বিজ্ঞাপন
default-image

নতুন সরকার এলেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বড় হয়। ৪৭ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার। আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে তালিকা যাচাই-বাছাই শুরু করলেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে তা থেমে যায়। কিন্তু এ কাজে খরচ হয়ে গেছে চার কোটি টাকা। এবার ২৬ মার্চ আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অবশ্য এই তালিকাও অপূর্ণাঙ্গ।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব তালিকা হয়েছে, তা থেকে ১৯ ক্যাটাগরির প্রায় দুই লাখ (১,৯৯,৯৩৫) মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা আপাতত প্রকাশ করবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। ২৬ মার্চ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তালিকাটি প্রকাশ করা হবে। একই সঙ্গে ২০০৫ সাল থেকে (বিএনপি আমল) বিভিন্ন সময়ে করা ৩৪ হাজার ৪৪৩ জনের বেসামরিক গেজেট স্থগিত করা হবে। তাঁদের ভাতা স্থগিত করে পুনরায় আবেদন করতে বলা হবে। আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের পর তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এসব গেজেট চূড়ান্ত করে তালিকায় সংযুক্ত করা হবে।

default-image

মন্ত্রণালয়ের গেজেট শাখা বলছে, যাচাই-বাছাইয়ের পর অন্তত ২৫ হাজার গেজেট বাতিল হতে পারে। এসব গেজেটের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছেন, যাঁদের নামে একাধিক গেজেট রয়েছে। মন্ত্রণালয় মনে করে, বিএনপির সময় যেসব মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে, তাতে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। তবে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যেসব গেজেট হয়েছে, তাতে কোনো অনিয়ম নেই বলে দাবি করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী।

মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২০০২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গেজেটে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এখন ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৮। ভাতা পাচ্ছেন ১ লাখ ৮৭ হাজার ৯৮২ জন। তাঁদের মধ্যে যেসব ক্যাটাগরির নামের তালিকা প্রকাশের কথা রয়েছে, সেগুলো হলো শহীদ বেসামরিক গেজেট (৩,০২৪ জন), সশস্ত্র বাহিনী শহীদ গেজেট (১,৬০৭), শহীদ বিজিবি গেজেট (৯৩৬), শহীদ পুলিশ গেজেট (৪০৫), বেসামরিক যুদ্ধাহত গেজেট (২,৩৮৮), খেতাবপ্রাপ্ত গেজেট (৬৭৬), মুজিবনগর গেজেট (৬২৩), সেনাবাহিনী গেজেট (২৪,৫৬৯), বিমানবাহিনী গেজেট (১,১২৯), নৌবাহিনী গেজেট (৩৫৩), বিজিবি গেজেট (৮,৯২৪), পুলিশ বাহিনী গেজেট (৭৫৬), আনসার বাহিনী গেজেট (৬৯৬), স্বাধীন বাংলা বেতার শব্দসৈনিক গেজেট (২৭২), বীরাঙ্গনা গেজেট (২৬৯), স্বাধীন বাংলা ফুটবল (৩১), ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, বিশেষ গেরিলা বাহিনী গেজেট (২,৩৬৭), বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে নিয়োজিত ডাক্তার ও সেবাকর্মীদের গেজেট (২৬ জন)।

বর্তমানে বেসামরিক গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা আছেন ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪৪৩ জন। এর মধ্যে লাল মুক্তিবার্তায় থাকা ৯০ হাজার ও ভারতীয় তালিকায় থাকা ৬০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে। ৩৪ হাজার ৪৪৩ জনের গেজেট স্থগিত করার কথা রয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন, বিএনপির আমলে প্রায় ২২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছেন। আর আওয়ামী লীগ আমলে (২০০৮ থেকে ২০১৪) গেজেটভুক্ত হয়েছেন সাড়ে ১১ হাজার, যাঁদের প্রায় সবাই ভুয়া।

তালিকার বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব তালিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, নিয়ম মেনে করা হয়েছে, যাঁদের বিষয়ে আমরা অবহিত আছি, তাঁদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে ২৬ মার্চ। আর যাঁদের বিষয়ে আপত্তি এসেছে, তাঁদের নতুন করে আবেদন করতে বলা হবে।’ তিনি বলেন, ‘গত মেয়াদে আমরা সব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করতে পারিনি বা ভুয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারিনি। এবার করে ফেলব। তবে আমরা কোনো অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানাইনি।’

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ পর্যন্ত নতুন করে সরকারি গেজেটভুক্ত হয়েছেন ৩৫ হাজার ৪৮৯ জন। একই সময়ে ভাতা পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ থেকে বেড়ে ১ লাখ ৮৬ হাজার হয়েছে।

২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকঢোল পিটিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। নতুন করে প্রায় দেড় লাখ আবেদন জমা পড়ে। সরকার চেয়েছিল হাজার পাঁচেক অন্তর্ভুক্ত করতে। কিন্তু যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় শেষ পর্যন্ত নতুন তালিকা প্রকাশ স্থগিত করতে বাধ্য হয় সরকার। কয়েক মাসের এ কাজে চার কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করতে অনেক সময়ক্ষেপণ করেছে। আমি মনে করি, এবার সময় নিয়ে হলেও যেন একটি সঠিক ও নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করে। কারণ, এর আগে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেককে মুক্তিযোদ্ধা বানানো হয়েছে। আমরা চাই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হোক।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এই গবেষক বলেন, আগেরবার তালিকা তৈরির সময় জেলা কমান্ডাররা টাকা খেয়ে অনেকের নাম ঢোকানোর চেষ্টা করেছেন বা ভুল তথ্য দিয়েছেন। তাই গ্রামপর্যায় থেকে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হোক। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর ২ হাজার ৩৬৭ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকাও পুনরায় যাচাই-বাছাইয়ের পরামর্শ দেন তিনি।

সূত্রঃ ৭ মার্চ ২০১৯, ২৩ ফাল্গুন ১৪২৫, বৃহস্পতিবার, প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।