বিজ্ঞাপন
default-image

অদূরে দাঁড়িয়ে মা-বাবা, ভাইবোন। নিরুপায় হয়ে তাঁরা দেখেছেন এক মর্মান্তিক হত্যার দৃশ্য। স্কুলশিক্ষক রাধা গোবিন্দ সরকারকে লাইনে দাঁড় করিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা। নরঘাতকের দল বুকে রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি চালাল নির্বিকারে। ঘটনাটি একাত্তরের ৭ জুলাই ভোরে।

শহীদ রাধা গোবিন্দ সরকার ছিলেন নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার বান্দাইখাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষক। তাঁর বিয়ের প্রস্তুতি চলছিল। কনেকে আশীর্বাদও করা হয়েছিল। কিন্তু টোপর পড়ে বরের বেশে যাওয়া হয়নি রাধা গোবিন্দের। গুলিতে লুটিয়ে পড়েছেন স্বজনদের সামনেই। বুকের তাজা রক্তে লাল হয়েছে দেশের মাটি।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে নওগাঁর সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তরুণ গবেষক মোস্তফা-আল-মেহমুদ রাধা গোবিন্দ সরকারের ছবি ও তথ্য পাঠান। নওগাঁর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণার ভিত্তিতে তাঁর রক্তঋণ ১৯৭১: নওগাঁ বইতে রাধা গোবিন্দের জীবনী রয়েছে। এই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা হয়।

১৯৪৪ সালের ১ আগস্ট বান্দাইখাড়া গ্রামে রাধা গোবিন্দ সরকারের জন্ম। পিতা হারান চন্দ্র সরকার, মা তরুলতা সরকার। তিনি চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে বড়। বান্দাইখাড়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, নওগাঁ বিএমসি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও নওগাঁ ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে তিনি বান্দাইখাড়া উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন।

বিনয়ী ও সজ্জন রাধা গোবিন্দ শিক্ষকতার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করছিলেন। জিলা স্কুলের শিক্ষক আরেক শহীদ অহীভূষণ সাহার সঙ্গে তিনি বান্দাইখাড়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন।

রাধা গোবিন্দ সরকারের ভাই শ্যামাসুন্দর সরকার এ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আত্রাই নদীর ধারে আমাদের গ্রামটি হিন্দুপ্রধান। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা গ্রামে দুই দফা হামলা চালিয়ে প্রায় ৫২ জনকে হত্যা করে। প্রথমবার ৭ জুলাই গণহত্যায় দাদা শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমার দাদা ও শিক্ষক অহীভূষণ সাহার উদ্যোগে আমাদের গ্রামটি নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিল। সেদিন খুব ভোরে রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে বান্দাইখাড়া ঘাটে এসে নামে। রাজাকার জানা সরদার দাদাকে পাকিস্তানি সেনাদের চিনিয়ে দেয়। তারা ধাওয়া করে দাদাকে ধরে গ্রামের আরও কয়েকজনের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করায়। লাইনের প্রথমেই দাদাকে দাঁড় করানো হয়। তারপর গুলি শুরু করে। দূর থেকে আমরা দেখছিলাম। প্রথমে দাদার ঊরুতে গুলি লাগে। তিনি মাটিতে পড়ে যান। পরে আমাদের সামনেই দাদার বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে।’

স্বাধীনতার পর বান্দাইখাড়া বাজারে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিফলকে রাধা গোবিন্দ সরকারসহ ৫২ জন শহীদের নাম রয়েছে। এ ছাড়া ২০১২ সালে আত্রাই উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলা পরিষদ চত্বরে নির্মিত শহীদ স্মৃতিসৌধেও তাঁর নাম রয়েছে।

গ্রন্থনা: ওমর ফারুক, নওগাঁ