একাত্তরে নড়াইলের কালিয়া মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন শেখ আবদুস সালাম। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ দ্বিতীয় বর্ষেরও শিক্ষার্থী ছিলেন।
শিক্ষাবিদ ও মানবদরদি হিসেবে নিজ এলাকায় তাঁর বেশ পরিচিতি ছিল। স্কুলজীবনে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
সুবক্তা ছিলেন বলে এলাকার বিভিন্ন জনসভায় টেবিলের ওপর তাঁকে উঠিয়ে দেওয়া হতো বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় জেলও খাটতে হয়েছে তাঁকে।
মার্চের অসহযোগ আন্দোলন ও পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধকালে নিজ এলাকায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন শেখ আবদুস সালাম।
প্রতিরোধ ভেঙে এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ওই এলাকায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। মে মাসের প্রথম দিকে আটক হন তিনি।
পাকিস্তানি দোসররা তাঁকে যশোর সেনানিবাসে হস্তান্তর করে। সেখানে চলে তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন।
১৩ মে বিকেলে নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়। এর আগে তাঁকে দিয়েই তাঁর নিজের কবর খুঁড়িয়ে নেয় সেনারা। গুলি করে হত্যার পর ওই কবরে তাঁকে মাটিচাপা দেয় তারা।
এ বর্ণনা জানা যায় শেখ আবদুস সালামের একমাত্র ছেলে শেখ মিজানুর রহমানের কাছ থেকে।
এই প্রতিবেদককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে (৪ জানুয়ারি ২০১৪) শেখ মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই এলাকায় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আমার বাবা।
কালিয়া থানা আওয়ামী লীগেরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মার্চে আমার বাবা প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। বাবার একটি টেপরেকর্ডার ছিল।
সেই টেপরেকর্ডারে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ড করেছিলেন। রেকর্ডকৃত সেই ভাষণ কালিয়ার বিভিন্ন স্থানে তিনি মানুষকে বাজিয়ে শোনাতেন।
এ ছাড়া তিনি নিজেও এলাকার জনগণের উদ্দেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন। কালিয়ার আপামর জনসাধারণ সেই ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন।
‘প্রতিরোধযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁদের সেই প্রতিরোধ বেশি দিন টেকেনি।
যুদ্ধে সক্রিয় নেতৃত্ব দেওয়ায় কারণে পাকিস্তানি সেনারা আমার বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। যশোর সেনানিবাসে আমার বাবার ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়।
এটা আমরা জেনেছি একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মাধ্যমে। তাঁর নাম আলিমুজ্জামান। তিনি পরবর্তী সময়ে যশোরের সিভিল সার্জন হয়েছিলেন। তিনিও বাবার সঙ্গে আটক ছিলেন। আরও অনেকে সেখানে আটক ছিলেন।
‘আলিমুজ্জামান সাহেব আমাদের বলেছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের বিচার করে। বিচারকালে বিচারক আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তিনি আওয়ামী লীগ করেন কি না? বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করেছেন কি না?
বাবা নির্ভীকভাবে উত্তর দিয়েছেন, তিনি আওয়ামী লীগ করেন। কারণ, আওয়ামী লীগ তো বেআইনি দল নয়। তারপর বাবার মৃত্যুদণ্ড হয়।’
শেখ আবদুস সালামের জন্ম ১৯৪০ সালে, নড়াইল জেলার কালিয়া থানার (বর্তমানে উপজেলা) বিলবাওচ গ্রামে। স্থায়ী নিবাস পার্শ্ববর্তী রামনগর গ্রামে।
বাবা শেখ আবদুল গফুর, মা ফুলজান বেগম। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।
১৯৬০ সালে বিএ পাস করার পর শেখ আবদুস সালাম কিছুদিন পড়াশোনা স্থগিত রেখে সমাজসেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
এ সময় তিনি কয়েকটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে স্কুলগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্সে ভর্তি হন।
এর আগে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএড পাস করেন।
১৯৭০ সালে তিনি এমএ প্রথম পর্ব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। একাত্তরে এমএ শেষ পর্ব পরীক্ষা শুরু হলেও তীব্র গণ-আন্দোলনের কারণে সেই পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়।
শেখ আবদুস সালাম এক ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। ছেলে শেখ মিজানুর রহমান প্রকৌশলী। বর্তমানে সুইডেনপ্রবাসী। মেয়ে শেখ তাসলিমা মুন সুইডেনপ্রবাসী, শেখ সালমা নার্গিস ও শেখ মুসলিমা মুন সরকারি কর্মকর্তা। স্ত্রী মনোয়ারা সালাম বর্তমানে সুইডেনপ্রবাসী।
স্বাধীনতার পর কালিয়া মহাবিদ্যালয়ের নাম শহীদ শেখ আবদুস সালাম মহাবিদ্যালয় নামকরণ করা হয়েছে।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (সপ্তম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৮) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
সূত্র: ১৬ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত