একাত্তরে শহীদ মাহতাব উদ্দিন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভায় বিকশিত এক আলোকিত মানুষ। জয়পুরহাটের এই মানুষটি একাধারে ছিলেন কবি, লেখক, গীতিকার, সংগীতশিল্পী ও সংগঠক। ছিলেন রাজনীতিসচেতন। স্বদেশ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর মানুষের প্রতি ছিল তাঁর গভীর ভালোবাসা।
পেশাগতভাবে মাহতাব উদ্দিন সরকারি চাকরি করলেও দাপ্তরিক কাজের বাইরের পুরোটা সময় তিনি নিবেদিত থাকতেন সাহিত্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। তরুণ বয়স থেকেই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সব সময় রুখে দাঁড়াতেন। ছাত্রজীবনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটিশ সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে ১৯৩৪ সালে অনেকের সঙ্গে তাঁকেও আত্মগোপনে যেতে হয়। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান সরকারবিরোধী কবিতা লিখে স্বকণ্ঠে আবৃতি করায় রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত হন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে।
শহীদ মাহতাব উদ্দিনের জন্ম জয়পুরহাট জেলা শহরের বানিয়াপাড়ায়, ১৯১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। তাঁর বাবা হাবিবুল্লাহ আহমেদ, মা জমিরন বেগম। মাহতাব উদ্দিন ১৯৩৬ সালে জয়পুরহাটের কালাই উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতা জুবিলি কমার্শিয়াল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা পাস করে রেলওয়ের ট্রেন কন্ট্রোলার পদে যোগ দেন। এরপর স্টেশনমাস্টার হিসেবে পদোন্নতি পান। সর্বশেষ কর্মক্ষেত্র ছিল ঠাকুরগাঁও।
মাহতাব উদ্দিন শৈশব থেকেই লেখালেখির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। ভালো গান গাইতেন। তবে কলকাতা গিয়ে তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের সান্নিধ্যে এসে সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ হন। তিনি কবিতা, ছড়াসহ প্রচুর গান লিখেছেন। তৎকালে ঢাকা ও রংপুর বেতারের গীতিকার ছিলেন। এই দুই বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর লেখা অনেক গান সম্প্রচারিত হয়েছে। প্রেমযাত্রা নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে কুড়িগ্রামে কর্মরত থাকার সময় স্থানীয় সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কুড়িগ্রাম তথ্য মজলিশ’ কবি মাহতাব উদ্দিনকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে।
মাহতাব উদ্দিনের স্ত্রী মালেকা বেগম মুক্তিযুদ্ধের আগেই ১৯৬০ সালে মারা যান। তাঁদের আট ছেলেমেয়ের সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।
রেলওয়েতে চাকরির সুবাদে রংপুর, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁওসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা শহরেই মাহতাব উদ্দিনের জীবনের বেশি সময় কেটেছে। যেখানে চাকরি করেছেন, সেখানেই তিনি যুক্ত হয়েছেন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। সখ্য গড়ে তুলেছেন স্থানীয় বিশিষ্টজনদের সঙ্গে। গানে, আবৃত্তিতে, মানুষকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এসব কাজ পাকিস্তানপন্থী রাজাকার ও তাদের প্রভু হানাদার বাহিনী ভালো চোখে দেখত না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মাহতাব উদ্দিন কর্মরত ছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ে। একাত্তরের ২২ এপ্রিল রেলের আবাসিক এলাকার বাসভবন থেকে অবাঙালিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার সেনারা তাঁকে তুলে নেয়। বাসায় তিনি একাই ছিলেন, সন্তানেরা ছিলেন কুড়িগ্রামে। মাহতাব উদ্দিনকে পাশবিক নির্যাতনের পর হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে। ঠাকুরগাঁও চিনিকলের গণকবরে তাঁর লাশ মাটিচাপা দেয়। ফলে পরিবার তাঁর লাশ পায়নি।
শহীদ মাহতাব উদ্দিনের ছোট ছেলে জয়পুরহাট জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও বিশিষ্ট গণসংগীতশিল্পী আহমেদ মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাবার মৃত্যুর খবর তাঁরা প্রথম জানতে পারেন কুড়িগ্রামের পাঁচগাছি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউজ্জমানের মাধ্যমে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবেদনা জানিয়ে তাঁদের পরিবারে কাছে চিঠি ও দুই হাজার টাকার অনুদান পাঠিয়েছিলেন। রাজধানীর কমলাপুরে রেলস্টেশনের শহীদ স্মৃতিসৌধে শহীদের তালিকায় তাঁর বাবার নাম রয়েছে। এ ছাড়া স্বাধীনতার পরে জয়পুরহাট শহরের বাইপাসে বানিয়াপাড়া এলাকায় তাঁর বাবার স্মরণে ‘শহীদ কবি মাহতাব উদ্দিন সড়ক’ নামে একটি সড়ক এবং ‘শহীদ কবি মাহতাব উদ্দিন বিদ্যাপীঠ’ নামে একটি বিদ্যালয়ের (প্রথম থেকে দশম শ্রেণি) নামকরণ করা হয়েছে। তবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সরকারি তালিকায় তাঁর নাম না থাকায় তাঁদের পরিবারের গভীর মনোবেদনা রয়েছে।
গ্রন্থনা: আরিফুল হক, রংপুর