একাত্তরে তরুণ এস বি এম মিজানুর রহমান (সাইফ মিজানুর রহমান) ছিলেন পিরোজপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (ট্রেজারি অফিসার)।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পিরোজপুরের জনগণ ও পুলিশ বাহিনীকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
৫ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিরোজপুর আক্রমণ করে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সামনে তাঁদের সেই প্রতিরোধ ভেঙে যায়।
এদিন তিনি নিখোঁজ হন। ধারণা করা হয়, আহত অবস্থায় তিনি পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন। সেনারা তাঁকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়নি।
এস বি এম মিজানুর রহমান ১৭ এপ্রিল ঘোষণা করেছিলেন, ‘আজ থেকে সমগ্র পিরোজপুর মহকুমা স্বাধীন বাংলাদেশের অংশ হিসেবে পরিগণিত হবে।
যাঁরা এখানে বসবাস করতে চান, বাংলাদেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবেই তাঁদের থাকতে হবে।
হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী যেকোনো মুহূর্তে আমাদের ওপর আক্রমণ চালাবার চেষ্টা করতে পারে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’
এ তথ্য জানা যায় তাঁর ভাই সাইফ ফাতেউর রহমানের রচনা থেকে। তিনি আরও লিখেছেন, ‘...১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ মুজিবনগরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সরকার গঠনের পরই তিনি পিরোজপুরের...স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র, সরকারি কর্মচারী, অন্যান্য পেশাজীবী ও স্থানীয় জনসাধারণের সহযোগিতায় এক সভার আয়োজন করেন।
তখনো পর্যন্ত সমগ্র পিরোজপুর মহকুমা সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত। ওই সভাতেই পিরোজপুরকে স্বাধীন বাংলাদেশের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেওয়া হয়।...
‘৫ মে শুরু হয় যুগপৎ বিমান ও গানবোট আক্রমণ। মরণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মিজান ও তাঁর সাথীরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি তাঁরা।
মিজান ও আরও অনেকের পরিণতি সম্পর্কে এরপর আর কোনো প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। কেউ বলেন সরাসরি প্রতিরোধযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।
কারও কারও মতে, গুরুতর আহত অবস্থায় পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তিনি, ফয়জুর রহমান ও রাজ্জাক সাহেব।
পরে তাঁদের অত্যন্ত নৃশংস ও যন্ত্রণাদায়কভাবে অত্যাচার করে গুলি করে মেরে নদীতে ফেলে দেয়া হয়।’ (আমার ভাই, স্মৃতি: ১৯৭১, পঞ্চম খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯২, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
এস বি এম মিজানুর রহমানের জন্ম নড়াইলে। পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক পরিবেশেই তিনি বড় হয়েছেন।
তাঁর মাতুল ছিলেন বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার স্পিকার ও মন্ত্রী সৈয়দ নওশের আলী। বাবা আফসার উদ্দীন আহমেদ ছিলেন নড়াইলের বিশিষ্ট আইনজীবী।
ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সদস্য এবং পরে আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। মা মতিয়া আহমেদও ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নড়াইলে এলে তাঁদের বাসাতেই উঠতেন।
মিজানুর রহমান মেধাবী ছিলেন। ১৯৬৩ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৬৪ সালে এমএ সম্পন্ন করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল সাহিত্যের প্রতি। দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় তাঁর বই প্রকাশিত হয়।
কলেজজীবন ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার অপরাধে কারাভোগ করতে হয় তাঁকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল সংসদের নির্বাচনে তিনি পত্রিকা সম্পাদক, পরে সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন।
কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদেরও সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অন্যতম সহসভাপতি ছিলেন।
এমএ পাস করার পর অধ্যাপনা পেশায় যোগ দেন। এ পেশায় থাকাবস্থায় সিএসএস (সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস) পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণও হন।
কিন্তু পুলিশ রিপোর্টের কারণে চাকরি পাননি। পরে ইউনাইটেড ব্যাংকে কিছুদিন চাকরি করেন।
বাংলায় স্বাক্ষর করার কারণে কর্তৃপক্ষ তাঁকে অভিযুক্ত করলে তিনি ঘৃণাভরে এ চাকরি ছেড়ে দেন।
পরে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রাদেশিক সরকারের অধীনে চাকরি নেন।
এস বি এম মিজানুর রহমান বিবাহিত ছিলেন। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (পঞ্চম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৬) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
সূত্র: ১৩ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত