বিজ্ঞাপন
default-image

ঝিনাইদহে প্রতিবাদী ও সত্যবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে শেখ হাবিবুর রহমান ছিলেন পরিচিত এক ব্যক্তি।

একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধ যুদ্ধকালেও তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঝিনাইদহের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে।

এ সময় তিনি যশোর রোডের (বর্তমানে শেরেবাংলা রোড) নিজ বাসা থেকে কয়েক মাইল দূরে হলিধানি গ্রামে আশ্রয় নেন।

প্রতিবাদী শেখ হাবিবুর রহমান সেখানে গিয়েও বেশি দিন নিশ্চুপ থাকতে পারেননি।

ঝিনাইদহে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যা, নির্যাতন ও লুটতরাজের প্রতিবাদ জানাতে তিনি ১ বা ২ মে শহরে আসেন।

এ সময় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে আটক করে। এরপর সেনারা তাঁর ওপর কয়েক দিন পৈশাচিক অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালায়।

অবশেষে ৯ মে নৃশংসভাবে হত্যা করে ঝিনাইদহ শহর থেকে চার মাইল দূরে তেঁতুলতলা নামক স্থানে তাঁর মরদেহ ফেলে রাখে।

শেখ হাবিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ মিজানুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, (৮ জানুয়ারি ২০১৪) ‘পঁচিশ মার্চের পর ঝিনাইদহের সংগ্রামী জনগণ সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

এর সঙ্গে আমার বাবাও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাঁদের পক্ষে সুসংগঠিত ও আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশি দিন প্রতিরোধ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।

১৬ এপ্রিল সেনাবাহিনী ঝিনাইদহে প্রবেশ করে। এর আগেই বাবা শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে হলিধানি গ্রামে আশ্রয় নেন।

দুই সপ্তাহ পর পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে তিনি শহরে আসেন। এ সময় পাকিস্তানিরা তাঁকে আটক করে।

কয়েক দিন অকথ্য নির্যাতনের পর ৯ মে তাঁকে হত্যা করে তেঁতুলতলায় তাঁর লাশ ফেলে রাখে।

পাকিস্তানি সেনাদের হুমকির কারণে স্থানীয় গ্রামবাসী তাঁর লাশ কবর দিতে পারেননি। তাঁর লাশ আমরা পাইনি।’

শেখ হাবিবুর রহমানের জন্ম ১৯১৯ সালে, বাগেরহাট জেলার বাদেকাড়াপাড়া গ্রামে। এখানেই তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস।

বাবা শেখ আবদুল খালেক, মা লুৎফুননেছা খাতুন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।

বাগেরহাটের যদুনাথ ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর তিনি ভর্তি হন বাগেরহাট পিসি কলেজে।

কিন্তু আর্থিক কারণেই তাঁর লেখাপড়া আর বেশিদূর এগোয়নি। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। এ সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে বার্মা ফ্রন্টে যুদ্ধ করেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৯ সালে ঝিনাইদহের সাব ডিভিশনাল অ্যাডজুট্যান্ট অব আনসার নিযুক্ত হন।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় সরকারি চাকরিতে থেকেও এর পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

ঝিনাইদহে ভাষা আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন সম্মুখসারিতে। এ কারণে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়।

মুক্ত হওয়ার পর চাকরি ত্যাগ করে তিনি আইন পেশায় যোগ দেন। একই সময় সাংবাদিকতাও শুরু করেন।

১৯৫২ সালে ঝিনাইদহের প্রথম সাংবাদিক হিসেবে দৈনিক আজাদ পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা নিযুক্ত হন।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি।

সাংবাদিকতা পেশায় প্রতিবাদী কণ্ঠের কারণে পাকিস্তানি শাসনামলে তাঁকে বিভিন্ন সময় সরকারি রোষানলে পড়ার পাশাপাশি নির্যাতনও ভোগ করতে হয়েছে।

সত্যভাষী হিসেবে ঝিনাইদহে শহরে তাঁর সুনাম ছিল।

শেখ হাবিবুর রহমান দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ের জনক। বড় ছেলে শেখ মিজানুর রহমান সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত।

ঝিনাইদহ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক চলন্তিকা পত্রিকার সম্পাদক। ছোট ছেলে শেখ ওয়াসিকুর রহমান অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার।

মেয়ে কোহিনুর মালা শেখ, শাহিনুর শেখ (মারা গেছেন), তানিয়া শেখ, মনিরা শেখ (মারা গেছেন) ও কাকলি শেখ। স্ত্রী জোবতাতুননেছা। গত ৩১ ডিসেম্বর (২০১৪) তিনি মারা গেছেন।

স্বাধীনতার পর তেঁতুলতলায় শেখ হাবিবুর রহমানের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৭৮ সালে ঝিনাইদহ শিল্পকলা একাডেমী তাঁকে সাংবাদিকতায় মরণোত্তর পদক দিয়েছে।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (চতুর্থ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ১৪ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত