বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৫৯ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তান ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) নিযুক্ত হই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমাদের ক্যাম্পে যে খানসেনারা ছিল, তাদের আমরা মেরে ফেলি। আমি নিজে এয়াকুব খানকে গুলি করে মারি। ওখান থেকে আমরা ধোপাখোলা দর্শনা হয়ে চুয়াডাঙ্গা হাউস হেডকোয়ার্টারে পৌঁছাই। ওখানে যতগুলো খানসেনা ছিল, তাদের অ্যারেস্ট করে মেহেরপুর জেলায় রাখি। বারাদি আমবাগানে তাদের ক্রসফায়ারে মেরে ফেলি। কুষ্টিয়া শহরের ১৬ নম্বর বালুচ রেজিমেন্টে তিনটি কোম্পানি ছিল। আমাদের উইং কমান্ডার মেজর উসমানীকে পরিবারসহ আটক রাখে পাকিস্তানি বাহিনী। আমরা খবর পেয়ে তাঁকে উদ্ধার করি। সেখানে উপস্থিত হলে ১৬ বালুচ রেজিমেন্টের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। কুষ্টিয়া জেলা শহরের লোকজন আমাদের সাহায্য করে।

মেজর সাহেবকে উদ্ধার করে আমরা চলে যাই পাকশী হাউজিং ব্রিজে। সেখানে সামনাসামনি পাঞ্জাবিদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। খানসেনারা প্লেন থেকে বোমা মারে। আমরা তার মুখোমুখি টিকতে না পেরে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে চলে আসি। বিষয়খালী ব্রিজের দুই মাথায় দক্ষিণ দিকে খালের উত্তর দিকে আমরা মুখোমুখি ফায়ার শুরু করি। তিন ঘণ্টা ধরে তুমুল যুদ্ধ হয়। আমাদের কাছে ৭.৬২ রাইফেল ছাড়া অন্য কোনো হাতিয়ার ছিল না। পরে আমরা লাউদিয়া গ্রাম হয়ে পুনরায় ঝিনাইদহে চলে যাই। পরদিন কালীগঞ্জ ও বারোবাজার হয়ে দুলাল মন্দিরের মেইন রাস্তার দুই পাশে বাংকার করে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করে কয়েক দিন যশোর ক্যান্টনমেন্ট অবরুদ্ধ করে রাখি। আমরা খবর পাই যে তারা সারেন্ডার করবে। কিন্তু তারা দু-তিনটি প্লেন ও গাড়িবহর নিয়ে রাত চারটার দিকে ফায়ারিং শুরু করে। উপর্যুপরি বোম্বিং শুরু হয়। সেখানে আমাদের কিছু লোক মারা যায়।

আমরা আত্মরক্ষা করি। চুয়াডাঙ্গায় রওনা হলে খবর পেলাম খানেরা চুয়াডাঙ্গা হেডকোয়ার্টার দখল করে নিয়েছে। তখন আর আমরা চুয়াডাঙ্গায় ঢুকতে পারলাম না। সেখান থেকে আমরা ভারতের উদ্দেশে রওনা দিয়ে দর্শনা স্টেশনে হাজির হই। রাতে ভারতীয় ট্রাকে করে বনগ্রাম রাখাল দাস হাইস্কুলের ৫ নম্বর উইংয়ের বেশ কিছু লোকের সঙ্গে একত্র হই।

পরের রাতে সব ইপিআরের লোক ঝোপোল চেকপোস্ট হয়ে আমড়াখালী এসে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করি। পরদিন সকাল আটটার দিকে আমড়াখালীতে তুমুল যুদ্ধ হয়। নায়েব সুবেদার মুজিবুর রহমান এবং তাঁর গাড়িচালক আক্তার মারা যান। রেললাইনের গুমটিঘরের ওপর ছিলাম বরকত আর আমি। রাজাকাররা আমাদের ঘরের কোনায় মর্টারের গোলা মারে। আমরা খুব শক্তিশালী অস্ত্র রেখে পালিয়ে যাই। বাকি লোক পালিয়ে গিয়ে হরিদাসপুর হাইস্কুলে একত্র হয়।

সেখান থেকে আমাদের নেওয়া হয় ভারতের বয়রা আমবাগানে। চুয়াডাঙ্গা ব্যাটালিয়নের ৩ কোম্পানি তাঁবু করে এই আমবাগানে থাকে। বেলতার ছুটিরপুর ঘাটে প্রতিদিন লড়াই হতো খানসেনাদের সঙ্গে। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে ছুটিরপুর ঘাট পার হয়ে বেলতলা গ্রামে খানসেনারা ঢুকে পড়ে। কিছু লোক আমাদের বলে যে খানসেনারা এখানে চলে এসেছে, গ্রামের লোকদের ওপর অত্যাচার করছে। আমরা তাদের চারদিক দিয়ে আক্রমণ করে দুজনকে জ্যান্ত ধরি। তিনজন মারা যায়। আমাদের কমান্ডার নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামান ক্রসফায়ারে পড়ে মারা যান। তাঁর লাশ পড়ে ছিল বেলতা পুকুরে। ময়মনসিংহের (বর্তমানে টাঙ্গাইল) করটিয়ায় ছিল তাঁর বাড়ি। আমি তখন শারীরিকভাবে অসুস্থ। আমাদের ক্যাপ্টেন ছিলেন নুরুল হুদা। তাঁকে আমার অসুস্থতার কথা জানালে আমাকে ৯ নম্বর সেক্টর টাকিতে বদলি করে দেন।

৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর জলিল। তিনি আমাকে অসুস্থ দেখে টাকি হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে মেজর জলিল কিছু ছেলেকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আমাকে নিযুক্ত করেন। তাদের আমি ট্রেনিং করিয়েছি টাকির অপর পারে। শ্রীপুর ভাতশালাই, দেবহাটা, পারুলিয়াসহ বেশ কিছু স্থানে অপারেশন করিয়েছি। সফলও হয়েছি। তখন আমাকে কমান্ডার করা হয়।

(বর্ণনাকারী ওমর আলী সম্পর্কে সংগ্রহকারীর মামা)

সূত্র: ছাত্রছাত্রীদের সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী-ভাষ্য, সপ্তম পর্ব, সম্পাদনা: মফিদুল হক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, মে ২০১৮