প্রাণে রক্ষা পেতে মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মতিয়ুর রহমান আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁর দীর্ঘকালের সুহৃদ ও সাংসদ অবাঙালি কামরুজ্জামানের বাড়িতে। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো, কামরুজ্জামানের ছেলেই একসময় দলবলসহ এসে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
শহীদ মোহাম্মদ মতিয়ুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন উত্তরাঞ্চলের পার্বতীপুর রেলওয়ে হাসপাতালের আবাসিক উপসহকারী সার্জন। এর আগে তিনি খুলনা, রাজবাড়ী, লাকসাম, লালমনিরহাট ও সৈয়দপুরে রেলওয়ের হাসপাতালে কাজ করেছেন। পার্বতীপুর হাসপাতালে কাজ করার সময় তিনি রেলের আবাসিক বাসভবনেই থাকতেন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর বেশ সুনাম ছিল। মুক্তচিন্তার উদার মনের মানুষ ছিলেন মতিয়ুর রহমান।
গাইবান্ধার সাদুল্লাহপুর উপজেলার তরফপাহাড়ী গ্রামে মতিয়ুর রহমানের জন্ম ১৯২১ সালে। তাঁর বাবা রইসউদ্দীন মণ্ডল ছিলেন কৃষিজীবী। মায়ের নাম কুলসুম বেগম। সাত ভাইবোনের মধ্যে মতিয়ুর রহমান ছিলেন সবার ছোট। তিনি ১৯৪৩ সালে গাইবান্ধা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ১৯৪৯ সালে তিনি কলকাতার ক্যাম্বেল হাসপাতাল থেকে এলএমএফ পাস করেন। কর্মজীবন শুরু করেন রেলওয়ে বিভাগের চিকিৎসক হিসেবে। এর পরের বছর ছালেহা রানীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের দুই ছেলে মোসাদ্দেকুর রহমান ও সাদেকুর রহমান। তিন মেয়ে মোসফেকা বেগম, রেহেনা বেগম ও ফারাহ হামিদ। পরিবার সম্পর্কে বিশেষ জানা যায়নি। গাইবান্ধা প্রতিনিধি সাদুল্যাপুরে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, গ্রামের বাড়িতে শহীদ মতিয়ুর রহমানের পরিবারের কেউ থাকেন না। তাঁদের খোঁজ দিতে পারেন, গ্রামে এমন কেউও নেই।
শহীদ মতিয়ুর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও শহীদ হওয়ার বিরণ রয়েছে আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে। এ ছাড়া সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজের মাঠপর্যায়ের গবেষণামূলক বই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবন কোষ–এ মতিয়ুর রহমানের সচিত্র পরিচিতি ও শহীদ হওয়ার বর্ণনা রয়েছে। এ থেকে জানা যায়, সৈয়দপুর, পার্বতীপুর—এসব এলাকায় অবাঙালিদের প্রাধান্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মতিয়ুর রহমান এবং তাঁর আরেক সহকর্মী চিকিৎসক আবদুল গফুর আহমদ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্থানীয় অবাঙালি সাংসদ কামরুজ্জামানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সে সময় অবাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের মদদে এসব এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল।
একাত্তরের ১০ মে কামরুজ্জামানের অনুপস্থিতিতে তাঁর ছোট ছেলে শোয়েবের নেতৃত্বে নঈম, বাচ্চা খানসহ আরও অনেক অবাঙালি দল বেঁধে এসে চিকিৎসক মতিয়ুর রহমান ও চিকিৎসক আবদুল গফুরকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যায়। নির্মম নির্যাতনের পর বর্বরের দল মতিয়ুর রহমান ও আবদুল গফুরকে গুলি করে হত্যা করে। এলাকায় জনশ্রুতি আছে, ঘাতকেরা পরে তাঁদের লাশ রেলওয়ের বয়লারের চুল্লিতে ফেলে পুড়িয়ে ফেলেছিল। সে কারণে তাঁদের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।
শহীদ মোহাম্মদ মতিয়ুর রহমানের নাম রেলওয়ে বিভাগের বিশেষ সাময়িকী রেল বাতায়ন–এ প্রকাশিত রেল বিভাগের শহীদদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবনে মুক্তিযুদ্ধে দেশের শহীদ চিকিৎসকদের নামফলকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সৈয়দপুর ও লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালসংলগ্ন পার্কের শহীদ স্মৃতিফলকে শহীদ মতিয়ুর রহমানের নাম রয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে মতিয়ুর রহমানের নাম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তালিকাভুক্ত হয়নি।
গ্রন্থনা: আশীষ-উর-রহমান, ঢাকা