোর্স মুরাপাড়া পৌঁছে যায় এবং শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে বালু নদের পাড়ে পৌঁছায়। ১৪ ডিসেম্বর আমাদের অবস্থান ছিল শীতলক্ষ্যার পশ্চিম পার পূর্বগাঁও এবং বালু নদের পশ্চিম পারে ডেমরার পেছনে, সেক্টর ট্রুপস বাসাবোর আশপাশে। ১৪, ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর সেখানে যুদ্ধ হয়। ১৬ ডিসেম্বর সকাল প্রায় ১০টা থেকে ডেমরা-ঢাকা রোড আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। ডেমরায় পাকিস্তানি সেনারা প্রায় অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল।

১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকেই কথা হচ্ছিল যে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু দুপুর ১২টা পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। সাড়ে ১২টায় পাকিস্তানি সেনারা ডেমরা-ঢাকা সড়কের ওপর অস্ত্র সংবরণ করে। ডেমরা-ঢাকার যুদ্ধে পাকিস্তানিরা যদিও ফ্রেশ ট্রুপস (সীমান্ত এলাকায় সেনারা ঢাকা আসার আগেই অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল এবং ঢাকায় অবস্থানরত সেনারা ওই দিন পর্যন্ত কোনো যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি, তাই যুদ্ধক্লান্ত ছিল না) ব্যবহার করেছিল, কিন্তু তবু তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি এ জন্য যে তাদের কাছে দূরপাল্লার কামান ছিল না। সেগুলোর প্রায় সবই সীমান্ত এলাকায় ছিল। অন্যদিকে মিত্রবাহিনী ট্যাংক এবং দূরপাল্লার কামান ঢাকার আশপাশে আনতে সক্ষম হয়েছিল। আমাদের তরফ থেকে আমরা বরপার কাছে ফিল্ড গানগুলোর সাহাঘ্যে ঢাকা শহর এবং ডেমরায় গোলাবর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

default-image

এখানে বলে রাখা দরকার, আগরতলা থেকে ঢাকা পর্যন্ত আমাদের অভিযানে, বিশেষ করে আমার ‘এস’ ফোর্স কোনো যানবাহন পায়নি। তাই পুরো রাস্তা তাদের হেঁটে আসতে হয়েছিল। হেঁটে আসতে হয়েছে ঠিকই, তবু তারা ক্লান্তি অনুভব করছিল না। কারণ, তারা সবাই জানত যে পাকিস্তানিদের পতন হচ্ছে এবং ঢাকার পতন অত্যাসন্ন। আমরা আগরতলা থেকে যখন অগ্রসর হই, তখন অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ ছাড়া আর কিছুই আমাদের সঙ্গে আনিনি এবং অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সবই জনসাধারণ ঢাকা পর্যন্ত বহন করে নিয়ে এসেছিল। শুধু আমাদেরই নয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রও এভাবে বহন করে আনা হয়।

৬ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ দিন আমরা কোনো প্রকার রসদ সঙ্গে বহন করিনি। কিন্তু এক বেলাও না খেয়ে থাকিনি। আমাদের খাবারের ব্যবস্থা জনসাধারণ করেছিল। আমাদের খাবারের ব্যবস্থার কথা কাউকে বলতেও হয়নি। কোনো কোনো জায়গায় এমনও হয়েছে, খাবারের প্রস্ত্ততির দেরি দেখে আমরা সামনে অগ্রসর হয়েছি এবং জনসাধারণ পরে পেছন থেকে মাথায় করে চার-পাঁচ মাইল দূর পর্যন্ত খাবার বহন করে নিয়ে এসেছে আমাদের খাওয়ানোর জন্য।

১৬ ডিসেম্বর বেলা প্রায় দেড়টায় ডেমরায় পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে অস্ত্র সংবরণ করে। ওই সময় আমাকে সংবাদ দেওয়া হয়, বেলা সোয়া তিনটায় আমি যেন ঢাকা বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকি। কারণ, সে সময় লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আসছেন এবং লে. জেনারেল এ কে নিয়াজিও সেখানে উপস্থিত থাকবেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমি যেন উপস্থিত থাকি।

যদিও ডেমরায় পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করেছিল, তবু ডেমরা ও ঢাকার মধ্যবর্তী এলাকা মাতুয়াইলে তখনো পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান রক্ষা করছিল। বেলা তখন প্রায় দুইটা। আমাকে সাড়ে তিনটায় বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকতে হবে। তাই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার মেজর মঈনকে (মঈনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম, পরে মেজর জেনারেল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) ব্যাটালিয়ন নিয়ে ঢাকায় চলে আসার নির্দেশ দিই। পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল খিলজিকে বলি, আমাকে ঢাকা বিমানবন্দরে যেতে হবে এবং তোমার সেনারা যারা মাতুয়াইলে আছে, তাদের তুমি গোলাগুলি বন্ধ করতে নির্দেশ দাও। আমরা একই জিপে ডেমরা থেকে মাতুয়াইলের দিকে যাই এবং কর্নেল খিলজিকে আগে পাঠিয়ে দিই, সে যেন তার সেনাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। সেনাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে খিলজিকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। অবশেষে সে তার সেনাদের আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হয়।

মাতুয়াইলে আত্মসমর্পণের পর আমি এবং মিত্রবাহিনীর ডেল্টা সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং ঢাকা বিমানবন্দর অভিমুখে রওনা হই এবং সোয়া তিনটার মধ্যে আমরা বিমানবন্দরে পৌঁছে যাই। বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখতে পাই, সেখানে জেনারেল নিয়াজি এবং মিত্রবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল জেকব, জেনারেল স্বাগত সিং, জেনারেল নাগ্রা এবং আরও অনেকে উপস্থিত রয়েছেন। আমি বিমানবন্দরে পৌঁছেই তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলি। সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরাকে যাঁরা সাদর সম্ভাষণ জানাতে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি হচ্ছেন সকল দৃষ্টির কেন্দ্রে। বিষন্ন ও অবদমিত তাঁর মুখাবয়ব। পরাজিত একজন সেনাপতিকে প্রত্যক্ষ করার মতো অভিজ্ঞতা, এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা, যিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই শুধু পরাজয়ের গ্লানি স্বীকার করেননি, যাঁর রয়েছে আরও এক লজ্জাকর গণহত্যার সদ্য অতীত ইতিহাসও!

তাঁর পরাজয় শুধু পরাজয়ই নয়। পরাজয়েও এক ধরনের দীপ্তি থাকে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির তা-ও ছিল না। আমি যখন তাঁর দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, তখন তাঁর পুরো অস্তিত্ব অবিন্যস্ত ও কালিমালিপ্ত। জেনারেল নিয়াজিকে জিজ্ঞেস করি, ‘স্যার, ডু ইউ রিমেম্বার মি? আই অ্যাম এক্স মেজর সফিউল্লাহ অব টু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অ্যান্ড নাউ কর্নেল সফিউল্লাহ অব বাংলাদেশ আর্মি।’ জেনারেল নিয়াজিকে খুবই চিন্তিত ও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তিনি আমার কোনো কথার জবাব না দিয়ে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলেন যে তিনি আমাকে চিনেছেন।

আমাদের তেমন অপেক্ষা করতে হলো না। আকাশে দেখা গেল হেলিকপ্টারের বহর। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেলিকপ্টারযোগে জেনারেল অরোরা তাঁর দলবলসহ বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর বিমানবন্দর থেকে আমরা তদানীন্তন রমনা রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পৌঁছাই। সেখানে সেদিন বহু লোকের সমাগম হয়েছিল। জেনারেল অরোরার সঙ্গে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারও (পরে এয়ারভাইস মার্শাল, বর্তমানে পরিকল্পনামন্ত্রী) এসেছিলেন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকার জন্য।

এরপর আমরা রেসকোর্স ময়দানে যাই। ময়দানে আমরা প্রবেশ করি এখন যেখানে পুলিশ কন্ট্রোল ক্যাম্প, সেদিক দিয়ে। পশ্চিম পাশে একটি গেট ছিল। পূর্বদিকে কিছুদূর যাওয়ার পর, অর্থাৎ পুলিশ ক্যাম্পের পূর্ব পাশে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার রাখা। সেই টেবিল ও চেয়ার কোথা থেকে আনা হয়েছে, সেটা আমি জানি না। আনন্দঘন ওই মুহূর্তে জানার কথা মনেও হয়নি। জেনারেল অরোরা ও নিয়াজি সরাসরি টেবিলের সামনে পাতা চেয়ারে গিয়ে বসেন। দু-তিন মিনিট পর জেনারেল নিয়াজি যৌথ কমান্ডের (বাংলাদেশ-ভারত) কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। তখন আমার ঘড়িতে সময় চারটা ৩১ মিনিট। নিয়াজি দলিলে স্বাক্ষর করা মাত্র চারদিকে জয়বাংলা স্লোগানে মুখর হতে থাকল। এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ কে খন্দকার, এ টি এম হায়দার এবং আমি উপস্থিত ছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ ময়মনসিংহে বসে ঢাকা দখলের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাস্তবায়িত হয়েছিল।

ঢাকা দখলের যে গৌরব, তা আমার ফোর্সেরই প্রথম ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রায় সাড়ে পাঁচটায় আমার ফোর্স ঢাকা স্টেডিয়ামে শিবির স্থাপন করে। ১৬ ডিসেম্বর আমার হেডকোয়ার্টার ঢাকায় পৌঁছে যায়। প্রথম সেটা স্থাপিত হয় স্টেডিয়ামের পাবনা এম্পোরিয়ামের তৃতীয় তলায় এবং ১৭ ডিসেম্বর সেটা আমি ৩৫ মিন্টো রোডে স্থানান্তর করি। ঢাকা সেনানিবাসে হেডকোয়ার্টার স্থানান্তরিত করার আগ পর্যন্ত আমার হেডকোয়ার্টার ৩৫ মিন্টো রোডে থেকে যায়। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল তখন রেসকোর্স ময়দানে অবস্থান করে।

মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ,বীর উত্তম: সাবেক সেনাপ্রধান ও মুক্তিযুদ্ধে ‘এস’ ফোর্সের অধিনায়ক

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১২ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত