বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এই বছর। রক্তাক্ত জনসংগ্রাম ও অভূতপূর্ব বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে মু্ক্তিযুদ্ধের নানামাত্রিক পাঠ জরুরি। এ বিষয়ে তাৎপর্যবহ সংযোজন প্রথমা প্রকাশনের মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থমালার ছয়টি বই। সাজ্জাদ শরিফ সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ: সূচনা থেকে সমাপ্তি, মতিউর রহমান সম্পাদিত সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে এবং সাজ্জাদ শরিফ সম্পাদিত আরও চারটি বই—মুক্তিযুদ্ধের নায়কেরা, মুক্তিযুদ্ধের ১০টি তারিখ, মুক্তিযুদ্ধে নানা দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। গ্রন্থমালা উৎসর্গ করা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের অমর শহীদদের’।

default-image

মুক্তিযুদ্ধ: সূচনা থেকে সমাপ্তি
বইটি বাংলাদেশের বিজয়ের তারিখ ১৬ ডিসেম্বরের প্রতীকে ১৬টি লেখায় মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিবৃত্ত। বিষয় স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা, গণহত্যা, মুজিবনগর সরকার, পাকিস্তানি মন, ভারতের ভূমিকা, শরণার্থী, স্বাধীন বাংলা বেতার, অবরুদ্ধ স্বদেশ, জনযুদ্ধের মাত্রা, নারীর মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিসংগ্রামে সংস্কৃতির বিশ্বজনের ভূমিকা, পরাশক্তি ও জাতিসংঘ, বিদেশি গণমাধ্যম, বিশ্ববিবেক, বুদ্ধিজীবী হত্যা ও বিজয়। লিখেছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশিষ্টজনেরা। এই বই যেন মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিকতার চকিত-অবলোকন।

default-image

সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে
ভূমিকায় বইয়ের সম্পাদক মতিউর রহমান জানান, ‘যোদ্ধারা যেভাবে তাঁদের রচনা আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন, আমরা সেভাবেই সেসব প্রকাশের চেষ্টা করেছি।’
১৮ জন মুক্তিযোদ্ধার কলমে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মুক্তিযুদ্ধের দুঃসাহসিক লড়াইগুলোর প্রামাণ্য ইতিহাস উঠে এসেছে। বিভিন্ন অঞ্চলের যুদ্ধস্মৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্লভ মানচিত্র, নকশা, নথি ও আলোকচিত্র। ‘চরম আঘাতের সেই রাত: চট্টগ্রামে প্রতিরোধযুদ্ধ’ লেখায় ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম সাক্ষ্যটি শুধু চট্টগ্রাম নয়, পুরো বাংলাদেশেরই একাত্তরকালীন অবস্থা, ‘পাকিস্তানি সেনারা যেসব বাঙালিকে পোর্টে হত্যা করে নৌবাহিনীর গানবোটে করে লাশ ফেলে আসে বঙ্গোপসাগরে, সেসব হতভাগ্য বাঙালির লাশের সন্ধানেই শকুনেরা দল বেঁধে উড়ছিল পুরো এলাকায়। শান্তির প্রতীক সাদা গাংচিলগুলো সেদিন যে কোথায় চলে গিয়েছিল, তা কেউ বলতে পারবে না।’

default-image

মুক্তিযুদ্ধের নায়কেরা
ভূমিকায় সম্পাদক বলেছেন, ‘রাজনীতি, কূটনীতি, যুদ্ধক্ষেত্র, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র, আন্তর্জাতিক অঙ্গন—নানা ক্ষেত্রে নানা ব্যক্তির অংশগ্রহণ ও অবদান এ যুদ্ধে আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল।’

অনন্য সেসব মানুষের মধ্যে আছেন মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু এবং প্রবাসী সরকারের কান্ডারি তাজউদ্দীন আহমদ, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দৃপ্ত কণ্ঠস্বর আবু সাঈদ চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের পরম বিদেশি বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ, কূটনীতিক পি এন হাকসার, ডি পি ধর, জাতিসংঘে সোভিয়েত স্থায়ী প্রতিনিধি ইয়াকফ মালিক, মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, ফরাসি বুদ্ধিজীবী অঁদ্রে মালরো, মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ প্রমুখ।

সাজ্জাদ শরিফের লেখায় অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা রচনা ও প্রাসঙ্গিক ঘটনাপ্রবাহ উঠে এসেছে—‘কবিতা লিখেই অ্যালেন গিন্সবার্গ বসে রইলেন না। মার্কিন চেতনার গভীরে বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশার কথা কী করে পৌঁছানো যায়, এ দুর্দশা দূর করতে কীভাবে মার্কিন জনতাকে সক্রিয় করে তোলা যায়, সে ভাবনায় তিনি অস্থির হয়ে রইলেন। একটি কবিতা পাঠের আয়োজন করলেন তিনি।

নিউইয়র্কের সেই কবিতার আসরে যুক্তরাষ্ট্রের কবি গিন্সবার্গ আর রুশ কবি আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কি হয়ে উঠলেন মধ্যমণি। একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে গিন্সবার্গ আর ভজনেসেনস্কি বিশ্বকে বার্তা দিলেন, রাষ্ট্র যা-ই ভাবুক বা করুক, কবিরা আছেন বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে।’

default-image

মুক্তিযুদ্ধের ১০টি তারিখ
এখানে আছে ৭ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ নয় মাস কালখণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ ১০টি তারিখের দুষ্প্রাপ্য তথ্য ও সবিস্তার বিশ্লেষণ। সঙ্গে আছে তারিখ-সংশ্লিষ্ট স্মৃতিচারণা কিংবা কালজয়ী কবিতার সংযোজন। যেমন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে আবুল মোমেনের বিশ্লেষণ, ড. কামাল হোসেন, রফিকুন নবী বা সুলতানা কামালের স্মৃতিভাষ্যের সঙ্গে আছে নির্মলেন্দু গুণের সেই অনন্য কবিতা ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’। ১ আগস্ট ১৯৭১ তারিখের ভুক্তিতে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে মতিউর রহমানের প্রবন্ধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রবিশঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসনের সে কনসার্টের স্মৃতি। মতিউর রহমান বলেছেন একটি স্বপ্নের কথা, ‘এ রকম একটি দৃশ্যের কথা ভেবেছি বহুদিন—যে দেশটির জন্য, যেসব মানুষের জন্য একদিন তাঁরা সোচ্চার হয়েছিলেন সেই দেশে, এক বিশাল মঞ্চে তাঁরা আসীন। আর লাখ লাখ বাঙালি তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কৃতজ্ঞচিত্তে।’

default-image

মুক্তিযুদ্ধে নানা দেশ
ছয়টি দেশ পাকিস্তান, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন এবং জাতিসংঘের ভূমিকার বিশদ আলোচনা-পর্যালোচনা পাওয়া যাবে এই ব্যতিক্রমী বইয়ে।
আবু মো. দেলোয়ার হোসেনের পাকিস্তান নিয়ে লেখার শিরোনাম যেমন ‘শত্রুর নিষ্ঠুর মুখচ্ছবি’, তেমনই ভারত নিয়ে লেখার মোহাম্মদ সেলিমের লেখায় উপযুক্ত শিরোনাম ‘বন্ধুর সহমর্মী হাত’। নানা দেশ ও পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা নিয়ে আলোচনার সঙ্গে পত্রিকার প্রতিবেদন, বার্তা, বিবৃতি, কথোপকথন, আবেদনপত্র, গান ইত্যাদির সংযোজন বইটির গুরুত্ব বাড়ি দিয়েছে বহুগুণ। একনজরে যেমন পাওয়া যাচ্ছে ইয়াহিয়াকে পাঠানো নিকোলাই পদগোর্নি কিংবা চৌ এন লাইয়ের বার্তা, তেমনি আছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রিচার্ড নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জারের কথোপকথন। সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এ পূর্ব বাংলায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সংগঠনগুলোর তৎপরতার বার্ষিক প্রতিবেদনে মহাসচিব উ থান্টের মুখবন্ধের উদ্ধৃত অংশবিশেষে বিশ্ব সংস্থাটির প্রধানের দ্বিধাগ্রস্ত মনের পরিচয় মেলে।

default-image

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
মুক্তি, অসাম্প্রদয়িকতা, সাম্য, মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং বাঙালিত্ব—মুক্তিযুদ্ধের এই ছয়টি প্রত্যয় নিয়ে আলোচনা করেছেন রেহমান সোবহান, আনিসুজ্জামান, আজিজুর রহমান খান, সুলতানা কামাল, মাহফুজ আনাম এবং গোলাম মুরশিদ। রেহমান সোবহানের কাছে ‘মুক্তি’ মানে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ। আনিসুজ্জামান উদ্বেগের সঙ্গে বাংলাদেশে নির্বাসিত অসাম্প্রদায়িকতাকে আহ্বান করেন ‘ফিরে এসো পলাতকা’ বলে। আজিজুর রহমান খান সাম্যের স্বপ্নে উদিত বাংলাদেশে বৈষম্যের বিকাশ দেখে শঙ্কিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানবাধিকারকে সমার্থক মনে করেন সুলতানা কামাল। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশই হয়ে ওঠে না, যদি না এই কথাটিকে আমরা সত্য করে তুলতে না পারি যে—বাংলাদেশ সব মানুষের দেশ।’