রাজনীতির সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক ছিল না। তবে আমি সচেতন ছিলাম। কোথায় কখন কী ঘটছে, সেটা দেখতাম, শুনতাম এবং পর্যালোচনা করতাম বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিলে। মার্চ মাসের প্রথম দিক থেকেই মনে হচ্ছিল একটা দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে আমাদের সামনে। সেই সময় বিদেশ থেকে আমাদের কোম্পানির [ওষুধ কোম্পানি মে অ্যান্ড বেকার] এক প্রতিনিধি ফ্রান্সের প্যারিস থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। ৭ মার্চ সকালে তাঁর সঙ্গে আমি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে [পরে হোটেল শেরাটন ও রূপসী বাংলা। এখন আবার ইন্টারকন্টিনেন্টাল] আলাপ করছিলাম। তাঁকে বলেছিলাম, একটু পরই ওই মাঠে [রেসকোর্স ময়দান। বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান] আমাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেবেন, আমি সেই বক্তৃতা শুনতে যাব।
তিনি ফরাসি ছিলেন। ফরাসিরা সাধারণত রাজনৈতিক কোনো ব্যাপারে দ্রুত উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকেন। তাঁর নাম ছিল মিশেল গিলমোর। তিনি আমাকে বললেন, ‘আমিও যাব তোমার সঙ্গে।’ সাতই মার্চের এই মিটিংয়ের বর্ণনা বিভিন্ন সময় বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। ছবিও আছে। কিন্তু চোখে না দেখলে তার বর্ণনা দেওয়া মুশকিল। চারদিক থেকে হাজারে হাজারে লোক বিভিন্ন ধরনের ব্যানার নিয়ে মিটিংয়ের দিকে আসছে। সে মিটিংয়ে বিভিন্ন রকমের স্লোগান, বিভিন্ন রকমের ব্যানার। সত্যিই মনে হচ্ছিল তারা যেন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে আসছে। সেই মিটিংয়ের যে লোকসংখ্যা, সে সম্পর্কে ধারণা করা ছিল কঠিন। মাঠের মাঝামাঝি এক জায়গায় আমি আর আমার ওই বিদেশি বন্ধু ঘাসের ওপর বসে সেই বক্তৃতা শুনলাম।
বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর বন্ধুটি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, উনি [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান] কী বললেন? আমি ইংরেজিতে বললাম, ডিক্লারেশন অব ওয়ার। তাঁর মুখ থেকে একটাই কথা বের হলো, ‘দ্যাট ইজ সিডিশাস? হি কুড বি ট্রাইড ফর ট্রিজন।’ তারপর আমরা সেই মিটিং থেকে বেরিয়ে এলাম। তাঁকে হোটেলের দরজায় পৌঁছে দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমার বাসা তোপখানা রোডে চলে এলাম। আমার স্ত্রী বললেন, ‘মিটিংয়ে কী শুনলে?’
তাঁকেও একই কথা বললাম। এটা শুনে আমার স্ত্রী বললেন, এরপর কী হবে? আমি বললাম, ঘন দুর্যোগ। এই দুর্যোগটা শিগগিরই আসছে এবং সেটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। তারপর তো অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো। এক দিনের একটা বক্তৃতায় কীভাবে দেশের একজন নেতা এত চমক দিতে পারেন, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবকে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। কিন্তু কোনো দিন ভাবিনি যে তিনি প্রত্যেকটি মানুষের, শুধু তাদের অনুভূতিই নয়, তাদের আনুগত্য এইভাবে আদায় করতে সক্ষম হবেন। অসহযোগ আন্দোলনের সেই ইতিহাসে, আমি বলব মহাত্মা গান্ধীর উত্তরসূরি হিসেবে শেখ মুজিব পৃথিবীতে আরেকটা দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন। সেই অসহযোগ আন্দোলনের যে সার্থকতা, তার যে পুরোপুরি সফলতা, এটা আমরা সকলেই উপলব্ধি করেছি। কিন্তু আমরা বুঝতে পারিনি যে একদিকে অসহযোগ আন্দোলন চলছে আর অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে প্রস্তুতি, সেটা একটা সুনির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। (ঈষৎ পরিমার্জিত)
অবরুদ্ধ ঢাকা ১৯৭১, গোপন প্রতিরোধকারীদের সাক্ষাৎকার (সম্পাদনা: রাশেদুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০২১) গ্রন্থ থেকে
এম আর চৌধুরী (মুজিবুর রহমান চৌধুরী): বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা। পূর্ব পাকিস্তানে মে অ্যান্ড বেকার কোম্পানির প্রধান ছিলেন।