বিজ্ঞাপন
default-image

নেত্রকোনা কলেজের দর্শনের প্রভাষক ছিলেন মো. আরজ আলী। একাত্তরের ১৩ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা কলেজের শিক্ষক হোস্টেল থেকে তাঁকে আটক করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

সেনারা ১৬ আগস্ট তাঁকে হত্যা করে। এর আগে তাঁকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় অমানুষিক অত্যাচার করা হয়।

মো. আরজ আলীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানিরা অভিযোগ এনেছিল যে তাঁর গ্রামের বাড়িতে মুক্তিবাহিনী লুকিয়ে ছিল।

১৬ আগস্ট বেলা ১০টায় দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীর তীরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে এ ব্যাপারে আবার জিজ্ঞাসা করা হয়।

জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি জি সি দেবের ছাত্র। মিথ্যা বলতে শিখিনি।’ তার পরেই পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যা করে মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়।

এ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর বোন আরশেদা বেগমের রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘ভয়াবহ একাত্তরের ১৩ আগস্ট। সন্ধ্যাবেলা।

আরজ ভাইকে প্রফেসর হোস্টেল থেকে ধরে মিলিটারি ক্যাম্পে নেওয়া হয়। আমার এক মামা, নাম ময়না।

তিনি মিলিটারি ক্যাম্পের পাশে প্রাইমারি টিচার্স টেনিং কলেজের হোস্টেলে থাকতেন। তাঁর ঘর থেকে হায়েনাদের তাণ্ডব দেখা ও কথা শোনা যেত।

মামা আমাকে বলেন, “নিস্তব্ধ রাত। আকাশে বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কী এক বীভৎস মর্মান্তিক দৃশ্য। আরজের পা দুটো বেঁধে ওপরে ছাদের রিংয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে।

পরনে আন্ডারওয়ার ভিন্ন আর কিছুই নেই। হানাদার বাহিনীর এক জল্লাদ আরজের গায়ে বেতের আঘাত করছে আর বলছে, শালা বল, মুক্তিদের কেন জায়গা দিয়েছিস, কেন ওদের খাবার দিয়েছিস, শুয়োরকা বাচ্চা।

বেতের আঘাতে শরীর থেকে দরদর রক্ত ঝরছে। আর জল্লাদরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। আরজ ভাই বলেছে, সত্যি বলছি আমি কিছুই জানি না।

আরজের কথায় হায়নার দল কর্ণপাত করছে না। ক্রমাগত অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এক পর্যায়ে আরজের আর্তচিৎকার শুনতে না পেয়ে তাকিয়ে দেখি ওর অবশ দেহটা স্থির হয়ে ঝুলে আছে।

একপর্যায়ে আরজ ভাই সংজ্ঞা ফিরে পেল। আবার বুটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে দিল তাঁর সারা শরীর।”

‘আগস্টের ষোল তারিখ সকাল দশটায় মিলিটারি ক্যাম্প থেকে চোখ বেঁধে আরজ ভাইকে কয়েকজন পাক মিলিশিয়া নিয়ে যায় সোমেশ্বরী নদীর তীরে।

পাকিস্তানি কর্নেল তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল এখনো বলুন, মুক্তিরা আপনার বাড়িতে ছিল কি না?

আরজ ভাই দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিল, জানি না। আমি দার্শনিক জি সি দেবের ছাত্র। মিথ্যা বলতে শিখিনি। মুহূর্তে কঠিন হয়ে যায় কর্নেলের মুখ।

এরপর গর্জে ওঠে অস্ত্র। দুজন সৈনিক এসে আরজ ভাইয়ের লাশটি সোমেশ্বরীর খরস্রোতে ফেলে দেয়।

তলিয়ে যায় আরজ ভাই।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৯, সম্পাদনা রশীদ হায়দার। ঈষৎ পরিমার্জিত)।

অবিবাহিত আরজ আলী ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে নেত্রকোনা কলেজে দর্শনের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।

এর আগে তিনি ঈশ্বরগঞ্জ কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি।

নেত্রকোনা জেলার নোয়াপাড়া গ্রামে ১৯৪৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মো. আরজ আলীর জন্ম। বাবা নবী হোসেন।

১৯৬১ সালে এন জারিয়া ঝাঞ্চাইল হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে নেত্রকোনা কলেজে ভর্তি হন।

১৯৬৩ সালে এইচএসসি ও ১৯৬৫ সালে বিএ পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে দর্শনশাস্ত্রে এমএ পাস করেন।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (তৃতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৪) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ২ জানুয়ারী, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত