বিজ্ঞাপন
default-image

শেষ প্রহেলিকা

ইয়াহিয়া এবং মুজিবের মধ্যে আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের মধ্যে কয়েকজনকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং কামাল হোসেনকে নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ দলকে সাহায্য করার জন্য ডেকে নেওয়া হয়েছিল। মেজর জেনারেল পীরজাদা, বিচারপতি কর্নেলিয়াস, এম এম আহমেদ এবং সরকারের আইনি নকশাকার নামে পরিচিত কর্নেল হাসান প্রমুখকে নিয়ে তৈরি ইয়াহিয়ার বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে একটা অন্তর্বর্তী সাংবিধানিক সমাধান খুঁজে বের করার লক্ষ্যে এই দল গঠন করা হয়। যেহেতু আলাপ–আলোচনার সবচেয়ে জটিল অংশ ছিল ছয় দফার অর্থনৈতিক দিকগুলো, যেমন রপ্তানি বাণিজ্যের আয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রানীতি এবং বিদেশি সাহায্যের বিষয়ে কথাবার্তা চালানোর অধিকার ইত্যাদি। ফলে আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক দলের পরিষেবা এ কাজে খুবই জরুরি হয়ে পড়ে। সে জন্য আলোচনার প্রতি সেশন শেষে আওয়ামী লীগ দলের সঙ্গে আমরা বসতাম ইয়াহিয়ার মুখ্য আর্থিক মধ্যস্থতাকারী এম এম আহমেদের দেওয়া পরামর্শগুলো নোট করে আমাদের প্রতিক্রিয়া পাঠানো অথবা আমাদের নিজস্ব বাস্তব প্রস্তাবগুলো পেশ করার জন্য। অন্দরমহলের এই প্রয়াসগুলো দীর্ঘ সেশনজুড়ে হতো, কিছু ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুও এই আলোচনায় অংশ নিতেন।

২৫ মার্চ এগিয়ে আসতে থাকলে শেষের দিনগুলোতে একটা চূড়ান্ত সেশন হয়েছিল মতিঝিলে কামাল হোসেনের আইন চেম্বারের সভাঘরে। এই অধিবেশনে পরের দিনের আলাপ–আলোচনার চূড়ান্ত অবস্থান স্থির করতে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড এবং তাদের উপদেষ্টাদের নিয়ে সারা রাত কাজ করেন বঙ্গবন্ধু। প্রয়োজনে হাজিরা দিতে কামালের বাড়িতে অবস্থান নেন অর্থনীতিবিদেরা। মনে আছে আনিস অফিসের মেঝেতে লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে নিয়েছিল। ২২–২৩ মার্চ নাগাদ এই আলোচনায় আমাদের শেষ অবদান ছিল আগের রাতে আমাদের তৈরি প্রস্তাবগুলোর ওপর এম এম আহমেদের হাতে লেখা সংশোধনীগুলো নিয়ে কথা বলা। মনে আছে, আমরা এই সংশোধনীগুলোর সঙ্গে সহমত ছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত হয়তো একটা সমাধান পাওয়া গেছে এই চিন্তা নিয়ে বাড়ি চলে যাই।

ইয়াহিয়ার দল যে চূড়ান্ত অবস্থান নিয়েছিল, তা থেকে মনে হচ্ছিল যে অন্তত অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোতে একটা সমঝোতায় পৌঁছানো যাবে। আশা ছিল, ২৪ মার্চ জেনারেল পীরজাদা আলোচনার চূড়ান্ত অধিবেশন ডাকবেন, যা থেকে একটা সমঝোতার ঘোষণা সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া যাবে। পরের দুদিন কেটে গেল পীরজাদার ফোনের অপেক্ষায়। ২৫ মার্চ আমরা জানতে পারলাম এম এম আহমেদ আর কর্নেলিয়াস আগের রাতে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে।

বিশ্বব্যাংকের বরিষ্ঠ উপদেষ্টা এম এম আহমেদের সঙ্গে আবার আমার দেখা হয় ১৯৭৭ সাল ওয়াশিংটন ডিসিতে। এম এম আহমেদ আমাকে জানায় সেই চরম দিনগুলোয় সে–ও আওয়ামী লীগ দলের সঙ্গে বৈঠকের অপেক্ষা করছিল যে অধিবেশনে সংবিধানের বিষয়ে একটা অন্তর্বর্তী চুক্তির কথা সরকারিভাবে ঘোষিত হবে। পরিবর্তে জেনারেল পরীজাদা তাকে আচমকা বলেন যে তার কাজ শেষ হয়েছে এবং তাকে ও বিচারপতি কর্নেলিয়াসকে অবিলম্বে ঢাকা ছেড়ে দেশে ফিরতে হবে। একাত্তরের সেই আলাপ–আলোচনার সারবস্তু এখানে আর বিস্তারিত করছি না। সে সময়ের তরতাজা স্মৃতি এবং ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আমার নিজস্ব মতামত তুলে ধরেছিলাম সে বছরের সাউথ এশিয়ান রিভিউতে প্রকাশিত আমার ‘নেগোশিয়েটিং ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধে। কামাল হোসেনও আলাদাভাবে সেই আলাপ–আলোচনাগুলোর প্রামাণিক বিবরণ দিয়েছে।

উদ্ভূত সংকটের সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টা হিসেবে সেসব আলাপ–আলোচনা চলছিল ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। কাশ্মীরি উগ্রবাদীরা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস করপোরেশনের (আইএসি) একটা উড়োজাহাজ লাহোরে ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়ার পর ভারত তার আকাশসীমা দিয়ে অন্তর্বর্তী উড্ডয়ন বন্ধ করে দেয়। ফলে কলম্বো হয়ে পাকিস্তানি সেনাদলের সংখ্যা রোজ বাড়ানো হচ্ছিল বাংলাদেশে। সেনাবাহিনীর এই তোড়জোড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল বাঙালি জনতার রাজনীতিসচেতনতা এবং জঙ্গি মনোভাব।

default-image

মার্চের মাঝামাঝি আমাদের এক বন্ধু মঈদুল হাসান আমাকে জানাল ক্যান্টনমেন্টের সূত্রে কাছ থেকে পাওয়া একটা জরুরি বার্তা সে বঙ্গবন্ধুকে জানাতে চায়। এক রাতে দশটা নাগাদ আমি মঈদকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যাই এবং সে বঙ্গবন্ধুকে এ খবর দেয় যে পাকিস্তানি সেনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং যুদ্ধের জন্য তৈরি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু কথাটা শুনলেন বটে, তবে জানালেন যে এই প্রস্তুতির সম্পর্কে তাঁকে ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে।

ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা এই খবরের প্রাসঙ্গিক বিষয় ছিল সেনাবাহিনীর আক্রমণের প্রকৃত বিপদ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে সজাগ করে দেওয়া এবং বাংলাদেশের দিক থেকে আগেভাগে জবাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো। বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে থাকা বাংলাদেশি সদস্যরা আক্রমণ শুরু করবে কি না, এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ চাইছিল বাঙালি সেনারা।

চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ড্যান্ট এবং পূর্ব পাকিস্তানের বরিষ্ঠতম বাঙালি সামরিক অফিসার ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারের একটা বার্তা নিয়ে ২৩ মার্চ আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসে ব্যবসায়ী নেতা ও আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি এম আর সিদ্দিকী এবং ব্যাংকার এ আর খালেদ আমাকে আর কামালকে একই প্রশ্ন করেছিল। ১৯৯৯ সালে রুহুল মতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মজুমদার বলছেন চট্টগ্রামে কর্মরত বাঙালি সৈন্যদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী হবে, এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনি নির্দেশনা চেয়েছিলেন। তাঁর দাবি ছিল ইপিআর–ভুক্তদের ধরলে ক্যান্টনমেন্টগুলোতে বাঙালিরা সংখ্যায় পাকিস্তানি সেনাদের থেকে বেশি এবং সে কারণেই পাকিস্তানি সেনারা যখন আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেই, তখন সুবিধা পেতে উল্টো তাদেরই আগে আঘাত হানা উচিত হবে। তারা আরও খবর দিয়েছিল যে এম ভি সোয়াত সবে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজবোঝাই অস্ত্র ও সৈন্য নিয়ে এবং বাঙালি সেনাদের হয় ওই জাহাজকে আক্রমণ করতে হবে অথবা নির্দেশ মেনে অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে দিতে হবে, যেগুলো পরে পাকিস্তানিরা তাদেরই খুন করার জন্য ব্যবহার করবে।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করাতে সিদ্দিকীকে ধানমন্ডি ৩২–এ নিয়ে যায় কামাল। তিনি পরামর্শ দিলেন বাংলাদেশি সেনাদের এখনই আক্রমণে যাওয়া ঠিক হবে না এবং তাদের তাঁর সংকেতের অপেক্ষা করতে বললেন। সিদ্দিকী চট্টগ্রাম ফিরে যায় সেখানকার বাঙালি বাহিনীর জন্য কোনো স্পষ্ট বার্তা ছাড়াই এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রস্তুতির জবাব কী হবে স্থির করা তাদেরই ওপর ছেড়ে দেওয়া হলো।

ক্যান্টনমেন্টের এ ধরনের ভেতরের খবরে বঙ্গবন্ধুর সাড়া দেওয়া বা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত হতো কি না এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও ইপিআরের বাঙালি সশস্ত্র ইউনিটকে প্রথম আঘাত হানার নির্দেশ দেওয়া তাঁর উচিত ছিল কি না, এ নিয়ে পরবর্তীকালে বহু জল্পনা হয়েছে। এই বাহিনী তাদের সংখ্যাধিক্য দিয়ে প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে মজুত থাকা পাকিস্তানি সেনাদের পর্যুদস্ত করতে পারত কি না সেটাও বিতর্কের বিষয় থেকে যায়। পাকিস্তান থেকে পরবর্তীকালের লেখালেখি ইঙ্গিত দেয় যে এমন সম্ভাবনা সামরিক শাসকদের অজানা ছিল না এবং সম্ভাব্য বিদ্রোহীরা তাদের চরবৃত্তির নজরদারিতে ছিল। অধীন বাঙালিদের আনুগত্য সম্পর্কে পাকিস্তানি অফিসারদের উদ্বেগের কথা বারবার উল্লেখ করেছে রাজার স্মৃতিকথা। একটা সময় জিওসি হিসেবে সে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারকে তাদের নিজস্ব অস্ত্র সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেয় তাদের ওপর বাঙালি সেনাদের সম্ভাব্য অতর্কিত হামলার মোকাবিলায়।

বাংলাদেশে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি ইউনিটগুলোর সংঘবদ্ধ, সমন্বিত প্রথম আক্রমণ বাংলাদেশের পক্ষে বড় ধরনের নিরাপত্তা, সাংগঠনিক এবং লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করত। এ রকম একটা আক্রমণের শেষে এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে যদি তারা ব্যর্থ হতো এবং পাকিস্তান থেকে অবধারিতভাবে আসতে থাকা সামরিক সরবরাহ ছিন্ন করতে না পারত, তবে বাঙালি সৈন্যদের সম্মতিতে একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণায় (ইউনিল্যাটারাল ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্টস) বাংলাদেশকে আসলে একটা সীমাহীন গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হতো। বাঙালি হয়তো শেষ অবধি এমন লড়াইয়ে জয়ী হতো, তবে বাংলাদেশকে দেখা হতো কম অনুকূল নজরে, বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং বিদ্রোহী হিসেবে, যেমন নাইজেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বায়াফ্রার দুর্ভাগ্যজনক প্রচেষ্টাকে দেখা হয়েছিল। আমার মনে আছে, আমাদের আন্তর্জাতিক প্রচারের একটি থিম ছিল লোককে বোঝানো যে ‘বাংলাদেশ বায়াফ্রা নয়’।

একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণার ঘরে–বাইরে সম্ভাব্য বিপদগুলো অজানা ছিল না বঙ্গবন্ধুর। পাকিস্তান আমলে একজন বিরোধী নেতার সামান্যই সুযোগ ছিল সামরিক বাহিনীর সঙ্গে খাতির জমানোর, বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করা দূরের কথা। বাঙালি সশস্ত্র সেনানী এমন বিদ্রোহে যোগ দেবে কি না অথবা সেটাকে অন্তিম জয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো সামরিক সক্ষমতা তাদের আছে কি না বঙ্গবন্ধু কখনোই সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারেননি। এ রকম পরিস্থিতিতে একটি একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পরিণতিস্বরূপ শুরু হওয়া যুদ্ধ, যা বাংলাদেশের মানুষকে সীমাহীন রক্তপাতে ঠেলে দেবে—এসবের সূচনাকারী হতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন তিনি।

  • UNTRANQUIL RECOLLECTIONS: The Years of Fulfilment

  • বাংলা অনুবাদ: উতল রোমন্থন: পূর্ণতার সেই বছরগুলো। সেজ পাবলিকেশন, ভারত। ২০১৮