বিজ্ঞাপন
default-image

বগুড়ার খ্যাতনামা আইনজীবী ছিলেন আবদুল জব্বার। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাঁর পৈতৃক বাড়ি জয়পুরহাট জেলার (তখন বগুড়া জেলার মহকুমা) মল্লিকপুর গ্রামে চলে যান।

এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকিস্তান সেনাবাহিনী বগুড়া ও জয়পুরহাটে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

কয়েক দিনের মধ্যেই পাকিস্তান সমর্থক বাঙালিদের নিয়ে গঠিত হয় শান্তি কমিটি। তাদের প্ররোচনায় ১৬ মে সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মল্লিকপুর গ্রামে আসে।

পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ওই গ্রামের লোকজন যে যেভাবে পারেন পালিয়ে যেতে থাকেন।

আবদুল জব্বার তাঁর মাকে সঙ্গে নিয়ে আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে বের হওয়া মাত্র সেনাদের সামনে পড়ে যান। সেনারা তাঁদের ঘিরে ফেলে।

একজন সেনা উদু‌র্তে তাঁকে তাঁর নাম, তিনি কী করেন ও কোন দল করেন জানতে চায়। তিনি অকপটে তাঁর নাম বলেন।

আরও বলেন, আমি জজকোর্টে ওকালতি করি এবং আওয়ামী লীগের একজন কর্মী।

আবদুল জব্বার এ কথা বলামাত্র সেনারা তাঁকে আটক করে। কিছুক্ষণ পর মায়ের সামনেই শুরু হয় তাঁর ওপর নির্যাতন।

এ সময় তাঁর বৃদ্ধা মা সেনাদের কাছে অনেক আকুতি-মিনতি করেন। কিন্তু এতে সেনাদের মন গলেনি।

পরে তাঁকে দড়ি দিয়ে জিপের সঙ্গে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এ তথ্য জানা যায় আবদুল জব্বারের ছোট ছেলে শাফিয়ী বিল্লাহ জব্বারের কাছ থেকে।

এ প্রতিবেদককে ২২ জানুয়ারিতে (২০১৪) দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা জানান।

আবদুল জব্বারের জন্ম ১৯২৬ সালে জয়পুরহাটের সদর উপজেলার চকবরকত ইউনিয়নের মল্লিকপুর গ্রামে।

জেলা সদর থেকে এ গ্রামের দূরত্ব সাত মাইল। বাবা মো. সফের উদ্দীন মণ্ডল, মা জোবেদা খাতুন।

তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় গ্রামের পাঠশালাতে।

পরে বগুড়া জিলা স্কুলে ভর্তি হন। এখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএসসি ও রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করেন। এলএলবি পাস করে তিনি যোগ দেন বগুড়া বারে।

আবদুল জব্বার মেধা ও যোগ্যতার গুণে অল্পদিনেই আইনজীবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। মানবিক গুণের জন্যও তাঁর সুনাম ছিল।

কারও শুকনো মুখ দেখলেই বলতেন, খাওয়া হয়নি বুঝি? বলেই পকেট থেকে টাকা বের করে দিতেন।

কত মানুষ যে তাঁর কাছে কতভাবে উপকৃত হয়েছে তার হিসাব নেই। জুনিয়র আইনজীবীদের কাছে তিনি এখনো ‘জব্বার ভাই’।

আবদুল জব্বার ছিলেন একজন কাজপাগল মানুষ। মক্কেল, আদালত, ফাইল ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন দিনরাত। অকারণে কাজ ফেলে রাখা তিনি কখনো পছন্দ করতেন না।

একজন নির্ভরযোগ্য আইনজীবী হিসেবে তাঁর বাসায় মক্কেলদের ভিড় লেগেই থাকত। সমাজসেবা ও খেলাধুলার প্রতিও ছিল তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ।

বই কেনা ও পড়ার নেশাও ছিল তাঁর মধ্যে প্রবল। সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

আবদুল জব্বার দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। বড় ছেলে মো. শাফিন জব্বার বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা।

ছোট ছেলে শাফিয়ী বিল্লাহ জব্বার সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত। মেয়ে তাহিরা সালোয়া জব্বার। স্ত্রী মোকসেদা বেগম। স্বাধীনতার পর তিনি শিক্ষকতা করতেন। ২০১২ সালে মারা গেছেন।

স্বাধীনতার পর বগুড়া জেলা আদালতের সামনের সড়কের নাম ‘শহীদ আবদুল জব্বার সড়ক’ করা হয়েছে।

পরে তাঁর নামে একটি ক্লাব ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া মল্লিকপুর গ্রামে তাঁর নামে ক্লাব ও পাঠাগার এবং নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার মঙ্গলবাড়িতে তাঁর নামে মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় রয়েছে। স্কুলটি পারিবারিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (পঞ্চম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৬) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

[email protected]

ঘোষণা: শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের অনেকের ঠিকানা ও ফোন নম্বর না থাকায় আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। তাদের ওপরের মেইলে কিংবা ০১৭২৭৫২২০১৬ মোবাইল নম্বরে অথবা সরাসরি যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। -সম্পাদক

সূত্র: ২৬ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত