বিজ্ঞাপন
default-image

সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে রংপুরে বিশেষ পরিচয় ছিল আইনজীবী ও সাংবাদিক শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জীর।

তিনি নাট্যনির্দেশনা দিতেন এবং অভিনয় করতেন। ভাষা আন্দোলনের সময় তাঁকে জেলে যেতে হয়।

পাকিস্তানের সেনাশাসক আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে ছয় বছর দুই মাস কারাবাস করতে হয়েছিল তাঁকে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করে।

শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জী তাঁদের পক্ষ সমর্থন করেন। এ কারণে তখন কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে তাঁকে এক বছর জেলে রাখা হয়।

জেল থেকে বেরিয়ে তিনি নবগঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। এই সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন আমৃত্যু।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময়ও তিনি কয়েক মাসের জন্য জেলে আটক ছিলেন। আইনজীবী হিসেবে বহু রাজনৈতিক মামলা পরিচালনা করেছেন। কোনো ফি নেননি।

একাত্তরের ৩০ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী রংপুর শহরের গুপ্তপাড়া থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় রংপুর সেনানিবাসে।

সেখানে কয়েক দিন অমানবিক অত্যাচার করা হয় তাঁর ওপর। তাঁকে জেলে আটক রাখা হয়।

৭ নভেম্বর তাঁকে রংপুর থেকে দিনাজপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। ১১ নভেম্বর আরও অনেকের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে তাঁকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

রংপুরে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। ধারণা করা হয়, এ কারণেই রংপুরে হত্যা না করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দিনাজপুরে।

এ সম্পর্কে জানা যায় ম জিল্লুর রহমানের আমার আপনজন রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ পাখিদার [বিজয়চন্দ্র মিত্র] গুপ্তপাড়ার বাসা থেকে পাক সেনারা শিবেনদাকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায়।

এর পর শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। শিবেনদার ওপর নর-পশুদের অত্যাচারের মাত্রা এত নিদারুণ ছিল যে দাদাকে যখন কোর্টে উপস্থিত করা হয় তখন দুজন পুলিশ কাঁধে করে দাঁড়িয়ে থাকে।

শিবেনদার সঙ্গে আরো যারা পাকবাহিনীর দানবীয় অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন পাখিদা, তার বাবা ও অগণিত রাজনৈতিক কর্মী। ১৯৭১ সনের ৭ই নভেম্বর শিবেনদাকে পাকবাহিনী সরিয়ে নিয়ে যায়।...

‘তারপর আসে সেই ভয়াল ১১ই নভেম্বর। ঐ দিন বিকাল ৪ ঘটিকায় দিনাজপুর জেল থেকে বের করে চোখ-হাত বেঁধে তাঁকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়া হয়, এবং সেখানে ফায়ারিং স্কোয়াডে অসংখ্য স্বাধীনতাকামী মানুষের সাথে তাঁকেও নরঘাতকরা গুলি করে হত্যা করে।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯১, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জীর জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা শহরে। বাংলা ১৩২২ সনের (১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ) ৫ জ্যৈষ্ঠ। বাবা হরনাথ মুখার্জী, মা সরলা মুখার্জী।

চাকরিসূত্রে তাঁর চিকিৎসক বাবা অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলায় ঘুরে শেষে স্থিত হয়েছিলেন রংপুরে।

শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জীর স্কুল ও কলেজের লেখাপড়া রংপুরেই। স্কুলজীবনেই তিনি অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হন।

১৯৩৪ সালে রংপুর জিলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাঁকে দুই বছরের জন্য কারাগারে থাকতে হয়। এরপর এক বছর নজরবন্দী থাকেন।

এই ষড়যন্ত্র মামলায় বিপ্লবী পুর্ণেন্দু গুহের দীপান্তর, ধীরেন বোস, হরিনারায়ণ চ্যাটার্জী, শিবদাস চক্রবর্তী, কালীজীবন ভট্টাচার্য ও লালচাঁদ মৈত্রের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়।

১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর রংপুর কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করে কলকাতায় যান এমএ পড়তে। পাশাপাশি আইনও পড়তে শুরু করেন।

কলকাতার আইন কলেজে পশ্চিমবঙ্গের একসময়ের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় তাঁর সহপাঠী ছিলেন। তিনি বিড়লা সাংবাদিকতা কোর্সও সম্পন্ন করেছিলেন।

১৯৩৮ সালে কলকাতায় গঠিত ছাত্র ফেডারেশনের তিনি রংপুর শাখার প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন।

প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (নবম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (২০০০) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান