বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের ২৭ মে। নেত্রকোনার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সুধীর চন্দ্র মজুমদার গ্রামের বাড়ি ঠাকুরাকোনায় দুপুরের খাবার শেষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় স্থানীয় চৌকিদারকে নিয়ে পাকিস্তানপন্থী কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা ঘরে ঢোকে। অস্ত্রের মুখে তারা সুধীর চন্দ্রকে বাড়ি থেকে তুলে আনে হানাদার সেনা ক্যাম্পে। হায়েনার দল টানা তিন মাস তাঁকে নির্যাতন করে ১ সেপ্টেম্বর গুলি করে হত্যা করে। লাশ ভাসিয়ে দেয় মগড়া নদীতে। স্বজনেরা আর লাশের সন্ধান পাননি।

সুধীর চন্দ্র মজুমদারের জন্ম ১৯০১ সালে নেত্রকোনা সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা গ্রামে। উপেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার ও অনঙ্গ সুন্দরীর একমাত্র সন্তান তিনি। নেত্রকোনা দত্ত উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কলকাতায় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেন। সেখানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কংগ্রেসে যোগদানের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। স্বদেশি আন্দোলনের কারণে ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন চালায়। তাঁকে বন্দী করে রাখা হয় দিল্লির কারাগারে। সেখানে ইংরেজ জেলারের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ালে সাজা হিসেবে তাঁকে আন্দামানে পাঠানো হয়। টানা ১১ বছর আন্দামানে কারাবন্দী থাকার পর ১৯৪৫ সালে তিনি মুক্তি পান।

আন্দামান থেকে ফিরে সুধীর মজুমদার নেত্রকোনা শহরের সাতপাই এলাকায় বসবাস শুরু করেন। ওই বছরই তিনি কিশোরগঞ্জের বেলা রানী মজুমদারকে বিয়ে করেন। তাঁদের চার মেয়ে ও দুই ছেলে। সন্তানদের মধ্যে দুই মেয়ে সবিতা ধর ও সুলতা রাউত জীবিত আছেন।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ সুধীর মজুমদার অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও তরুণদের যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার সরবরাহ, অর্থসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেন। মুসলিম লীগ ও রাজাকার-আলবদর বাহিনীর লোকেরা ২৭ মে সুধীর মজুমদার ও তাঁর চাচাতো ভাই আইনজীবী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদারকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর ২৩ আগস্ট সুধীর মজুমদারের স্ত্রী বেলা রানীকেও গ্রামের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় শান্তি কমিটির সদস্য ও বর্বর পাকিস্তানি সেনারা। লুটপাট করে বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তিন দিন পর বেলা রানীকে ছেড়ে দিলেও সুধীর চন্দ্র ও তাঁর ভাইকে ছাড়েনি। ১ সেপ্টেম্বর রাতে মোক্তারপাড়া বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

একাত্তরের নেত্রকোনা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী জানান, পাকিস্তানি হানাদাররা গণহত্যা শুরু করলে সুধীর মজুমদার তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সংগঠিত করা, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়সহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি নেত্রকোনায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

মোক্তারপাড়ায় যেখানে সুধীর মজুমদারকে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে শিল্পী বিপুল শাহের নেতৃত্বে ‘স্মৃতি ৭১’ নামের একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ আলী আহাম্মদ খান আইয়োবের নেত্রকোনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, গোলাম এরশাদুর রহমানের মুক্তিসংগ্রামে নেত্রোকোনা এবং সঞ্জয় সরকারের নেত্রকেনার লোক-লোকান্তর গ্রন্থে শহীদ সুধীর মজুমদারের কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া নেত্রকোনা জেলা প্রশাসন থেকে প্রকাশিত নেত্রকোনার সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস গ্রন্থে সাবেক জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম ‘মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনায় গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী নিধন’ প্রবন্ধে সুধীর মজুমদারের কথা উল্লেখ করেছেন।

সুধীর মজুমদারের নাতি শান্ত মজুমদার বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে একাধিকবার আবেদন করা হয়েছে। তাঁরা প্রত্যাশা করেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় সুধীর মজুমদারের নাম উঠবে।

গ্রন্থনা: পল্লব চক্রবর্তী, নেত্রকোনা