বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের শিকারপুরে প্রশিক্ষণ শেষে ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা মেহেরপুরের মুজিবনগরের জয়পুর গ্রামে সমবেত হন। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল পাশের নাটুদহ গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে অভিযান চালানো।

স্থানীয় রাজাকার, আলবদররা খবর পেয়ে রাতেই তা জানিয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে। সকালেই হানাদাররা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। উপায়ান্তর না দেখে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধযুদ্ধের সিদ্ধান্তে নেন। সেই যুদ্ধে শহীদ হন চুয়াডাঙ্গার সংস্কৃতিসেবী, ক্রীড়াবিদ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হাসান জামানসহ আটজন মুক্তিযোদ্ধা। এই ঐতিহাসিক প্রতিরোধযুদ্ধ সংঘটিত হয় একাত্তরের ৫ আগস্ট।

যুদ্ধের পর হানাদাররা শহীদদের লাশ সারা গ্রামে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এলাকাবাসীকে দেখায়। এরপর চুয়াডাঙ্গা জেলার জগন্নাথপুর গ্রামে দুটি গর্তে কবর দেয় আট শহীদের মরদেহ।

মুজিবনগরের কাছেই বাগোয়ান গ্রামের জয়পুরে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন শিবির। মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হয়ে আশপাশের কয়েকটি হানাদার ক্যাম্পে গেরিলা অভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন। ওই গ্রামের রাজাকার কুবাদ খাঁ ও তাঁর সহযোগীরা হানাদার ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের বিষয়ে জানিয়ে দেয়।

হাসান জামান ও খালেদ সাইফুদ্দীনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দল বাগোয়ানের দিকে অগ্রসর হলে ওত পেতে থাকা পাকিস্তানি হানাদার সেনারা বিপরীত দিক থেকে তাঁদের ওপর গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলে কয়েক ঘণ্টা। সম্মুখযুদ্ধে হাসান জামানসহ আটজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

প্রথম আলোতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্য চেয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে শহীদ হাসান জামানের ছবি এবং তাঁর জীবন-কর্ম নিয়ে বিস্তারিত তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা পাঠান মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল-আমিন। সেই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে জানা যায়, হাসান জামানের জন্ম ১৯৪৬ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার গোকুলখালী গ্রামে।

বাবা ইয়াকুব হোসেন ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, মা আনারকলি রাজিয়া গৃহিণী। গোকুলখালী হাইস্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক ও চুয়াডাঙ্গা কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। অ্যাথলেট ও ফুটবলার হিসেবে বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলে তাঁর সুনাম ছিল। পাশাপাশি তিনি নাটক মঞ্চায়ন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে চুয়াডাঙ্গায় শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ, নাট্য মঞ্চায়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন। গড়ে তোলেন পাঠচক্র। তাঁর পরিবারের সবাই স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন। ছাত্রজীবনে তিনি চুয়াডাঙ্গা মহকুমা ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। সত্তরের নির্বাচনী প্রচারণা ও বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্র-তরুণদের ঐক্যবদ্ধ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হাসান জামান একদল যুবক নিয়ে ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৮ নম্বর সেক্টরের লালবাজার সাব-সেক্টর এলাকায়। তাঁর নেতৃত্বে তরুণ, যুবক ও ছাত্রদের এক বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে। তাঁরা বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ ও সম্মুখযুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন। মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে হাসান জামান এক কিংবদন্তিতুল্য নাম।

তাঁর আত্মত্যাগের কাহিনি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের মুক্তিসংগ্রামে মেহেরপুর, আগামী প্রকাশনীর রফিকুর রশীদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা, জাহিদ রহমানের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮ এবং রাজিব আহমেদের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ: চুয়াডাঙ্গা জেলা বইয়ে শহীদ হাসান জামানের জীবনী ও মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের বিবরণ রয়েছে।

শহীদ হাসান জামান ছিলেন অবিবাহিত। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাবাকে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি পাঠান। ১৯৯৮ সালে শহীদ হাসান জামান এবং একাত্তরের ৫ আগস্টের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে চুয়াডাঙ্গার জগন্নাথপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তমঞ্চ ও মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রহশালা নির্মাণ করা হয়েছে।

গ্রন্থনা: আবু সাঈদ, মেহেরপুর