বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরে মোহাম্মদ শামসুজ্জামান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। ২১ মে সকালে তিনি তাঁর অফিসে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তান নৌবাহিনীর কয়েকজন সদস্য তাঁকে তাদের চট্টগ্রাম ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। এর পর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এদিনের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর মেয়ে সালমা চৌধুরীর (জলি) লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘সেদিন শুক্রবার ২১ মে, ১৯৭১।

প্রতিদিনের মতো বাসা থেকে আয়াতুল কুরসি পড়ে ড্রাইভারসহ গাড়ি নিয়ে আব্বা অফিসে রওনা হলেন। দুপুর একটার মধ্যে বাসায় চলে আসার কথা।

আম্মা অফিসে ফোন না করেই খাবার বেড়ে আমাদের ডাকছিলেন। কেন জানি বলতে পারব না মন ভালো লাগছিল না। তাই খাওয়া শুরু করার আগে অফিসে ফোন করলাম। ফোন কেউ ধরলেন না।

বললাম, দশ মিনিট বসি। এলে একসাথেই খাব। সেই সুযোগ আর এল না। ১০, ১৫, ২০, ৩০ মিনিটও পার হয়ে গেল, আব্বা এলেন না।

তখন নূর হোসেন [তখন চট্টগ্রাম বন্দরের নির্বাহী প্রকৌশলী] চাচাকে ফোন করে জানতে পারি, আব্বা বলেছেন, ওনার আসতে দেরি হবে, কারণ চেয়ারম্যান [কমোডর মালিক, পাকিস্তানি] সাহেব ওনাকে একটা কাজ দিয়েছেন করতে।

যখন বললাম, আধা ঘণ্টার ওপরে অফিসে ফোন করে কাউকে পাচ্ছি না, তখন উনি চিন্তিত হয়ে বললেন, “আমি দেখছি”। আল্লাহ আল্লাহ করছি এমন সময় ফোন এল। নূর হোসেন চাচা বললেন, আব্বাকে চাটগাঁ নৌঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখনই আমার বড় ভাই ছুটল চেয়ারম্যানের বাসায়।

আব্বা কোথায় জানতে চাইল। ভাইয়াকে বললেন, “বাসায় যাও, আমি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।” ঘণ্টা খানেক পরে মেসবাউদ্দিন চাচা ফোন করে জানালেন, চেয়ারম্যান বলেছেন আব্বা নৌঘাঁটিতেই ছিলেন।

ওখানে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছিল, ছেড়েও দেওয়া হয়েছে অনেকক্ষণ। হয়তো ভয় পেয়েছেন, কোথাও লুকিয়ে আছেন। চলে আসবেন। আম্মা বললেন, “যদি ছেড়েই দেয়, তাহলে লুকাবে কেন?”

‘চাচাও সঠিক উত্তর দিতে পারলেন না। শুনে সে যে কী কান্না আমার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল, বলতে পারব না।...আব্বা আর ফিরে আসেননি।’ (সালমা চৌধুরী (জলি)-র রচনা। স্মৃতি ১৯৭১, প্রথম খণ্ড (প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮), সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

মোহাম্মদ শামুসজ্জামান ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। রবীন্দ্রসংগীত ছিল তাঁর প্রিয়। তাঁর বাড়িতে সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল।

মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদান চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সহযোগিতা।

সালমা চৌধুরী জলির রচনা থেকে জানা যায়, মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের রেকর্ড ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের যে ক্যাসেট বাজানো হতো, তা মোহাম্মদ শামসুজ্জামান তাঁর নিজের সংগ্রহ থেকেই দিয়েছিলেন।

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বন্দরে ভিড়ে থাকা জাহাজ থেকে অস্ত্র যাতে না নামানো হয়, সে ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল।

এ কারণে তিনি পাকিস্তানিদের বিরাগভাজন হন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র চালু এবং সেখান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারেও তিনি সহায়তা করেন।

মোহাম্মদ শামসুজ্জামানের জন্ম ১ মার্চ ১৯২৬, নরসিংদী জেলার মধ্যনগর গ্রামে। বাবার নাম মোহাম্মদ তায়েবউদ্দিন আহমদ।

কুমিল্লা জিলা স্কুল ও পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজে লেখাপড়া করে কলকাতার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। ১৯৬০ সালে হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান।

১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে পোর্ট অথরিটিতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে প্রধান প্রকৌশলী হন।

মোহাম্মদ শামসুজ্জামান তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক।

সূত্র: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (তৃতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৪)।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ২২ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত