সাহসী ছিলেন মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। উনসত্তরের গণ–আন্দোলনের সময় বাগেরহাটে (তখন খুলনা জেলার মহকুমা) খুলনার পাঞ্জাবি জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে পুলিশ ছাত্রদের ওপরে গুলি চালালে দুজন ছাত্র নিহত হয়।
বহু ছাত্র প্রাণভয়ে মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের অফিস কক্ষে আশ্রয় নেয়। তিনি নিজে ছাত্রদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি একেবারে ভিন্ন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যান। তাঁর এক কথা— কাপুরুষের মতো মরব না। মরলে কয়েকজনকে মেরে মরব।
এপ্রিলের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী স্বাধীনতাবিরোধীদের সহায়তায় বাগেরহাটে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে থাকে।
এ অবস্থায় কিছুদিন পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ ও উন্নত অস্ত্র নিয়ে দেশে ফিরে পাকিস্তান সেনা ও স্বাধীনতাবিরোধীদের মোকাবিলা করবেন।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি ২১ অক্টোবর নিজ এলাকায় ফেরেন। ২৮ অক্টোবর স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে তিনি নিহত হন।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, তাঁর ছোট ছেলে জাকির খানের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় স্বাধীনতাবিরোধীদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে বাবা আমার বড় ভাই ও স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে নিয়ে ভারতে যান।
বাবার এই কাজগুলোতে মা ভীত ছিলেন। কারণ, সাত ছেলেমেয়েকে অনিশ্চিত অবস্থায় রেখে যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারটা বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় ছিল না।
সে বছর আমার বড় ভাই ও বড় বোনের এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। আর আমি ছিলাম সবার ছোট।
বাবা ভারতে এক মাসের ট্রেনিং ও কয়েকটি সীমান্তযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেড় মাস পর গ্রামে ফেরেন।
সেদিন ছিল ২১ অক্টোবরের রাত—প্রথম রমজান। সেহ্রির সময় তিনি আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। বাদোখালি প্রাইমারি স্কুলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প করেন।
বাবাকে ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা করে পাঠানো হয়েছিল।
কয়েকটি দল তাঁর অধীনে ছিল। এলাকাতে আসার পর প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েন বাবা। রাতে তিনি ক্যাম্পে না থেকে বাড়িতে থাকতেন।
২৮ অক্টোবর (১০ কার্তিক) সকালে বাবা বাড়ি থেকে ক্যাম্পে যান। তখন একবারও মনে হয়নি এই তাঁর শেষযাত্রা। বাবার এক কাঁধে ছিল স্টেনগান আরেক কাঁধে তাঁর অতি প্রিয় দোনলা বন্দুক।
সেদিন আমাদের এলাকায় বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট যুদ্ধ চলছিল। চারদিক থেকে শুধু গোলাগুলি শোনা যাচ্ছিল।
সন্ধ্যা থেকে মা ও আমার বড় বোনরা বাবার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে ক্যাম্প থেকে একজন এসে আমার মা ও বড় বোনকে জানায়, বাবার ফিরতে দেরি হবে। এরপর তাঁরা ঘুমাতে যান।
গভীর রাতে বাড়ির কাছে গুলির শব্দে আমার মাসহ আমাদের বাড়ির বড়রা সবাই জেগে ওঠেন।
বাবা গভীর রাতে ক্যাম্প থেকে একা নৌকায় বাড়িতে ফিরছিলেন। ওই সময় আমাদের বাড়ির কাছে স্বাধীনতাবিরোধীরা লুকিয়ে ছিল।
বাবা ঘাটে পৌঁছে নৌকা থেকে নামছিলেন। এমন সময় তারা তাঁকে পেছন থেকে গুলি করে পালিয়ে যায়।
গুলিবিদ্ধ বাবা নৌকার মধ্যে পড়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। (সাক্ষাৎকার ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।
মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের জন্ম ১৯৩২ সালের ১ ডিসেম্বর। বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বাদোখালি গ্রামে। বাবা মো. আবদুল গণি মোল্লা, মা বরু বিবি।
চিতলমারী হাইস্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক, বাগেরহাটের পিসি কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে আইএ ও ১৯৫২ সালে অর্থনীতিতে বিএ। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন।
এমএর ফল প্রকাশের আগেই চিতলমারী হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এখানে আট মাস দায়িত্ব পালনের পর পিসি কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক পদে যোগ দেন।
একাত্তরে ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর তিনটি ছাত্রপ্রিয় ও উচ্চ প্রশংসিত গ্রন্থ রয়েছে।
মো. মোয়াজ্জেম হোসেন তিন ছেলে ও চার মেয়ের জনক। ছেলে দেলোয়ার হোসেন (মৃত), আকতার হোসেন (চাকরিজীবী) ও জাকির হোসেন (চাকরিজীবী)।
মেয়ে রোকেয়া খান, সায়রা বেগম, তাহেরা ও রোকসানা। স্ত্রী ফাতেমা বেগম।
প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৭) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
[email protected]
সূত্র: ২৮ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত