বিজ্ঞাপন
default-image

বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর পৈশাচিক তাণ্ডবে সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলার বামন্দী এলাকার গ্রামগুলো প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। ঘাতকের দল বিভিন্ন গ্রাম থেকে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে এনে নির্বিচার হত্যা করছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প আমঝুপি নীলকুঠি, জেলা কোর্ট বিল্ডিং চত্বরসহ বিভিন্ন এলাকার বাতাস পচা–গলা লাশের দুর্গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে। তখন অল্প কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এলাকায় অবস্থান করে গোপনে স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সাংগঠনিক ও সামরিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন। সংস্কৃতিসেবী ও বিদ্যোৎসাহী হারিস উদ্দীন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

একাত্তরের ১৫ আগস্ট রাত ১২টা। মেহেরপুর জেলার গাংনী শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বামন্দী গ্রামে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের কয়েকটি ট্রাক। হারিস উদ্দীনের একতলা বাড়ির সামনে এসে থামে ট্রাকগুলো। মুহূর্তের মধ্যে বাড়িটি ঘিরে ফেলে ঘাতক সেনার দল। মুন্দা গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার মহির মিয়ার নেতৃত্বে হায়েনার দল ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতরে। হারিস উদ্দীন তাঁর দোনলা বন্দুক দিয়ে শত্রুদের প্রতিরোধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। হানাদাররা হারিস উদ্দীন ও তাঁর আত্মীয় আবুল কাশেমকে চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ভাটপাড়া ক্যাম্পে প্রচণ্ড নির্যাতন করে হত্যা করে। স্বজনেরা তাঁর লাশ খুঁজে পাননি।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আবদুল্লাহ আল-আমিন শহীদ হারিস উদ্দীনের ছবি ও তাঁর কর্মজীবন নিয়ে বিস্তারিত তথ্যসমৃদ্ধ লেখা পাঠান। সেই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা হয়।

হারিস উদ্দীনের জন্ম ১৯২১ সালে গাংনী উপজেলার বামন্দী গ্রামে। বাবা বদরুদ্দীন ফরাজি ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও জোতদার। মা গোলাপজান বেগম গৃহিণী। হারিস উদ্দীনের উদ্যোগে এলাকায় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চা পরিচালিত হয়েছে। ফুটবল মাঠের জন্য জমি দানসহ লোকজ সংস্কৃতি ও খেলাধুলার উন্নয়নে অকাতরে দান ও পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। এলাকায় শিক্ষাবিস্তারে তাঁর দান ও ভূমিকা বিপুল। উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, ছয় দফা আন্দোলন, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও অসহযোগ আন্দোলনে মেহেরপুরে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তরুণদের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ ও ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণে সহায়তা করতেন। তাঁর নেতৃত্বে গাংনী থানার বন্দুক মালিকদের নিয়ে গড়ে ওঠে ‘বন্দুক বাহিনী’।

রফিকুর রশীদের লেখা আগামী প্রকাশনীর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা গ্রন্থে হারিস উদ্দীনকে গাংনী থানার স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগণ্য ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের মুক্তিসংগ্রামে মেহেরপুর এবং মূর্ধন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আবদুল্লাহ আল আমিনের ভাটপাড়া নীলকুঠি ও উনিশ শতকের বাংলাদেশ গ্রন্থে হারিস উদ্দীনকে শহীদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ড. মো. আবদুল হান্নানের লেখা স্বাধীনতাযুদ্ধে বৃহত্তর কুষ্টিয়া বইতেও হারিস উদ্দীনের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

শহীদ হারিস উদ্দীন ও একাত্তরের ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ভাটপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজ চলছে। তাঁর ছোট ছেলে ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে এলাকায় নেতৃত্বদানের জন্য তাঁর বাবা ও মামা শহীদ হয়েছেন। কিন্তু শহীদ হিসেবে তাঁরা সরকারি স্বীকৃতি পাননি।

গ্রন্থনা: আবু সাঈদ, মেহেরপুর