বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের ২৩ মে ভোরবেলা নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার মধুমতী নদীর তীরঘেঁষা ইতনা গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা করে। বর্বর সেনারা ঘুমন্ত গ্রামবাসীর ওপর নির্মমভাবে গুলি চালাতে থাকে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গ্রামের দক্ষিণ পাড়া দিয়ে এগিয়ে যান তরুণ শিক্ষক শেখ হাফিজুল হক হিরু মিয়া। গোলগুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে আরও অনেকে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। ঘাতক সেনারা তাঁদের মধ্য থেকে শেখ হাফিজুল হকসহ আটজনকে আটক করে।

ঘাতক সেনারা গ্রামে ব্যাপক গণহত্যা ও লুটপাট চালায়। তারা আটক শেখ হাফিজুল হকসহ আটজনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে। সে দিনের গণহত্যায় ইতনা গ্রামে ৩৯ জন নিরপরাধ মানুষ শহীদ হয়েছিলেন।

তরুণ শিক্ষক শেখ হাফিজুল হক সবার কাছে প্রিয় ছিলেন ‘হিরু স্যার’ নামে। বাড়িতে সংরক্ষণ করা নোটবুকে তাঁর জন্মতারিখ বাংলায় লেখা ৭ পৌষ, ১৩৫৩ সন। বাবা শামছুল আলম মিয়া ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, মা আজিজা আলম গৃহিণী। তাঁর বাবা মুক্তিযুদ্ধের আগেই এবং মা ১০৩ বছর বয়সে ২০১৬ সালে ইন্তেকাল করেন। আট ভাই ও এক বোনের মধ্যে হাফিজুল ছিলেন মেজ। বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট। সেজ ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুল ইসলাম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, অন্য ভাইয়েরা ব্যবসায়ী। হাফিজুল হক বিয়ে করেননি। তিনি জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এইচএসসি ও বিএসসি পাস করেন। ইতনা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৯৬৮ সালে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি।

ইতনা গণগ্রন্থাগারের সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান জানান, একাত্তরের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ইতনা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প হয়। অবসরপ্রাপ্ত সেনা ক্যাপ্টেন নুরুদ্দোহা ও সুবেদার মুন্সি সিদ্দিকুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। গ্রামের কয়েকজন স্বাধীনতাবিরোধীর মাধ্যমে সে খবর চলে যায় ভাটিয়াপাড়া ও যশোর সেনানিবাসে। পাকিস্তানি সেনাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল ইতনার ওপর। ২৩ মে ভোরে তারা ইতনায় জঘন্যতম গণহত্যা চালায়। এ ছাড়া এ গ্রামের আরও ১১ জন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময় শহীদ হন।

১৯৯৪ সালে ইতনা গণগ্রন্থাগারের উদ্যোগে গ্রামের ৫০ জন শহীদ স্মরণে ইতনা চৌরাস্তায় শহীদদের নামের তালিকাসংবলিত স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। এতে প্রথম নামটিই শহীদ শিক্ষক হাফিজুল হকের। এ ছাড়া আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে। তবে একাত্তরের গণহত্যায় শহীদদের সরকারি তালিকায় ইতনার শহীদদের নাম নেই। এ নিয়ে ক্ষোভ আছে শহীদ পরিবারে।

হাফিজুল হকের ছোট ভাই শমসের ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ইতনা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ও শরণার্থী ক্যাম্প ছিল। একটি তরুণ দল নিয়ে রাতে গ্রাম পাহারা দিতেন হাফিজুল হক। ঘুমাতেন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। তখন তিনি ইতনা ইউনাইটেড ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি গ্রামের জনকল্যাণকর কাজ, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় নেতৃত্ব দিতেন।

সেই বিভীষিকাময় দিনটির স্মৃতিচারণা করে শমসের ইসলাম বলেন, সেনারা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে চলে যাওয়ার পর মা বলেন, ‘দেখ তো আমার হিরু কই? আমি তখন খুঁজতে গিয়ে দেখি লাশের সারির প্রথমেই আমার ভাই পড়ে আছে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবেদনা জানিয়ে চিঠি, দুই হাজার টাকা ও দুই বান্ডিল ঢেউটিন পাঠিয়েছিলেন তাঁদের পরিবারের কাছে।

গ্রন্থনা: মারুফ সামদানী, লোহাগড়া, নড়াইল