বিজ্ঞাপন
default-image

ভূমিকা

আজ এ কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ছিল সর্বাত্মক। তাঁরাই এই যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ বা গেরিলাযুদ্ধের দৃষ্টান্ত খুব বেশি না হলেও অনেক নারীই সেদিন মুক্তিবাহিনীর বাঙ্কারে বাঙ্কারে অস্ত্র-গোলাবারুদ পৌঁছে দিয়েছেন, সংবাদ আদান-প্রদান করেছেন। আবার অনেকে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে অবস্থান করে রান্নাবান্নার কাজও করেছেন। অনেকে বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ফিল্ড হাসপাতালে প্রত্যক্ষভাবে সেবাদান করেছেন।

সংস্কৃতি অঙ্গনেও তাঁদের অবদান ছিল অনন্য। শরণার্থী কিংবা যুবশিবিরে, কিংবা জনসভায় সঙ্গীত পরিবেশন করে, নাটকে অংশ নিয়ে, কবিতা পাঠ করে নিঃস্ব শরণার্থী-মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখতে, জনমত গঠন করতে নারীর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।

অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে মায়েরা-মেয়েরা মুক্তিবাহিনীকে আশ্রয় দিয়েছেন, আহার দিয়েছেন, লুকিয়ে থাকতে সাহায্যও করেছেন। কেবল তা-ই নয়, পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর অবস্থান ও চলাচল সম্পর্কেও নানা তথ্য সরবরাহ করেছেন তারা। পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের জৈবিক লালসার শিকারও হয়েছেন তাঁরা এবং সেই গ্লানি নিয়ে জীবনধারণের অভিজ্ঞতাও একমাত্র তাঁদেরই।

default-image

বিগত পঁয়ত্রিশ বছরে মুক্তিযুদ্ধে নারীর সার্বিক অবদান, অবস্থান ও তাদের ওপর নিপীড়ন বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। এ পর্যন্ত যে চার-পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে সেসব গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধে নারীর সার্বিক অংশগ্রহণ বা ভূমিকা স্পষ্ট করে না।

১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় ইতিহাস প্রণয়নে গঠিত হয় ‘জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস পরিষদ’। আমি তখন কেবল যুদ্ধ থেকে ফিরে আমার কর্মস্থল সিরাজগঞ্জ মহকুমার বেলকুচি কলেজে যোগ দিয়েছি। জুন মাসে ঢাকা থেকে আমাকে ডেকে পাঠালেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ড. মযহারুল ইসলাম। আমার শিক্ষক তিনি, মুক্তিযুদ্ধকালে অনেক কাজই আমরা একত্রে করেছি। শিক্ষকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দ্রুতই বাংলা একাডেমীতে দেখা করলাম তাঁর সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা হবে, তোমাকে খুলনা বিভাগের তথ্য সংগ্রহে প্রধান সংগ্রাহকের দায়িত্ব নিতে হবে। সেই সঙ্গে গবেষণা কাজেও সহায়তা দিতে হবে।’ আমার পদ হলো ‘খুলনা বিভাগীয় প্রধান সংগ্রাহক ও গবেষণা সহায়ক’। পরদিনই কাজে যোগ দিতে বললেন। কোনো কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমি শেষ পর্যন্ত কলেজের স্থায়ী চাকরি ছেড়ে বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস পরিষদ’ শীর্ষক প্রকল্পে যোগ দিলাম জুন মাসেই। সেই শুরু। এই প্রকল্পের পক্ষ থেকেই তখন কেবল তিনজন সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে পুরো এক বছর খুলনা বিভাগের সব জেলা, মহকুমা, থানা, এমনকি গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সব স্তরের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। কথা হয়েছিল অনেক নারীর সঙ্গেও। তাদের কয়েকজনের কথা আজ বলব। তখন তো টেপ রেকর্ডারের চল ছিল না, সাক্ষাত্কার দাতা ঘটনা বলে যেতেন আর আমরা সেটা দ্রুত হাতে লিখে নিতাম। তারপর সাক্ষ্য প্রদান শেষে তাঁর স্বাক্ষর নেওয়া।

ময়িজান খাতুন। মেহেরপুর থানার মণ্ডলপাড়ায় শ্রমজীবী স্বামী আক্কাস আলীকে নিয়ে সুখেই ঘর করছিলেন তিনি। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তাদের সবকিছু তছনছ করে দিল। ১৯৭২ সালের ২ ডিসেম্বর ময়িজান খাতুনের মণ্ডলপাড়ার বাড়ির উঠোনে বসে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। স্বামী আক্কাস আলী একটা মোড়া এগিয়ে দিলেন। সেদিন বেশ সাবলীল আর স্পষ্টভাবেই কথা বললেন ময়িজান খাতুন। তিনি বললেন, ‘১৮ এপ্রিল মেহেরপুরের পতন ঘটলে আমরা ভারতে চলে গেলাম। কিন্তু সেখানে থাকতে পারলাম না। ভারতে অসুবিধা হওয়ায় স্বামী-সন্তানসহ আমরা কুলবেড়ে গ্রামে চলে এলাম। এটা বাংলাদেশের মধ্যে। কুলবেড়ে গ্রামেও থাকতে পারলাম না। তখন সবাই বলাবলি করছিল যে, মেহেরপুর শহরের অবস্থা নাকি ভালো। সেখানে থাকা যাবে। শেষ পর্যন্ত জুন মাসের প্রথমে মেহেরপুরে আমাদের মণ্ডলপাড়ার বাড়িতে ফিরে এলাম। ফিরে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই দেখলাম পাড়ায় পাঞ্জাবিদের অত্যাচার। পাঞ্জাবিরা মাঝেমধ্যেই এসে এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঢুকে পড়ত। আগেই খবর পেতাম যে পাঞ্জাবি আসছে, তখন আমরা মেয়েরা সব এখানে-ওখানে পালিয়ে থাকতাম। কিন্তু দিনে দিনে পাঞ্জাবিদের অত্যাচার বেড়েই চলল। বাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত পাড়ায় টিকতে না পেরে মেহেরপুর শহরের মাঝখানে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের বাসাবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম আমরা চারজন মহিলা। বাড়িটি খালিই পড়ে ছিল। আমি তখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

‘শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে পাঞ্জাবিরা বেলা ১২টার দিকে দোতলায় উঠে দরজা ভাঙা শুরু করে। একসময় তারা দরজা ভেঙে ফেলে আমাকে এবং রহিমা খাতুনকে জাপটে ধরার চেষ্টা করে। রহিমা খাতুনের স্বামীর নাম ফরমান শেখ। বাড়িতে তখন কোনো পুরুষমানুষ ছিল না। উপায় না দেখে আমরা দুজন পাঞ্জাবিদের হাত কোনোরকমে ছাড়িয়ে নিয়ে দোতলার ওপর থেকে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ি। পাঞ্জাবিরা দোতলা থেকে আমাদের আর গুলি করেনি। প্রায় জ্ঞানহারা অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে আমরা দুজন মোয়াজ্জেম সাহেবের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিই। তাঁরা আমাদের চিকিত্সা-সেবাযত্ন দিয়ে বাঁচিয়ে তুললেন। আমরা দুজনই বেঁচে গেলাম। কদিন পর আমার সন্তান জন্ম নিল। কিন্তু বাঁচল না।’ আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কেন এ পথ বেছে নিয়েছিলেন। ময়িজান ও রহিমা উভয়ে দৃঢ়কণ্ঠেই জবাব দিয়েছিলেন, ‘...পাঞ্জাবিদের হাতে ইজ্জত দেওয়ার চেয়ে মৃত্যু অনেক ভালো। তাই আত্মহত্যার জন্যই লাফিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু অদৃষ্টের কী পরিহাস, আমরা আজও বেঁচে আছি!’

মোসাম্মত্ হাজেরা খাতুন। স্বামী ওমর শাহ। মেহেরপুর মহকুমার গাঙনী থানার তিরাইল গ্রামে বাস করতেন হাজেরা খাতুন। আমি হাজেরা খাতুনের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে বসে কথা বলেছিলাম ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর। হাজেরা খাতুন জানালেন, ‘...১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের ঘটনা। আমাদের এখানে যে ব্রিজ আছে, সেই ব্রিজের নিচে কয়েকজন রাজাকার এবং কয়েকজন পাঞ্জাবি সব সময় পাহারা দিত।

‘পাঞ্জাবিদের অত্যাচারের জন্য আমার স্বামী আমাকে রাতের বেলা ঘরের ভেতরে রেখে ঘরের বাইরের বারান্দায় শুয়ে থাকতেন। একদিন রাতে হঠাত্ করেই কয়েকজন খানসেনা আমাদের বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। দুজন পাঞ্জাবি প্রথমেই আমার স্বামীকে ধরে আটকে রাখল। তারপর অন্যরা আমার ঘরের ভেতর ঢুকে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। রাতে আমার সঙ্গে আমার শাশুড়িও শুয়ে ছিলেন।

তারা আমার শাশুড়িকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে আমাকে জাপটে ধরে আমার কাপড় খুলে ফেলে। আমি ভীষণ এক চিত্কার দিয়ে উঠি। এমন সময় দেখলাম, আমার স্বামী খানসেনাদের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমাদের বাঁশের চাটাইয়ের বেড়ায় যে ধারালো হেঁসো ছিল—সেই হেঁসোটা টান দিয়ে নিয়েই এক পাঞ্জাবিকে এক কোপে কেটে ফেলে। আর একজন যে ছিল, তাকেও দিল আরেক কোপ। পাঞ্জাবিরা তখন মরণচিত্কার শুরু করে দিয়েছে। ঘরের ভেতরে যারা আমাকে বেইজ্জত করতে এগিয়ে এসেছিল, তারা তখন আমাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসে। এমন সময় দেখলাম আমার স্বামী একটা রাইফেল তুলে নিয়ে বেড়া ভেঙে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল। আমিও স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে দৌড় মারি। অন্ধকার রাত। আমরা দুজন কোন দিকে দৌড়াচ্ছি জানি না। ফট ফট করে পাঞ্জাবিরা গুলি করল আমাদের দিকে। একটি গুলি আমার স্বামীর পায়ে এসে লাগে। কিন্তু তাতেও আমার স্বামী থামেনি। রাইফেল নিয়েই আমরা ভারত চলে গেলাম। বর্ডার তো কাছে। ভারত গিয়ে রাইফেল জমা করল আমার স্বামী। তারপর তারা আমার স্বামীকে শক্তিনগর হাসপাতালে ভর্তি করে। কিন্তু আমার স্বামীকে বাঁচানো গেল না। হাসপাতালেই সে মারা গেল।’ হাজেরা খাতুন বললেন, ‘...দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে আসি। এসে দেখলাম আমার বাড়িঘর সব ধ্বংস। আমার কিছুই নেই। শুনলাম, আমার কারণে আমার গ্রামের বহু নিরীহ লোককে পাঞ্জাবিরা হত্যা করেছে।’

আমি জানি না হাজেরা খাতুন বেঁচে আছেন কি না, কিংবা কোথায় কী অবস্থায় আছেন। আর গাঙনী যেতে পারিনি।

অঞ্জলি হালসনা মেহেরপুর থানার ভবেরপাড়া গ্রামে বাস করতেন। খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের ১৮-১৯ বছরের যুবতী অঞ্জলি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আর পাঁচজনের মতো মুক্তিযুদ্ধের সেই উষালগ্নে অঞ্জলি হালসনাও এগিয়ে গিয়েছিলেন পাকসেনাদের প্রতিরোধে। ভবেরপাড়ায় তখন খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের বসবাস ছিল। ভবেরপাড়ায় বসে ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি কথা বলেছিলাম অঞ্জলি হালসনার সঙ্গে। রীতিমতো সুন্দরী অঞ্জলি সেদিন বলেছিলেন: “...১৮ এপ্রিল ভবেরপাড়া খ্রিষ্টান মিশনারির অন্য মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে আমি ভারতীয় সীমান্ত হূদয়পুর খ্রিষ্টান মিশনে গিয়ে আশ্রয় নিই। জুলাই মাসের প্রথম থেকেই আমি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি কাজ করতে থাকি।

‘জুলাই মাসে ইপিআর বাহিনীর আবদুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর যে দলটি বাংলাদেশের মেহেরপুর এলাকায় প্রবেশ করে, আমিও তাদের সঙ্গেই দেশে আসি। আমার ওপর নির্দেশ ছিল—আমি আগে সম্পূর্ণ এলাকা রেকি করে পাকসেনাদের অবস্থান, তাদের শক্তি, রাজাকারদের অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য ক্যাম্পে নিয়ে আসব। তারপর আমার খবর মতাবেক অপারেশন চালানো হবে। কাজ সেভাবেই এগিয়ে চলে। অপারেশনের সময় আমি নিজে ফিল্ডেও থাকতাম। গুলির বাক্স এবং অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করতাম মুক্তিযোদ্ধাদের। আমি তখন তো বয়সে তরুণী, খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ, অফুরন্ত সাহস নিয়েই ফিল্ডে থাকতাম।

‘এরপর আমার কাজ ছিল মুক্তিবাহিনীর দল নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে আমাদের নিজস্ব ‘করিডরে’ পৌঁছে দেওয়া। বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে মানিকনগরসহ বিভিন্ন স্থানে আমি ঘুরেছি। ‘রেকি’ করার পরও প্রথমে আমি, তারপর আমাদের বাহিনী প্রবেশ করত। মিশনারি হাসপাতালে আমার চিকিত্সাসেবা দানের প্রাথমিক অভিজ্ঞতাও ছিল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে যুদ্ধের ময়দানেই আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতাম। এ জন্য বাঙ্কারে বাঙ্কারে রাতও কাটাতে হয়েছে। একটি ঘটনায় আমার মন আজও শিউরে ওঠে।

‘সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। সঠিক দিন-তারিখ মনে নেই। আমাদের সি/৯ কোম্পানির পুরোটি, যারা বাংলাদেশের ভেতরে কাজ করছিল—তাদের উইথড্র করে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই কোম্পানির বদলে অন্য একটি কোম্পানি আমাদের এলাকায় আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সেখানে নতুন কোম্পানির আসার খবর পাকসেনারা কীভাবে যেন টের পেয়ে যায়। আমাদের নতুন কোম্পানি তখনো জায়গামতো বসতে পারেনি—ঠিক তখনই পাক বাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ করে বসে। আমরা ছিলাম অপ্রস্তুত। কিন্তু তার পরও সবাই প্রতিরোধ গড়ে তুলে পাকসেনাদের মোকাবিলা করে চলল। তুমুল সংঘর্ষ। একদম সামনাসামনি। লড়াই আধঘণ্টা চলার পর বুঝতে পারলাম, আমরা ক্রমশ পাক বাহিনীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে যাচ্ছি। এটা বুঝতে পেরে আমরা আস্তে আস্তে পিছু হটতে থাকি। কিন্তু এমন অবস্থা যে, আমরা কেউই মাথা তুলতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যেই আমরা পিছু হটতে লাগলাম। আমার সৌভাগ্য যে, সেদিন আমরা মাত্র কজন আহত অবস্থায় মূল ক্যাম্পে ফিরে আসতে পেরেছিলাম। আমাদের অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই সেদিন পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হলেন।

‘এই অপারেশনের পর আমরা ২১ সেপ্টেম্বর ভবেরপাড়ায় পাকাপাকিভাবে ঘাঁটি গড়ে তুলি এবং ওই এলাকা মুক্ত বলে ঘোষণা করি। এই ঘাঁটি গড়ে তোলার পর এখান থেকে আমরা মানিকনগর, সোমাপুর, ভবেরপাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা, এমনকি মুজিবনগর পর্যন্ত অপারেশন চালিয়েছি। ২১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে পাকিস্তানিরা আর ভবেরপাড়ায় প্রবেশ করতে পারেনি। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই মেহেরপুর মহকুমা মুক্ত হয়ে গেল।”

মুক্তিযোদ্ধা অঞ্জলি হালসনার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। জানতে ইচ্ছে করে, এই স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি কেমন আছেন?

স্বামী অনন্ত মজুমদার আর সন্তানদের নিয়ে সুখেই ছিলেন সূর্যবালা মজুমদার। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাঁদের সুখের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিল। সেই আগুন আজও সূর্যবালাদের জীবন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে চলেছে। তাঁরা আজ নিঃস্ব, পথের ভিখারি। অথচ তাদের একদিন সব ছিল।

বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার রামপট্টি গ্রামে সূর্যবালার স্বামী অনন্ত মজুমদার ও তাঁর ভাইয়েরা একত্রেই বাস করতেন। ওঁরা চার ভাই ছিলেন। বড়জনের নাম মনোরঞ্জন মজুমদার, মেজো ভাই বীরেন মজুমদার, তারপর অনন্ত এবং সবার ছোট ছিলেন বিজয় মজুমদার। গ্রামে তখন রাজাকার-দালালদের অত্যাচার শুরু হয়ে গেছে। বাড়িতে টেকা দায়। এখানে-ওখানে হামলা হচ্ছে—এ খবরও অনন্ত মজুমদাররা পাচ্ছেন। কিন্তু ওদের চার ভাইয়ের কেউই চৌদ্দপুরুষের ভিটেবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে চাইলেন না। ঠিক করলেন নিজ গ্রামেই থাকবেন। কোথাও যাবেন না। কিন্তু তাদের এ সিদ্ধান্তই কাল হলো। কাঞ্চন রাজাকার ছিল, কুখ্যাত রাজাকার। সূর্যবালার ভাষায়, ‘কাঞ্চন আছিল রাজাকার। হে খুব অত্যাচার করছে।’ এই কাঞ্চনই গ্রামে মিলিটারি নিয়ে আসে।

সেদিন ছিল ১৫ বৈশাখ ১৩৭৮, বৃহস্পতিবার। এদিন পাঁচজন পাকসেনা কিছুসংখ্যক রাজাকার-দালাল সঙ্গে নিয়ে দুপুরের দিকে রামপট্টি গ্রামে প্রবেশ করে। সূর্যবালা তাঁর মৌখিক সাক্ষ্যে এ ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেছেন, ‘...দেখছি তারা মাছ ধরিয়া উঠছে। হেরা তিন ভাই বাড়ির পুকুরে মাছ ধরতেছিল। মাছ ধইরা উঠছে পর সবাইরে ডাইকা নিছে। কাঞ্চন (রাজাকার) কয় এদিকে আয়। কইছে ভয় নাই। ডাইকা নিছে তিন ভাইয়েরে। হেরা ভাবছিল মিলিটারি কইবে না কিছু। হেগো আর এক ভাই ছিল। হে কিন্তু পলাইছে। এখন বাঁইচ্চা আছে সে। ওর নাম বিজয়। হে তো পরে ভারতে চইলা গেছে।...তারপর তো হেরা মোগো বাড়ির তিনজন আর ওইপাশের বাড়ির চারজন, এই মোট সাতজনেরে এইখানে যে বড় একটা দিঘি আছে, আকবর আলীর বাড়ির দিকে, সেইদিকে লইয়া গেছে। ওইদিকে নিয়া গিয়া গুলি কইরা মারছে।...পরে রাজাকার আবার আইয়া অনেক বাড়িঘর পুড়াই দিল।’

এদিন চার ভাইয়ের তিন ভাই—মনোরঞ্জন মজুমদার, অনন্ত মজুমদার এবং বীরেন মজুমদার নিহত হলেন পাকসেনাদের গুলিতে। কী অপরাধ করেছিলেন তাঁরা? সাতপুরুষের ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরেই তো তাঁরা বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারলেন না, পাকিস্তানি হায়েনারা তাদের বাঁচতে দিলেন না। সূর্যবালা মজুমদার আজ বিধবা, নিঃসহায়, সর্বস্বহারা। কেবল সূর্যবালা নন, অপর দুই ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানেরাও আজ সর্বস্বহারা। কিন্তু তার পরও তারা দেশ ছাড়েননি। আজও তাঁরা দুঃসহ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

আছিয়া খাতুন। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল ৩০ বছর। নিরক্ষর এই মহিলা ঘর-সংসার নিয়েই ছিলেন। স্বামী নাজেম আলী হাওলাদার। বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার চাঁদপয়সা গ্রামে তাদের বসবাস। বরিশালের গোটা জেলায়ই তখন স্থানীয়ভাবে এক-একজনের নেতৃত্বে এক-একটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ গড়ে উঠেছে। আছিয়া খাতুন একটি গ্রুপের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লেন। না, তিনি অস্ত্র-হাতে লড়াই করেননি। তাঁর ভাষায়: ‘...হেগো খাদ্য আইন্যা দিতাম, হেগো পাকশাক করিয়া খাওয়াইতাম।...ডেলি অনেক মানুষ থাহে, খুব পরিশ্রম করা লাগে। হেই পরিশ্রম আমি একলা তো আর করতে পারি নাই, অনেক মাইয়া আওগাইয়া-পাছ্ছাইয়া বাটুন কুডন, রান্দাবাড়ি করিয়া দিছে।’

আমরা আছিয়া খাতুনকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কেন এ কাজ করতে গেলেন? কী লাভ হয়েছে আপনার? এ প্রশ্নের উত্তরে আছিয়া বলেছিলেন, “...দেশ স্বাধীন করার জন্য ওরা নামছে, আমরা সাথেই থাকুম। পাকবাহিনীগো লাইগা আমরা নুন বাড়ি থুইয়া খাইতে পারি নাই। আর এহন আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাই থাহি। আমাগো কোনো ভয় নাই।...এই কারণে হেগো টাকাও খাই নাই, পয়সাও নেই নাই বা হেগো একখান কাপড়ও পিন্দি নাই।...আমি কোনো লিপ্সা করি নাই।

‘...দেশের জন্য করলাম। কষ্ট করি, সুখ করি আল্লাহ দেখছে।...ছয় মাস হেরা এই জাগায় রইছে। ছয় মাস পর তো ওহাব খাঁ চইলা গেল।”

দেশ স্বাধীন করার জন্যই আছিয়া ঘর-সংসার ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করতে গিয়েছিলেন। কেমন আছেন এখন আছিয়া খাতুন?

হানুফা খাতুন। বাবা মোহাম্মদ রসুল আলী, দলিল-লেখক। হানুফা তখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী। বয়স ১৬ বছর। মেহেরপুর থানার মাঠপাড়ায় তাদের বাড়ি। মাটির ঘর, ওপরে শণ। জমি থেকে তাদের মূল ঘর বেশ উঁচুতে। ঘর-বারান্দা সব ঝকঝকে তকতকে। আমি হানুফাদের বাড়ি গিয়েছিলাম ১৯৭২ সালের ১০ ডিসেম্বর। হানুফা আমাকে বলেছিলেন তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া দুঃসহ যন্ত্রণার কথা। হানুফা তার মা-বাবা এবং অন্য যাঁরা সেখানে ছিলেন, তাঁদের সামনে কথা বললেন না। তিনি আমাকে তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন। তারপর শুরু করলেন তাঁর যন্ত্রণার কাহিনী।

‘এপ্রিল মাসে মেহেরপুর মহকুমার পতন ঘটলে আমরা মাঠপাড়া থেকে পালিয়ে পিরোজপুর চলে গেলাম। কিন্তু সেখানে থাকা-খাওয়ার খুব অসুবিধা হতে লাগল। সেখানে থাকতে না পেরে আমরা সাত ভাইবোন, আব্বা-আম্মা সবাই বেশ মুশকিলে পড়ে গেলাম। এদিকে পাকসেনারা সীমান্ত এলাকায় চলে আসায় আমরা আর ভারতেও যেতে পারলাম না। তখন বাধ্য হয়ে সেখান থেকে আমরা মেহেরপুরে আমাদের বাড়িতে ফিরে আসি সবাই। বাড়িতে ফিরে আসার পরপরই খানসেনারা আমার আব্বাকে ধরে নিয়ে যায় গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে। আমরা সবাই তখন কান্নাকাটি করতে লাগলাম। আব্বাকে থানায় তিন দিন আটকে রেখে সেখান থেকে তাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ পেলাম আমরা। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।

‘তখন বর্ষাকাল। বেলা ১২টা/১টা হবে। এ সময় তিনজন খানসেনা আমাদের বাড়িতে আসে। খানসেনারা নিচে আমার আম্মার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বলতে একজন খানসেনা আমাদের ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং আমাকে দেখে আমার ওপর রাইফেল ধরে। আমি শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। মা-ভাইবোনের সামনেই আমার প্রতি সে অশ্লীল আচরণ করতে লাগল। এক পর্যায়ে আমাকে সে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকল। আমি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। মা বাধা দিতে গেলে তাকে ভীষণ মারধর করতে করতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। তারপর হঠাত্ করে আমাকে জোর করে তুলে পাশের ঘরে নিয়ে যায়। ওই খানসেনাকে আমি বাবা-ভাইয়া বলে হাত-পা ধরে আমাকে ছেড়ে দিতে বললাম। কিন্তু কিছুতেই তাকে নিরস্ত করতে পারলাম না। আমাকে অসহ্য যন্ত্রণা দিতে লাগল। তারপর জোর করে টান দিয়ে আমার ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলল। পরনে পেটিকোট ছিল না। একটানে শাড়িটিও খুলে দূরে ফেলে দিল সে। তারপর ওই খানসেনা নিজেও সম্পূর্ণ উলঙ্গ হলো এবং সে আমার ওপর প্রায় আধঘণ্টা পাশবিক অত্যাচার চালাল। আমি যন্ত্রণায় যত ছটফট করতে থাকি, খানসেনাটি ততই বেশি বেশি যন্ত্রণা দিতে থাকে। এরপর আমাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ রেখে খানসেনাটি নিচে নেমে গেল। আমি বাইরে আসতে পারি না। মা পরে কাপড় নিয়ে দেন। বেশ কিছুদিন বিশ্রামের পর আবার আমি সুস্থ হয়ে উঠি।

‘দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমি নিগৃহীতা। সমাজ আমাকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে। কেউ স্থান দেয় না। আমার এই পরিণতির জন্য আমি কি দায়ী? অহরহ এক দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। স্কুলের মেয়েরা আমার সঙ্গে প্রায় কথা বলে না। মুচকি হাসে। সরকারি সাহায্যও কিছু পেলাম না। স্কুলের বেতনটা পর্যন্ত মাফ হয়নি। আমরা গরিব। দিন প্রায় চলে না। হয়তো পড়াশোনাটাও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন মৃত্যু ছাড়া আর পথ থাকবে না।”

সেদিন হানুফার প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি। তাদের বাড়িতে আর যাওয়াও হয়ে ওঠেনি এতগুলো বছরেও। কেমন আছে ওই পরিবার?

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত