বিজ্ঞাপন
default-image

আইয়ুব খান ক্ষমতা ধরে রাখতে সংকট মোকাবিলার এক অদ্ভুত উদ্যোগ নেন। তিনি সেনাপ্রধান ইয়াহিয়াকে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এই মর্মে রাজি করানোর প্রয়াস নেন যেন মুজিব রাওয়ালপিন্ডি গোলটেবিল কনফারেন্সে তাঁর ছয় দফা দাবিতে অটল থাকেন। আইয়ুব এটা করেন পাকিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের ঐক্যে ভাঙন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। এই ঘটনা সুবিদিত নয়, এটি সম্পর্কে লেখা হয়েছে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ও পাকিস্তানের ভাঙন বিষয়ে ১৯৭২ সালে গঠিত হামুদুর রহমান তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে:

‘অবশেষে গোলটেবিল কনফারেন্সটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালের ১০ মার্চ...কনফারেন্সের দুই অধিবেশনের মাঝখানে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বাসভবনে ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক একটি ঘটনা ঘটে। যখন এই ঘটনার সাক্ষ্যপ্রমাণ বেরিয়ে আসে, প্রথমে আমাদের কাছে তা অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমাদের পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব হচ্ছিল না যে সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল ইয়াহিয়া খান, সেই সময় রাজনীতির প্রতি যাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না, তাঁকে আগাগোড়া রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসতে হবে। শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর কোনো ব্যক্তিগত সমীকরণ ছিল এটা বিশ্বাস করারও কোনো কারণ আমরা খুঁজে পাইনি। এই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে বৈঠকটির আয়োজন করেছিলেন জনাব আলতাফ গওহর, তিনি নিজেও সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন; জেনারেল ইয়াহিয়া এই বলে শেখ মুজিবকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন যে গোলটেবিল কনফারেন্সে আলোচনা ব্যর্থ হলে জেনারেল ইয়াহিয়া সামরিক আইন জারি করতে সম্মত হবেন না। মুজিবকে এটা বলার উদ্দেশ্য ছিল তিনি যেন নিজের অবস্থানে অনড় থেকে চরম প্রস্তাব পেশ করেন, তাঁর প্রস্তাব গৃহীত না হলে সামরিক আইন জারি হতে পারে এই ভয়ে যেন তা পেশ করা থেকে পিছিয়ে না আসেন। এটা স্পষ্ট যে চরম প্রস্তাবটি ছিল ছয় দফা, যা পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রবল বিরোধিতার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সুতরাং শেখ মুজিবকে যদি সংকটের রাজনৈতিক সুরাহার একটি শর্ত হিসেবে তাঁর ছয় দফা দাবিতে অনড় থাকতে সম্মত করানো যায়, তাহলে গোলটেবিল কনফারেন্স নির্ঘাত ব্যর্থ হবে।’

যেমনটি ধারণা করা গিয়েছিল, রাওয়ালপিন্ডি গোলটেবিল কনফারেন্সে শেখ মুজিব তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের পরপরই ১৯৬৬ সালের আলোচনার মতো এই আলোচনাও ভেস্তে যায়। কিন্তু তার ফলে আইয়ুব খানের ক্ষমতা বেশি দিনের জন্য রক্ষা পায়নি, তাঁর শাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে; কিন্তু সেটা যখন করা হয়, তখন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠেন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান।

অখণ্ড পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক: ধারণা করা যায়, শেখ মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়ার সম্পর্ক বিকশিত হতে থাকে। ইয়াহিয়া অচিরেই বুঝতে পারেন, সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার পুনর্বহালের পর দেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সেই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দলের সঙ্গে সহযোগিতা তিনি এড়াতে পারবেন না, এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়বে। এসব বিষয় বিশদভাবে খতিয়ে দেখার পর তিনি ১৯৬৯ সালের শেষ নাগাদ এই উপসংহারে পৌঁছান যে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিব তাঁর ছয় দফার পক্ষে স্বাধীনভাবে প্রচারণার সুযোগ চাইবেন এবং নির্বাচিত হলে একটি শিথিল ফেডারেল ব্যবস্থার প্রবর্তন চাইবেন। তবে ১৯৪০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সোহরাওয়ার্দীর আন্তরিক অনুসারী হিসেবে তিনি পাকিস্তানের ‘ঐক্য ও অখণ্ডতা’ রক্ষার পক্ষেই থাকবেন।

ইয়াহিয়া নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিলেন যে শেখ মুজিব ন্যূনতম ফেডারেল কাঠামোর বিরুদ্ধে যেতে বিশেষ আগ্রহী হবেন না; কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা ফেডারেল আয়-ব্যয়ের কর্তৃত্ব রাখার জন্য এটা প্রয়োজনীয় ছিল। তা ছাড়া পাকিস্তানের সব গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়ে আসছিল যে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, ফলে অর্থনৈতিক ও মুদ্রাসংক্রান্ত ক্ষমতা কেন্দ্রের হাত থেকে প্রদেশগুলোর কাছে হস্তান্তরের লক্ষ্যে তারা তাদের ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সুযোগ পাবে না। ইয়াহিয়া নির্বাচনী প্রচারণায় পূর্ণ স্বাধীনতা দেন, তার ফলে শেখ মুজিব প্রায় এক বছর ধরে তাঁর সোনার বাংলার বার্তা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পান। ইয়াহিয়ার বিপরীত পক্ষ তাঁকে কী চোখে দেখতেন এ বিষয়ে কোনো নথিপত্র নেই; তবে সম্ভবত তাঁকে সাধারণ পাঞ্জাবি সেনাচরিত্র হিসেবে দেখা হচ্ছিল না, কারণ তিনি ছিলেন পশতুভাষী পিতা–মাতার সন্তান এবং পাঞ্জাবনিয়ন্ত্রিত ‘এক ইউনিট’ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার প্রয়াসের প্রতি সহানুভূতিশীল।

পাকিস্তান তার ২৩ বছরের স্বাধীন অস্তিত্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পেরেছিল এবং তার মধ্য দিয়ে পরবর্তী সময়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। এসব ঘটেছিল ১৯৬৯-১৯৭১ কালপর্বের ঘটনাপ্রবাহ ও ব্যক্তিদের মিথস্ক্রিয়ার ফলে।

সাধারণ নির্বাচন অনুমোদনের আগে ইয়াহিয়া সম্ভবত ভেবেছিলেন, আওয়ামী লীগের ছয় দফা যেহেতু সম্পূর্ণভাবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক দাবিনামা, তাই তা পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থের মহলকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেবে এবং তারা তাদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করবে। তিনি আওয়ামী লীগের ছয় দফার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। এই অধ্যাদেশবলে প্রেসিডেন্ট ‘শক্তিশালী কেন্দ্রের’ প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন যেকোনো সাংবিধানিক প্রস্তাব খারিজ করে দিতে পারতেন; এমনকি গণপরিষদ (কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) ১২০ দিনের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য সংবিধানের প্রস্তাব দিতে না পারলে গণপরিষদই ভেঙে যেত।

কিন্তু দেখা গেল, বিপুল পরিমাণ গোয়েন্দা তথ্য, এলএফওর মাধ্যমে পরিস্ফুট কঠোর হুঁশিয়ারি এবং নির্বাচনের প্রত্যাশিত ফলের বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটলে তার ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ইয়াহিয়া ও মুজিবের মধ্যে নির্বাচনপূর্ব গোপন বোঝাপড়ার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ২৩ বছরের শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ।

১৯৭০ সালের ১২-১৩ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে; বিগত তিন শ বছরের ইতিহাসে সেটিই ছিল সবচেয়ে বিপর্যকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে লাখ লাখ বিপন্ন মানুষের টিকে থাকার সংগ্রামে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারি-বেসরকারি কোনো তৎপরতাই ছিল না। এতে অখণ্ড পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা সম্পন্ন হয়ে যায়।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ১৬০ আসনে জয়ী হন। আওয়ামী লীগের এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা কোনো অজুহাতেই আর এড়ানোর সুযোগ ছিল না। শেখ মুজিব এত দিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে যে স্বপ্ন দেখিয়ে আসছিলেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই স্বপ্নের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন।

default-image

ইয়াহিয়ার দুঃস্বপ্ন: নির্বাচনের ফলাফল ইয়াহিয়ার জন্যও একটি দুঃস্বপ্নরূপে দেখা দেয়। কারণ, তিনি দেশের প্রতিরক্ষা ব্যয়, প্রশাসনিক ও উন্নয়নবিষয়ক অঙ্গীকারগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নির্বাচনের বিপর্যয়কর ফল প্রকাশের পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে অদূর ভবিষ্যতে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে পরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দেন। ‘পরিকল্পনাটি ছিল যেকোনো গণ-অভ্যুত্থান থেকে উদ্ভূত গুরুতর সংকট ও সামরিক আইনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ মোকাবিলা করা। তাঁরা ধারণা করেছিলেন গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হতে পারে, নির্বাচনের ফলাফল অগ্রাহ্য করতে বামপন্থীরা নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনে নেমে পড়তে পারে, কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অ্যাসেম্বলির বাইরে গণ-আন্দোলন শুরু করতে পারে।’

১৯৭০ সালের ২১ জানুয়ারি ইয়াহিয়া ঢাকা আসেন; তার পরের পাঁচ দিন ধরে তিনি শেখ মুজিবকে ছয় দফার কয়েকটি কঠোর শর্ত নমনীয় করতে রাজি করাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। তারপর তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা করতে ১৭ জানুয়ারি লারকানা যান। পিপিপি জাতীয় পরিষদে ৮৩টি আসনে জয়ী হয়েছিল। ভুট্টো আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের ঘোর সমর্থক ছিলেন; সেই যুদ্ধে অপমানজনক পরাজয়ের পর আইয়ুব খানকে তাসখন্দে যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করতে হয়েছিল, ভুট্টো তার বিরোধিতা করার কারণে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। তারপর তিনি স্বতন্ত্রভাবে সরকারবিরোধী রাজনীতি শুরু করেন; তাঁর বক্তৃতা ‘রোটি, কাপড়া আওর মোকাম’ সিন্ধু ও পাঞ্জাবের জনসাধারণ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। নির্বাচনে তাঁর সাফল্যের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে তাঁর অনেক নতুন অনুসারী সৃষ্টি হয়, যাঁরা সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর থেকে এবং বিশেষত শেখ মুজিবের দাবির প্রতি ইয়াহিয়ার অব্যাহত আপসকামী প্রবণতা লক্ষ করে ক্রমেই আরও চিন্তিত হয়ে পড়ছিলেন।

ইয়াহিয়া আলোচনা করার জন্য সিন্ধু প্রদেশের লারকানায় ভুট্টোর বাড়িতে যাওয়ার সময় যাঁদের সঙ্গে নেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস জি এম পিরজাদা, সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান ও চিফ অব আর্মি ইন্টেলিজেন্স উমর। এই ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সবাই তত দিনে হয় মুজিববিরোধী, নয় ভুট্টোপন্থী হয়ে উঠেছিলেন; সবাই অবগত ছিলেন যে ইয়াহিয়া ঢাকায় গিয়ে রাজনৈতিক কানাগলিতে পৌঁছে গেছেন। আওয়ামী লীগের ছয় দফার মধ্যে পাকিস্তানের ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি এবং তা নিরসনে ইয়াহিয়ার অক্ষমতার বিষয়ে ভুট্টো ও সেনা কমান্ডারদের দৃষ্টিভঙ্গির মিল ছিল বলে প্রতীয়মান হয়েছিল।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রতি আহ্বান: নিজের নেতৃত্বের জন্য সেনাবাহিনীর ভেতরে গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে, এই আশঙ্কায় ইয়াহিয়া লারকানা থেকে ইসলামাবাদ ফিরে চিন্তা করেন এখন কী করা উচিত। অবশেষে ২৭ জানুয়ারি তিনি পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডকে নিজের বাসভবনে ডাকেন। ইয়াহিয়া ফারল্যান্ডকে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে চলমান আলোচনা প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে পাকিস্তানের ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করেন এবং দৃঢ়ভাবে বলেন যে তিনি তা ঘটতে দিতে পারেন না; পাকিস্তানের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে তিনি সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া স্থগিত করবেন। রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতি হলো পাকিস্তানের ঐক্য ও অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।’

‘পাকিস্তানের ঐক্য ও অখণ্ডতা’র প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ‘শ্রদ্ধাশীল’ থাকার নীতির অর্থ একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। এর অর্থ এমন ছিল না যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিচ্ছেদ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেবে; কিন্তু এটাও জানা ছিল যে পাকিস্তান সেই লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত অস্ত্র-সরঞ্জামসহ সব সামরিক সামর্থ্য প্রয়োগ করবে। পাকিস্তানের অস্ত্রভান্ডার ও সামরিক সরঞ্জামের ৮০ শতাংশই ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া। দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম গ্রন্থের লেখক গ্যারি জে বাস যেমনটি উল্লেখ করছেন, ‘চলমান আক্রমণের জন্য বিপুল পরিমাণ সামরিক শক্তির প্রয়োজন; সম্ভবত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্মসজ্জিত চারটি ডিভিশন এবং পাকিস্তান বিমানবাহিনীকেও কাজে লাগাতে হবে। এই সমুদয় ক্ষেত্রে পাকিস্তান ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের ওপর; সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সামরিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে প্রয়োজন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র, গোলাবারুদ, খুচরা যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে সবকিছু—ট্যাংক ও সি-১৩০ পরিবহন বিমান পর্যন্ত, যেগুলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল। আক্রমণ শুরু হলে বাঙালিরা মার্কিন কূটনীতিকদের অনুরোধ করেছিল, আমেরিকার সরবরাহ করা অস্ত্র যেন “গণহত্যা”য় ব্যবহার করতে দেওয়া না হয়।’ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় পাওয়া আমেরিকান অস্ত্রশস্ত্র কোনো কমিউনিস্ট দেশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্যবহারে কোনো বাধানিষেধ স্নায়ুযুদ্ধের সময় ছিল না। দেশের অভ্যন্তরে গণবিক্ষোভের পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টপন্থী সংগঠনগুলোর নাশকতা প্রতিহত করার কাজেও মার্কিন অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহারের অনুমোদন ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের জানুয়ারির শেষে পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কাকে যেভাবে দেখা হচ্ছিল, সে ক্ষেত্রে উল্লিখিত দুটি শর্তের কোনোটিই প্রযোজ্য ছিল না।

[স্থানাভাবে সূত্র উল্লেখ করা হলো না। লেখকের বইয়ে সূত্র যথাযথভাবে উল্লেখিত হবে]

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম