বিজ্ঞাপন
default-image

৩ মার্চের বিকেলে পল্টন ময়দানে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ডাকে এক বিশাল জনসভায় আমি হাজির ছিলাম। বিভিন্ন ছাত্রনেতা এই সভায় ভাষণ দেয়। সব বক্তাই ঘোষণা করে যে আমাদের এখন উচিত স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ানো। পরের দিন এর চেয়েও বড় জনসভায় বক্তব্য দিলেন বঙ্গবন্ধু। যে ভাষণে তিনি যে ইয়াহিয়ার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচরণ করবেন, সেটা স্পষ্ট করে দেন এবং পূর্ণ অসহযোগ কর্মসূচি চালু করার কথা ঘোষণা করেন।

অসহযোগ প্রাথমিক পর্ব সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিল না। জেনারেল ইয়াকুব অপারেশন ব্লিৎজ পুরোপুরি কার্যকর করেননি, যার মাধ্যমে সম্ভবত বঙ্গবন্ধুসহ সব প্রধান রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনা ছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইয়াকুব বুদ্ধিমানের মতো বুঝেছিলেন যে এমন কিছু করা দুঃসাধ্য এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন হবে। যা-ই হোক, তিনি সান্ধ্য আইন জারি করেন এবং সামরিক শক্তির চেহারাটা পর্যাপ্ত প্রদর্শিত হয়। তাঁর মনে হয়েছিল পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য এটাই যথেষ্ট হবে এবং ইয়াহিয়া ও মুজিবের মধ্যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরির সময় পাওয়া যাবে। ইয়াকুবের সামরিক ও রাজনৈতিক হিসাব মেলেনি। যে বাঙালির দুর্নাম ছিল তারা সৈন্য দেখলে অথবা গোলাগুলির আওয়াজ পেলে পালিয়ে যায়, তারা ভিন্ন চরিত্রের প্রমাণিত হলো। অভূতপূর্বভাবে তারা সান্ধ্য আইন অমান্য করে দেখিয়ে দেয় সেনাবাহিনীর বন্দুকের মুখে বুক পেতে দিতে তারা রাজি আর রাজি মরণের ঝুঁকি নিতে। সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে অনেক মানুষ নিহত হয়। যদিও অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিকে স্থানীয় পুলিশ বাঙালিদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করেছিল। সরকারি, বেসরকারি সব সংস্থা, সব কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি আদালতও অচল হয়ে যায়।

জেনারেল ইয়াকুব যখন বুঝতে পারেন যে সেনা দিয়ে কোনো সমাধান হবে না, তখন ৪ মার্চ ১৯৭১ সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে নেওয়া হলো। ওই মুহূর্তে কার্যত তিনি পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং এভাবেই ২৪ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের ওপর পর্দা নেমে এসেছিল। ঢাকায় এসে স্বয়ং পরিস্থিতির সামাল দিয়ে রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার জন্য ইয়াহিয়াকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার পদ থেকে ইস্তফা দেন ইয়াকুব। ৫ মার্চ ইয়াহিয়াকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে তিনি জানান:

‘প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে শেখ মুজিবের হাতে; সে এখন কার্যত সরকারের প্রধান এবং সমস্ত জনজীবন নিয়ন্ত্রণ করছে...আমি নিশ্চিত এমন কোনো সামরিক সমাধান নেই, যেটা বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থবহ হতে পারে। ফলে সামরিক সমাধান মিশন কার্যকর করার দায়িত্ব নিতে আমি অক্ষম—যে মিশনের অর্থ দাঁড়াবে ব্যাপক হারে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ হত্যা এবং যেটা কোনো সুস্থ লক্ষ্যে পৌঁছাবে না। এর পরিণতি হবে বিধ্বংসী (খাদিম হোসেন রাজা, আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি)

ইয়াহিয়া ইয়াকুবের পদত্যাগ গ্রহণ করে অবিলম্বে বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা খানকে গভর্নর ও চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর দুটো পদের কার্যভার নিতে পাঠান। ৭ মার্চ ঢাকায় টিক্কার আবির্ভাবই ইঙ্গিত ছিল যে বাঙালির স্বশাসন অর্জিত হওয়ার আগে অনেক রক্ত ঝরাতে হবে।

একটি জাতির জন্ম: বঙ্গবন্ধুর শাসন

৫ মার্চ নাগাদ ক্যান্টনমেন্টে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়া এক ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের মঞ্চ গড়ে দিয়েছিল, যার তুলনা বিশ্বে আগে কখনো কোথাও দেখা যায়নি। সমস্ত অসামরিক আমলা, পুলিশ বাহিনী এবং প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত অংশ প্রতিষ্ঠিত সরকারকে তাদের পরিষেবা দেওয়া বন্ধ করে। অসহযোগ আন্দোলন শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছায় যখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি বদরুদ্দিন সিদ্দিকী টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করলেন।

অসহযোগ আন্দোলনে ভিন্ন আর এক মাত্রা যোগ হলো যখন বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে সরকারি প্রশাসনের সর্বস্তর থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো হলো ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। আমলাদের অনুসরণ করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যেখানে তখন অবাঙালিদের আধিপত্য, তারাও তাদের সমর্থন দেওয়ার অঙ্গীকার করে। এ ধরনের অনেক আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছে দুনিয়া, কিন্তু আমি যত দূর জানি, এমন পর্যায়ে আগের কোনো আন্দোলন পৌঁছায়নি যেখানে প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী এবং আদালত শুধু যে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের হুকুম অমান্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই নয়, তার ওপর এমন একজন রাজনৈতিক নেতার প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছে, যার কোনো আনুষ্ঠানিক সরকারি পদ নেই।

default-image

রেসকোর্সে ৭ মার্চের বহু প্রত্যাশিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অনেকে আশা করেছিল, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন, একই সঙ্গে এ রকম আশঙ্কাও ছিল যে তিনি যদি এ ধরনের ঘোষণা করেন, তবে সামরিক বাহিনীর আসন্ন পূর্ণ পর্যায়ের গণহত্যার মুখবন্ধ হিসেবে কুর্মিটোলায় মজুত থাকা পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে সমাবেশে বোমাবর্ষণের নির্দেশ দেওয়া ছিল। এ আশঙ্কা যে সঠিক ছিল, তার সমর্থন মিলেছে খাদিম হোসেন রাজার স্মৃতিকথায়। তিনি লিখেছেন, ওই সময় তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে স্বাধীনতা ঘোষণার যেকোনো পদক্ষেপে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ হানবে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী।

আমি কামাল হোসেনের কাছে জানতে পারি, ৭ মার্চের আগে ৩২ নম্বর রোডে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের একটি নির্ধারক বৈঠক হয়, যেটা প্রায় সারা দিন-রাত ধরে হয়েছিল। পরের দিন জনসভায় বঙ্গবন্ধু কোন পথ অনুসরণ করবেন, সেটাই ছিল বৈঠকের আলোচ্য। সম্ভবত বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে বলিষ্ঠ সদস্যদের বক্তব্য ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার সময় এখনো আসেনি এবং মানুষকে এমন রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে নিয়ে আসার আগে জনসচেতনতা আরও সংহত করা প্রয়োজন। বস্তুত সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের কতখানি আছে, সে সম্বন্ধে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সামান্যই ধারণা ছিল এবং বাংলাদেশের ক্যান্টনমেন্টগুলোতে কর্মরত সেনাসদস্যদের মধ্যে বাঙালিদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বিষয়েও তাঁরা একেবারেই নিশ্চিত ছিলেন না।

বর্ষীয়ান নেতাদের বিপরীতে কাপালিক সিরাজ নামে পরিচিত সিরাজুল আলম খানের মতো আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্ম পুরোদমে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে অবিলম্বে স্বাধীনতা ঘোষণার সপক্ষে বলেছিল। ৭ মার্চের মিটিংয়ে হাজির হওয়ার আগে আমি আর নুরুল ইসলাম ইকবাল হলে যাই তরুণ প্রজন্মের মেজাজ বুঝতে। কাপালিকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যায়। তাকে বিষণ্ন দেখাচ্ছিল এবং সে আমাদের বলে যে স্বাধীনতার কোনো নাটকীয় ঘোষণা আশা করা যাবে না। দেখা গেল বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সেরা কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভাষণ দিয়েছেন, যেখানে স্বাধীনতা ঘোষণা না করেও তিনি স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন, স্বাধীনতার লড়াইয়ে নিজেকে সমর্পণের জন্য প্রস্তুত হতে হবে বাঙালিকে। এর ফলে আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা, অথবা আইনত না হলেও অন্তত কার্যত স্বাধীনতা অর্জনের একটা সুযোগ পাওয়া গেল।

পয়লা মার্চের আগে এই সংকটময় সময়ে উপরিউক্ত কিছু চিন্তা ফোরামে আমার লেখায় তুলে ধরি। এই লেখাগুলোতে ছয় দফা কার্যকর করার তাৎপর্য পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছিলাম। ফোরামের কলামে আমার লেখার সর্বজনীন থিম ছিল যে ছয় দফাই পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের অন্তিম সুযোগ। এর বাইরের পথ গণসংগ্রাম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পাকিস্তান ধারণার সঙ্গে আবেগের বাঁধন তখন খুব কম বাঙালিরই ছিল। একমাত্র প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, ছাড়াছাড়িটা সাংবিধানিক বিবর্তন পদ্ধতিতে হবে, নাকি সামরিক সংঘাতে হবে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ ১৯৭১ অনির্দিষ্টকালের জন্য সিএ অধিবেশন মুলতবি রাখার যে সিদ্ধান্ত নেন, আমার ধারণা, সেটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জলবিভাজিকা হয়ে দাঁড়ায়। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাংলাদেশজুড়ে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলন বাংলাদেশের সীমানায় পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অস্বীকার করে। এই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব আর পুনরুদ্ধার হয়নি। ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর পর পাকিস্তান সামরিক চক্রের কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের সব পরবর্তী চেষ্টা বাংলাদেশের জনগণ ভিনদেশি সামরিক দখলদারদের বলপ্রয়োগ করে অন্যায় অধিগ্রহণের প্রয়াস হিসেবেই দেখেছে।

বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের পূর্ণ সাফল্য অবিলম্বে বাংলাদেশের মধ্যে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় নাগরিক ও আর্থিক পরিষেবা বজায় রাখার সমস্যা তৈরি করে। সমস্ত শ্রমশক্তি, প্রশাসন এবং আইনরক্ষক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর অসহযোগের ডাকে সাড়া দেওয়ামাত্র বাংলাদেশে পাকিস্তান সরকারের সব পরোয়ানা আক্ষরিক অর্থে ক্যান্টনমেন্টগুলোর বাইরে অচল হয়ে পড়েছিল। দেশের আর্থিক এবং সামাজিক জীবন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া প্রতিরোধ করতে এই শূন্যস্থান পূরণের দরকার পড়ে। সুতরাং ৫ মার্চ ১৯৭১ ইয়াহিয়া তাঁর স্থানীয় সেনা কমান্ডার ইয়াকুবের পরামর্শ মেনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে সরিয়ে নিতে রাজি হওয়ার পর সারা দেশের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের ভার একযোগে বঙ্গবন্ধুকে নিতে হয়। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর সেই দিন থেকে বাংলাদেশ প্রথম স্বরাট হলো।

ক্যান্টনমেন্ট চৌহদ্দির বাইরে, বাংলাদেশের সীমানায় পাকিস্তানের সামরিক শক্তিশাসিত সার্বভৌম সরকারের হাত থেকে বঙ্গবন্ধুর হাতে ৫ মার্চ ১৯৭১ এই অনন্য কর্তৃত্ব হস্তান্তর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে আজকের রাজনৈতিক বিতর্ক একাধারে যুক্তিহীন ও অসার করে দেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার তারিখ যা-ই হয়ে থাক, সেটা বঙ্গবন্ধু করে থাকুন বা অন্য যে কেউ করে থাকুন, কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতার তারিখ হওয়া উচিত ৫ মার্চ ১৯৭১, যেদিন বাংলাদেশের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ন্যস্ত হয়েছিল। এই তারিখের পর, সামরিক শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানের যেকোনো পদক্ষেপকে সব বাংলাদেশি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আগ্রাসন বলে মনে করেছে। বাংলাদেশিদের জাতীয়তাবোধের এই উন্মেষ ২৫ মার্চ ১৯৭১-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তাদের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিফলিত হয়েছে।

জনতার রাজ

পাকিস্তান সরকার কার্যত তার কর্তৃত্ব বঙ্গবন্ধুর হাতে ছেড়ে দেওয়ার পর, অর্থনীতিকে সচল রাখতে বিভিন্ন দৈনন্দিন জটিল অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থ প্রেরণের ওপর এক্সচেঞ্জ নিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন, পাকিস্তানের টাঁকশাল থেকে নগদ টাকা জোগানে ছেদ পড়ার কারণে উদ্ভূত পাকিস্তানি মুদ্রার ভান্ডারের ওপর নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি, চালানের নীতি এবং আবশ্যিক পণ্য ও কাঁচামাল আমদানির মূল্য প্রদান পদ্ধতি—এ ধরনের প্রশ্নের সমাধান করা প্রয়োজন ছিল।

যে অর্থনীতিকদের দল ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের সহায়তায় এসব সমস্যা সমাধানে তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেনকে দায়িত্ব দিলেন বঙ্গবন্ধু। ধানমন্ডির ৬ নম্বর রাস্তায় নুরুল ইসলামের ভাড়া বাড়িতে শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের অর্থনৈতিক সচিবালয় বসল, যার নির্দেশনার কেন্দ্রস্থল ছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোড। সার্কিট হাউস রো-তে কামাল হোসেনের বাড়ি ছিল প্রশাসনের আর একটা কেন্দ্র। আমাদের কয়েকজন কিছু বাঙালি সরকারি কর্মচারী, নেতৃত্বস্থানীয় ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার নুরুল ইসলামের বাসায় নির্দিষ্ট সমস্যা পর্যালোচনায় নিয়মিত মিলিত হতাম। সেই সব মন্ত্রণা পরিশীলিত ডিক্রি বা নির্দেশনামা হিসেবে ৩২ নম্বর রোড অথবা কামাল হোসেনের বাড়ি থেকে প্রতি সন্ধ্যায় সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী নেতা, ব্যাংকারদের হাতে এবং প্রেস সার্কুলেশনে পাঠাতেন তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন।

স্থানীয় অর্থনীতির অবস্থা পর্যালোচনা ছাড়া অর্থনীতিকদের আর একটা কাজ ছিল, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে পরিস্থিতি অবহিত করা। প্রতিদিন বিদেশি প্রেসের নামী সাংবাদিকেরা নুরুল ইসলামের বাসায় এই অধিবেশনগুলোতে হাজির থাকতেন। এই সুপরিচিত সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর টিলম্যান এবং পেগি ডারডিন; দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর সিডনি শ্যানবার্গ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিবেদনের কারণে যাকে ঢাকা থেকে বিতাড়িত করে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং যার দরুন প্রায় পুলিৎজার পুরস্কার পেয়ে যাচ্ছিলেন শ্যানবার্গ; পিটার প্রেস্টন, পরে যে সম্পাদক হন; দ্য গার্ডিয়ান-এর মার্টিন উলাকট এবং মার্টিন অ্যাডেনি; দ্য টাইমস-এর পিটার হ্যাজলহার্স্ট; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সাইমন ড্রিং; দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সেলিগ হ্যারিসন; দ্য ওয়াশিংটন স্টার-এর হেনরি ব্র্যাডশার এবং এজেন্সি ফ্রান্স প্রেসের (এএফপি) আর্নল্ড জিটিন। এসব অভিজ্ঞ সাংবাদিক ঢাকায় এসেছিলেন কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সম্ভাব্য উত্থান বিশ্ব মিডিয়ার চোখে সেই সময়ের এমন এক নতুন ঘটমান খবর, যা এমনকি তখনকার অন্য প্রধান খবর ভিয়েতনাম যুদ্ধকেও ম্লান করে দিচ্ছে। এই খবর-সন্ধানী সাংবাদিকেরা তাঁদের সংবাদপত্রগুলোকে নিয়মিত তাঁদের পাঠকদের বাংলাদেশের ঘটনাবলির নাটকীয় উন্মোচন সম্পর্কে অবহিত রাখতে উন্মুখ ছিলেন।

  • উতল রোমন্থন: পূর্ণতার সেই বছরগুলো। সেজ পাবলিকেশন, ভারত। ২০১৮