বিজ্ঞাপন
default-image

হরিপদ গোস্বামী ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ ও নীতিমান স্কুলশিক্ষক। তৎকালীন মানিকগঞ্জ মহকুমা শহরে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকালের সব কর্মকাণ্ডে হরিপদ গোস্বামী যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ বাড়িতে আশ্রয় ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। আর এ জন্য তাঁকে দিতে হয়েছে চরম মাশুল। একাত্তরের মাঝামাঝি পাকিস্তানি হানাদার সেনারা মানিকগঞ্জের নারী জাগরণের অগ্রদূত শহীদ বুদ্ধিজীবী যোগমায়া চৌধুরীসহ হরিপদ গোস্বামীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে প্রকাশ্যে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে।

শহীদ হরিপদ গোস্বামীর জন্ম মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার ধুলণ্ডী গ্রামে। পিতা যোগেশ গোস্বামী। তাঁরা তিন ভাই ও দুই বোন। ‘ভানুবাবু’ নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন তিনি। মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও নারায়ণগঞ্জের তোলারাম ডিগ্রি কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক পাস করেন। এরপর তিনি ১৯৬৪ সালের দিকে মানিকগঞ্জ মডেল হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন অবিবাহিত।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে শহীদ হরিপদ গোস্বামীর ছবি ও তাঁর সম্পর্কে তথ্য পাঠান মানিকগঞ্জ সদরের খাবাপুর আদর্শ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। তিনি মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন। স্মৃতি ও শ্রুতিতে মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ নামে তাঁর একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।

হরিপদ গোস্বামী থাকতেন মানিকগঞ্জ শহরের গঙ্গাধরপট্টি এলাকায় রজনীমোহন বসাকের নাতনি যোগমায়া চৌধুরীর বাড়িতে। হরিপদ গোস্বামী তাঁকে ‘দিদি’ বলে ডাকতেন। যোগামায়ার তিন ছেলে শহীদ ক্রীড়াবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা তপন চৌধুরী, প্রবীর চৌধুরী ও বিকাশ চৌধুরীকে তিনি পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

একাত্তরের ৮ এপ্রিল মানিকগঞ্জ শহরে পাকিস্তানি সেনারা ঢুকে পড়ে। রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে তারা গঙ্গাধরপট্টি এলাকায় যোগমায়া চৌধুরীর বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। হরিপদ গোস্বামী এর আগেই যোগমায়া চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ধুলণ্ডী গ্রামে নিজে বাড়িতে আত্মগোপন করেন। রাজাকার ও হানাদার সেনারা মানিকগঞ্জে তাঁদের না পেয়ে খুঁজতে থাকে। ২৫ মে মধ্যরাতে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদার সেনারা হরিপদের ধুলণ্ডীর বাড়িতে হামলা করে। তারা হরিপদ গোস্বামী, তাঁর বৃদ্ধ বাবা যোগেশ গোস্বামী ও যোগমায়া চৌধুরীকে আটক করে। পরে বৃদ্ধ যোগেশ গোস্বামীকে ছেড়ে দিলেও হরিপদ ও যোগমায়াকে মানিকগঞ্জ প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (পিটিআই) নির্যাতন কক্ষে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে। পরদিন দুজনের চোখ বেঁধে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাটুরিয়া উপজেলার বাড়বাড়িয়া সেতুর কাছে প্রকাশ্যে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়।

এ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় কৈট্টা উমানন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও দোতরা গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাড়বাড়িয়া সেতুর পাশে হানাদার সেনারা হরিপদ গোস্বামী ও যোগমায়া চৌধুরীকে হত্যা করে। ঘাতকেরা ক্ষতবিক্ষত লাশ পাশের জমিতে ফেলে রেখে চলে যায়।

শহীদ বুদ্ধিজীবী যোগমায়া চৌধুরীর ছোট ছেলে মুক্তিযোদ্ধা বিকাশ চৌধুরী বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সমবেদনা জানিয়ে চিঠি ও দুই হাজার টাকার অনুদান পাঠিয়েছিলেন। তাঁর আক্ষেপ, শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর মা ও হরিপদ গোস্বামীর নাম এখনো গেজেটভুক্ত হয়নি।

গ্রন্থনা: আবদুল মোমিন, প্রতিনিধি, মানিকগঞ্জ