বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক সরকার যখন পূর্ব পাকিস্তানে সমন্বিত সামরিক অভিযান শুরু করে, তখন এই অংশে তাদের শক্তি ছিল ৩০ হাজার অবাঙালি সেনা। তারা তাদের সমরাস্ত্রের বিধ্বংসী ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে পূর্ব পাকিস্তানের শত্রু মনোভাবাপন্ন নিরস্ত্র জনগণকে দমন করতে হয়েছিল বেপরোয়া। দ্রুতগতিতে নিশ্চিত বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারীরা আক্রমণের সব প্রধান বিষয়ে বিশদ ছক এঁকে নিয়েছিলেন। সেগুলো ছিল: ১. দীর্ঘস্থায়ী সামরিক অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ; ২. ভারতের আকাশসীমায় পাকিস্তানের বিমান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আরও সৈন্য পাঠানো, অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ অব্যাহত রাখার বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ; এবং ৩. মূল আক্রমণ শুরু করার আগের কৌশল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের হতবিহ্বল, বিভ্রান্ত ও নেতৃত্বহীন করে ফেলা।

পাকিস্তান ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রথম দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন দুটি সামরিক জোট সাউথ-ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিয়াটো) ও বাগদাদ চুক্তির (পরবর্তীকালে সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সেনটো নামে পরিচিত) সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের যুগে অস্ত্র ও গোলাবারুদের যথেষ্ট মজুত গড়ে তুলেছিল। পাকিস্তান এক দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরবরাহ ও অর্থনৈতিক সাহায্য পেয়ে আসছিল, এভাবে সামরিক সামর্থ্য বৃদ্ধি করেছিল এবং ১৯৬৫ সালে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকে ‘স্বাধীন করতে’ ভারতের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ বাধিয়ে সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত ছিল, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ কোনো অকমিউনিস্ট প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না। পাকিস্তান সেই শর্ত ভঙ্গ করায় যুক্তরাষ্ট্র অবিলম্বে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা বন্ধ করে দেয় এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা কমিয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র অন্য একটি বিবেচনায় ১৯৬২ সাল থেকে ভারতকেও যে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছিল, চীন-ভারত সীমান্তে সংঘর্ষ শুরু হলে সেটাও বন্ধ করে দেয়।

জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তাসখন্দে ভারত-পাকিস্তানের সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে আইয়ুব খানের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে থাকতেই ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ থেমে যায় এবং এর ফলে পাকিস্তানের অপ্রতিরোধ্য শাসক হিসেবে তাঁর পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

পাশ্চাত্যের সাহায্য স্থগিত হয়ে যাওয়া এবং সরকারি ব্যয় ক্রমে কমে যাওয়ার ফলে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার সব বিরোধী দলের ঐক্যজোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ তাদের ২১ দফা দাবিতে যে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছিল, এক দশক পরে তা আবারও সামনে চলে আসে। পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখায় প্রস্তাব করা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব শুধু জাতীয় প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও মুদ্রা ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, প্রদেশগুলোর বাকি সব বিষয় প্রাদেশিক সরকারের কর্তৃত্বের আওতায় চলে যাবে। এই দাবিতে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয় ঘটে। ১৯৬৬ সালে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ‘ছয় দফা দাবি’ আকারে সামনে নিয়ে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান।

এর আগে ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের নেতা থাকার সময় পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরিয়ে রেখেছিল। ১৯৬৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পরেই শুধু তাঁর পরবর্তী নেতা ও প্রবল অনুসারী শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের ইশতেহারে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি যুক্ত করেন।

রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ ইয়াহিয়ার

১৯৬৫ সালের যুদ্ধে অসফল হওয়ার পর আইয়ুব খান যখন জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংকটের মুখোমুখি হচ্ছিলেন, তখন পাকিস্তানের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল লাহোরে এক গোলটেবিল সম্মেলনে মিলিত হয়ে ‘এক ব্যক্তির শাসনের’ অবসানকল্পে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। শেখ মুজিব সেই গোলটেবিল সম্মেলনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ‘ছয় দফা কর্মসূচি’ উপস্থাপন করে অন্যদের বিস্ময়ের উদ্রেক করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করত এমন কয়েকটি রাজনৈতিক দলও সেই গোলটেবিল সম্মেলনে উপস্থিত ছিল, তারা শেখ মুজিবের দাবির সঙ্গে একমত হয়নি। ফলে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হয় এবং আইয়ুব খানকে অপসারণের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়। আইয়ুব খান এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নেন; তিনি ছয় দফাকে পাকিস্তান ভাঙা ও পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত হন। তিনি শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেন এবং ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিব ও আরও ৩৩ জনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে ‘ভারত থেকে অস্ত্র আনার ষড়যন্ত্রের’ দায়ে অভিযুক্ত করে একটি মামলা সাজান।

default-image

প্রকাশ্য আদালতে মামলাটির শুনানি হয়; শেখ মুজিবের ‘গর্হিত অপরাধ’ উন্মোচনের উদ্দেশ্যে আইয়ুব খান আদালতের শুনানির বিবরণী সংবাদপত্রগুলোতে ছাপানোর অনুমতি দেন। কিন্তু তত দিনে তাঁর শাসন এতটাই অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছিল যে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তাঁর প্রচারণাই শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতায় পরিণত করে।

১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ১৭ দিনের যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে; এর ফলে একই রাষ্ট্রকাঠামোয় পাকিস্তানের দুই অংশের একত্র থাকার বিশ্বাসে চিড় ধরে। এই পটভূমিতেই ওপরে উল্লিখিত ঘটনাবলি ঘটে চলেছিল।

১৯৬৮ সালের জানুয়ারির শেষে আইয়ুব খান গুরুতর হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। সেই সুযোগে সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাংবিধানিক বিধান ভেঙে আইয়ুব খানের পক্ষে রাষ্ট্রের নির্বাহী ফাইলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেন। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে তাঁর দায়িত্ব পালন করার কথা জাতীয় পরিষদের স্পিকারের।

কয়েক মাস পর আইয়ুব খান যখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ফিরে আসেন, তত দিনে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি খাতে যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক সংকট গভীরতর হয়ে ওঠে। গুরুতর শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়, পাশাপাশি অধিকাংশ রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। সাধারণ পুলিশি পদক্ষেপের মাধ্যমে শ্রমিক অসন্তোষের বিস্তার রোধ করা অসম্ভব হয়ে উঠলে আইয়ুব খান সেনাবাহিনী তলবের উদ্যোগ নেন। কিন্তু সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান বলেন, সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হলে সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে হবে এবং সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পৃথক একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে কিছুটা প্রশমিত করা গিয়েছিল, কিন্তু শ্রমিক অসন্তোষ অব্যাহত ছিল। ইয়াহিয়া সারা দেশে সামরিক শাসন জারি না করা পর্যন্ত সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিরোধিতা করে যেতে থাকেন। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২৬ মার্চ সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান অস্ত্র ব্যবহার ছাড়াই অনায়াসে রাষ্ট্রক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেন।

যুক্তরাষ্ট্র–পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন মোড়

ইয়াহিয়া ক্ষমতা গ্রহণের দুই মাস আগে, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন রিচার্ড নিক্সন। আগের বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হুবার্ট হামফ্রের বিরুদ্ধে জয়ী হন। ডেমোক্রেটিক পার্টি জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল প্রধানত ভিয়েতনাম যুদ্ধে তাদের সংশ্লিষ্টতার কারণে, যে যুদ্ধ আমেরিকার জন্য বিপর্যয়কর হয়েছিল।

রিচার্ড নিক্সন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৬৯-৭০ সময়জুড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার করার লক্ষ্যে কিছু আগাম পরিকল্পনা করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার। তিনি চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়নের পথ খুঁজতে শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে নতুন চীনের অভ্যুদয় ঘটে, তার পরের দীর্ঘ দুই দশকেও যুক্তরাষ্ট্র চীনকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়নি। প্রেসিডেন্ট নিক্সন পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিকল্পনা করেন। চীন ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ও সমর্থনদাতা; প্রেসিডেন্ট নিক্সন অনুভব করেন, যুক্তরাষ্ট্রে ভীষণভাবে জননিন্দিত ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে আলোচনার মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে হলে চীনকে সংলাপে আনা প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গিতে উপনীত হন যে যেহেতু এযাবৎ চীনের সঙ্গে বার্তা বিনিময়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র মাঝেমধ্যে পাকিস্তানকে ব্যবহার করেছে, তাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহে চলমান নিষেধাজ্ঞা থেকে পাকিস্তানকে অব্যাহতি দিলে যুক্তরাষ্ট্র উপকৃত হবে।

অন্যদিকে পাকিস্তানের সমরযন্ত্রকে আগের শক্তিশালী অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর ওপর নিজের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করার জন্য ইয়াহিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ পুনর্বহাল করা। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তিনি এই লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৯ সালের ২৯ মার্চ ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র তিন দিন পরেই তিনি তাঁর উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী, পাকিস্তান নৌবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আহসানকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান। অ্যাডমিরাল আহসান যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে প্রথমে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে, পরে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ পুনর্বহাল করার জন্য তদবির শুরু করেন। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক যন্ত্রাংশ সরবরাহ পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত সুনির্দিষ্ট রূপ পায় ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে, যখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন এশিয়ায় তথ্যানুসন্ধানী সফরে বেরিয়ে লাহোরে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

ইয়াহিয়ার ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রচেষ্টা

শুধু সামরিক শক্তির ওপরে নির্ভর করে দেশ পরিচালনা করা আর সম্ভব হবে না—এটা উপলব্ধি করে ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা লাভের পথও খুঁজতে শুরু করেন। তিনি একটি বা একাধিক রাজনৈতিক দল খুঁজছিলেন, যারা জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারবে, আবার একই সঙ্গে তাঁকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করবে এবং সংবিধান প্রণয়নকালে কেন্দ্র ও প্রদেশগুলোর মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেবে না। তিনি ধারণা করেন, আওয়ামী লীগ এককভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের জয়ী হতে পারে; কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান দেশের সর্বাধিক জনসংখ্যার প্রদেশ হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় শাসনযন্ত্রের ওপর তেমন কোনো প্রভাব খাটাতে পারবে না, কারণ পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল নগণ্য। ইয়াহিয়া যাঁদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার কথা ভেবেছিলেন, তাঁদের তালিকায় শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ছিল সম্ভবত এসব বিবেচনার কারণেই।

ইয়াহিয়ার পক্ষে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগের অভাব ছিল না। হাসান জহির লিখেছেন, ‘আইয়ুববিরোধী আন্দোলন আপনাআপনিই শক্তিশালী হয়ে উঠছিল’, এবং ‘ঢাকাসহ যেসব বড় শহরে পরিস্থিতি বেসামরিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, সেখানে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ঘন ঘন সেনাবাহিনী তলব করা হচ্ছিল।’ বিরোধী দলগুলোর ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির (ডাক) প্রধান নেতাদের সঙ্গে আইয়ুব খানের আলোচনা অবিলম্বে তাঁর পদত্যাগ ও ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র পুনর্বহালের দাবিতে আটকে গেলে ঢাকায় চলমান অচলাবস্থায় শেখ মুজিবকে ঢাকা সেনানিবাসের আটকাবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়, যাতে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠেয় গোলটেবিল কনফারেন্সে ডাক-এর নেতাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেন।

শেখ মুজিব রাওয়ালপিন্ডি যাওয়ার আগে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক জনসভায় দাবি করেন, জনসংখ্যার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে এবং ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ডাক-এর নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতভিন্নতা আছে, এটা ঘোষণা করা তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু সেটা ছিল স্পর্শকাতর বিষয়, কারণ তিনি আইয়ুব খান ও সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে পরবর্তী সেনাশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ডাক-এর নেতাদের কৌশলগত মিত্র হিসেবে নিজের পাশে রাখতে চেয়েছিলেন।


ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম