বিজ্ঞাপন
default-image

বোয়ালখালী উপজেলার স্যার আশুতোষ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। দেশের প্রতি এই চিরকুমার শিক্ষকের ছিল গভীর ভালোবাসা। ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতেন দেশপ্রেমে। কলেজের ছাত্রাবাসে আশ্রয় দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। এ কারণে রাজাকাররা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।

একাত্তরের ৩১ জুলাই সকালে অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়ায় তাঁর কলেজসংলগ্ন বাসভবনেই ছিলেন। একদল রাজাকার বাড়িতে ঢুকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। ঘাতকেরা এ সময় তাঁর পাচক নারায়ণ বসুকেও হত্যা করে। তৎকালীন বিভূতিভূষণ উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্র বর্তমানে চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী বিধান বিশ্বাস ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কানুনগোপাড়া কলেজ তাঁর বাড়ির পাশেই। সেদিন সকালে গুলির শব্দ শুনে তাঁরা কলেজের আবাসিক ভবনে যান। তাঁরা শান্তিময় খাস্তগীরের মৃতদেহ তাঁর থাকার ঘরের খাটের ওপর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। পাশের ঘরে পড়ে ছিল নারায়ণ বসুর
লাশ।

আতঙ্কময় পরিস্থিতির কারণে তাঁদের লাশ দাহ না করে স্থানীয় কালীবাড়ি পুকুরপাড়ে সমাধিস্থ করা হয়।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে স্থানীয় বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ও প্রাবন্ধিক হামীম রায়হান শহীদ শান্তিময় খাস্তগীরের ছবি ও বিস্তারিত তথ্য পাঠান। সেই সূত্রে অনুসন্ধান করা হয়। শান্তিময় খাস্তগীরের জন্ম ১৯১৬ সালে ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের পটিয়ার সূচক্রদণ্ডী গ্রামে। বাবা সারাদাচরণ খান্তগীর ছিলেন আইনজ্ঞ ও বিদ্যানুরাগী, মা শশাংকমালা দেবী। তিনি চার
ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট। শান্তিময় খাস্তগীর ১৯৩২ সালে পটিয়া ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয় (বর্তমান পটিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়) থেকে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। অন্য কোনো পেশার চেষ্টা না করে শিক্ষকতায় যুক্ত হন তিনি।

শান্তিময় খাস্তগীর সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও রাজনীতি-সচেতন ছিলেন। পরিবারের সবাই একে একে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেও তিনি যাননি। ছাত্রদের তিনি সব সময় দেশ ও মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি গরিব ও অভাবগ্রস্ত ছাত্রছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়াতেন এবং আর্থিক সাহায্য করতেন। কলেজের ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী ও কর্মচারীরাই ছিল তাঁর আপনজন।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশে গণহত্যা শুরু করলে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা শহর ছেড়ে পটিয়া-কানুনগোপাড়ার দিকে চলে আসেন। শান্তিময় খাস্তগীর এমন অনেক স্বাধীনতাসংগ্রামী নেতা-কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কলেজ হোস্টেলে থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা করতেন। এসব কারণে স্থানীয় রাজাকাররা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।

শহীদ শান্তিময় খাস্তগীরের সমাধিস্থলে স্থানীয় পৌরসভার উদ্যোগ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর নামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাঁর স্মৃতি রক্ষায় তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ও সুধীদের নিয়ে শহীদ শান্তিময় খাস্তগীর স্মৃতি পরিষদ নামে একটি সংগঠন করা হয়েছে। তারা প্রতিবছর তাঁর শহীদ হওয়ার দিনে সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও স্মরণানুষ্ঠান করে থাকে।

গ্রন্থনা: আবদুর রাজ্জাক, পটিয়া, চট্টগ্রাম