বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের ১৫ মার্চ ছুটিতে বাড়ি আসেন ক্যাপ্টেন আজিজুল হক। উত্তাল সেই সময়ে ছুটি শেষ হলেও আর চাকরিতে যোগ দেননি তিনি। স্থানীয়দের নিয়ে শুরু করেন স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতি। লালমনিরহাট শহরের বাঙালি ছাত্র, যুবকসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ ও আক্রমণের কলাকৌশল শিক্ষা দেন। নিজেও যোগ দেন যুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘বীর প্রতীকে’ ভূষিত হন এই যোদ্ধা।

লালমনিরহাট শহরের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাসিন্দা বীর প্রতীক ক্যাপ্টেন (অব.) আজিজুল হক। তিনি ১৯৬৮ সালে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। এরপর ১৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনারারি ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার কোয়ার্টার মাস্টার মনোনীত হন। ১৯৭১ সালে রংপুর ইপিআরের ১০ নম্বর উইংয়ে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেই ভয়াল গণহত্যা শুরুর মাত্র ১০ দিন আগে আজিজুল হক সাত দিনের ছুটিতে লালমনিরহাট শহরের বাড়িতে আসেন। ছুটি শেষ হলেও তিনি আর চাকরিতে যোগদান করেননি।

১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ কুড়িগ্রামের ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামের বাড়িতে রংপুর থেকে পালিয়ে আসা ইপিআরের মেজর নওয়াজেস আলীর সঙ্গে এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা চূড়ান্তকরণের সভায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি বাঙালি ছাত্র, যুবকসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ ও আক্রমণের কলাকৌশল শিক্ষা দেন।

এরপর আজিজুল হক মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে সাহেবগঞ্জে যান। এ সাব–সেক্টরের কমান্ডার মেজর নওয়াজেস তাঁকে কোম্পানি কমান্ডার পদে নিযুক্ত করেন।

১৯৭১ সালের বিজয় অর্জনের এক মাস আগে ১৬ নভেম্বর সকালে তিনি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী-ভূরুঙ্গামারী সড়কের সন্তোষপুর এলাকায় সশস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন সদস্যকে দেখতে পান। সাহসী মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে কথার ফাঁদে ফেলে তাদের জীবন্ত অবস্থায় অশস্ত্রসহ আটক করতে সমর্থ হন। এ দুই সেনার কাছ থেকে ৭ দশমিক ৬২ মডেলের দুটো চায়নিজ রাইফেল এবং ৪০০টি তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়। অসামান্য এ সাহসিকতার জন্য তিনি বীর প্রতীক খেতাব পান।

লালমনিরহাট জেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধকালে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তিনজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত হন। বাকি দুজন হলেন শহীদ তমিজউদদীন প্রামাণিক বীর বিক্রম ও মতিউর রহমান বীর উত্তম। অনারারি ক্যাপ্টেন তমিজউদদীন প্রামাণিককে কুড়িগ্রামের পাটেশ্বরীর যুদ্ধে অসমসাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করা হয়। বীর উত্তম মতিউর রহমান একজন আত্মঘাতী নৌ কমান্ডো হিসেবে মুর্শিদাবাদের পলাশী নৌ কমান্ডো ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মতিউর রহমান বরিশাল বন্দর ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি সাহসিকতাপূর্ণ অভিযানে নেতৃত্ব দেন। ২৫-২৬ অক্টোবর বরিশালে মাইনের সাহায্যে তিনটি জাহাজ ডুবিয়ে দেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে নৌ কমান্ডোরা। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ পরবর্তী সময়ে তাকে বীর উত্তম খেতাব দেওয়া হয়।

বীর প্রতীক আজিজুল হক লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন। ৬ নম্বর সেক্টরের গ্রুপ ক্যাপ্টেন ছিলেন এম কে বাশার। আজিজুল হক ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ (ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার অন্তর্ভুক্ত) সাব–সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করেন। এই সাব–সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর নওয়াজেস উদ্দিন আহমেদ। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে সাহেবগঞ্জ সাব–সেক্টর হেডকোয়ার্টার পরিদর্শনে আসেন। সাহেবগঞ্জ সাব–সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে আজিজুল হক তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।

লালমনিরহাটের পাশের জেলা কুড়িগ্রামের জয়মনিরহাট, ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, পাটেশ্বরী, রায়গঞ্জ এবং লালমনিরহাট সদর উপজেলা ছিল সাহেবগঞ্জ সাব–সেক্টরের আওতায়। এসব এলাকায় আজিজুল হক বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই সদস্যকে অস্ত্রসহ আটক করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল বৃদ্ধি করেন।

আজিজুল হক ১৯৪৫ সালের ১ এপ্রিল লালমনিরহাট শহরের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। স্ত্রী ফরিদা হক। তাঁদের সংসারে ফয়ছাল হক ও আরবী হক নামের দুই সন্তান আছেন।

দেশের জন্য লড়তে গিয়ে অনেক ত্যাগও স্বীকার করতে হয়েছে বীর প্রতীক আজিজুল হককে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর বাবা ছখি উদ্দিন আহমেদ ভারতের আলীপুরদুয়ার মহকুমার ছিপকাটা গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তিনি বাবাকে শেষবার দেখতে যেতে পারেননি। আজিজুল হক বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমার জন্য লালমনিরহাট শহরের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়, বাবার বড় সন্তান হওয়ার পরও তাঁর মরদেহ শেষবারের মতো দেখতে না পাওয়ার দুঃখ ও ক্ষোভ ছিল। সেই দুঃখ আর ক্ষোভ ভুলেছি যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে এ জন্য।’ তিনি বলেন, ‘এখন মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এ স্বাধীন বাংলাদেশ দুর্নীতি ও অনিয়মমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা হলে, সার্বিকভাবে স্বাবলম্বী হলে মরেও শান্তি পাব।’