বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের ভয়াল ২৫ মার্চের ঠিক এক মাস পর, ২৫ এপ্রিল ডা. সুলেমান খানের গ্রামের বাড়িতে মুসলিম লীগের স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী একদল অস্ত্রধারী আক্রমণ করে। তারা খেজুরগাছের গুঁড়ি দিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে তাঁকে গুলি করে।

গুলি লেগেছিল তাঁর বুকে। পাকিস্তানি সমর্থকেরা সুলেমান খানকে শনাক্ত করেই হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে। এর পরও কয়েক ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন।

পরে গ্রাম থেকে চাঁদপুর শহরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় পথে তাঁর মৃত্যু হয়।

এ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর ছোট ভাই শিল্পী হাশেম খানের রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘...দরজা ভে​েঙ ওরা ঘরে ঢুকল। [...] একজনের হাতে রাইফেল বাগিয়ে ধরা। তার মুখে মুখোশ। সে ধমক দিয়ে মনসুরকে বলল, টাকা দে। টর্চ হাতে অন্য ডাকাত টর্চটা ঘুরিয়ে বড় ভাইয়ের দিকে স্থির করে রাখল।

তারপর রাইফেলের গোড়া ধরে রাইফেলটাও তাঁর দিকে ঘুরিয়ে দিতে দিতে বলল এই ‘দুগা না অন্য দুগা’।

অর্থাৎ আমার কথা ও ডাক্তারের কথা বলা হচ্ছে। তারপরই ফিসফিসিয়ে রাইফেলধারীকে বলল, এ ডাক্তার, এটাই ডাক্তার। বড় ভাই উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, টাকা দিচ্ছি, কিন্তু মেয়েদের...। তার কথা শেষ হলো না।

রাইফেল গর্জে উঠল। ওরা দাদাকে গুলি করেছে। আমাকেও। প্রচণ্ড আঘাতে হুমড়ি খেয়ে আমি পড়ে গেলাম বিছানায়।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, প্রথম খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

হাশেম খানের রচনা থেকে আরও জানা যায়, ২৫ এপ্রিলের আগের দিন সুলেমান খান তাঁকে বলেছিলেন, দুই-তিন দিনের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন ও পার্টির কয়েকজন তাঁদের বাড়িতে আসবেন।

তাঁরা এলে গোপনে হাতবোমা তৈরি এবং অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়ের চেষ্টা করবেন। কিন্তু সে সুযোগ তিনি আর পাননি।

সুলেমান খান বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। উদীচী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠায় তাঁর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। এ সংগঠনের গণসংগীতের প্রথম দিকের ক্লাসগুলো ঢাকায় তাঁর গোপীবাগের বাড়িতে হতো।

গোপীবাগের তরুণদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘তরঙ্গ’ নামে একটি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি।

উনসত্তরের গণ-আন্দোলনসহ পরবর্তী আন্দোলনে এ সংগঠনের মাধ্যমে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

এ সংগঠন থেকে একুশের দুটি সংকলন সম্পাদনা ছাড়াও চিকিৎসাবিষয়ক কিছু প্রবন্ধ রচনা করেন। সত্যেন সেনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন তিনি।

সুলেমান খানের জন্ম ১৯৪০ সালে। চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার শেখদী গ্রামে। বাবার নাম মো. ইউসুফ খান। মা নূরেননেছা খান।

১৯৫৮ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএসসি এবং ১৯৬৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।

উনসত্তর পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নি ডাক্তার হিসেবে কাজ করার পর তিনি টঙ্গী জুট মিলের চিকিৎসক নিযুক্ত হন।

টঙ্গীতে কাজ করার পাশাপাশি বিকেলে গোপীবাগে রাশেদ মেডিকেল নামে একটি ফার্মেসিতেও বসতেন। রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়ে দরিদ্র মানুষের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করা ছিল তাঁর অন্যতম ব্রত।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে তিনি কয়েক দিন পর গ্রামের বাড়িতে যান।

বিবাহিত ছিলেন সুলেমান খান। তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। তাঁর স্ত্রীর পরে অন্যত্র বিয়ে হয়।

সূত্র: শিল্পী হাশেম খান। স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (পঞ্চম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৬) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

<[email protected]>

সূত্র: ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত