বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের ২৫ নভেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মীর আবদুল কাইয়ুম ঘোড়ামারায় তাঁর শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক অবাঙালি অনুচর এসে ক্যাপ্টেন তাঁকে যেতে বলেছেন বলে ডেকে নিয়ে যায়। সেই রাতেই সেনারা একটি গুলি খরচ না করেই পদ্মার পাড়ে আরও কয়েকজনের সঙ্গে নৃশংসভাবে তাঁকে জীবন্ত কবর দেয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন মীর আবদুল কাইয়ুম। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে তাঁর ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি দেশে থেকেই দেশের কথা ভেবেছেন এবং গোপনে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছেন।

এ সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী মাসতুরা খানম লিখেছেন, ‘...যখন ৭১-এ অনেকেই দেশ ছেড়ে ওপারে গেলেন তখনো কাইয়ুমের কণ্ঠে একই কথা “দেশ ছেড়ে যাব না, দেশে থেকে দেশের স্বাধীনতার কথা ভাবব, দেশ একদিন স্বাধীন হবেই, কিন্তু দেখে যেতে পারব তো?” তাঁর এই সংশয়ই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো, স্বাধীনতা আর তাঁর দেখে যাওয়া হলো না।’ (স্মৃতি ১৯৭১, প্রথম খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের বেশির ভাগ শিক্ষক ছিলেন পাকিস্তানি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেও ছিল অনেক অবাঙালি। তারা কেউ কেউ ছিল সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডে সহায়তা করার কারণে মীর আবদুল কাইয়ুম তাদের বিশেষত তাঁর বিভাগের পাকিস্তানি শিক্ষকদের নজরে পড়ে যান।

২৫ নভেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিভাগের অবাঙালি কর্মচারী তৈয়ব আলী মীর আবদুল কাইয়ুমের কাছে এসে জানান, এক ক্যাপ্টেন তাঁকে জোহা হলে যেতে বলেছে। সেনারা তখন অদূরে রাস্তায় আড়ালে ছিল।

একাত্তরের এপ্রিলে মীর আবদুল কাইয়ুমের মালোপাড়ার বাসা সেনারা পুড়িয়ে দিয়েছিল। এ কারণে তিনি ঘোড়ামারায় তাঁর শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মালোপাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন শিক্ষক থাকতেন। ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত শিক্ষক কোয়ার্টার না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের জন্য ওই বাসাগুলো ভাড়া নিয়েছিল।

মীর আবদুল কাইয়ুম প্রথমে যেতে চাননি। কিন্তু তৈয়ব আলীর পীড়াপীড়িতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যান। কিছুক্ষণ পর তৈয়ব আলী তাঁর শ্বশুরবাড়িতে এসে জানান, পাকিস্তানি সেনারা রাস্তায় ছিল। তারা তাঁকে জোহা হলে নিয়ে গেছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহী শহর থেকে মীর আবদুল কাইয়ুমসহ মোট ১৪ জনকে (মতান্তরে ১৭ জন) ওই রাতে একই কায়দায় আটক করে। তারপর তাদের পদ্মা নদীসংলগ্ন বোয়ালিয়া ক্লাবের কাছে নিয়ে হাত বেঁধে জীবন্ত মাটিচাপা দেয়। স্বাধীনতার পর ৩০ ডিসেম্বর স্থানীয় লোকজন এই গণকবর চিহ্নিত করে। সেখান থেকে মীর আবদুল কাইয়ুমসহ সবার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত সবার হাত পেছনে বাঁধা ছিল। তাঁকে পরে কাদিরগঞ্জে সমাহিত করা হয়।

মীর আবদুল কাইয়ুমের জন্ম ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের ঘাগড়া গ্রামের মীরবাড়িতে, ১৯৩৯ সালের ৬ জুলাই। বাবা মীর সুবেদ আলী। ছোটবেলায় তিনি বাবাকে হারান। গফরগাঁও কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জনের পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাঁকে খুব পছন্দ করত।

তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। মৃত্যুর সময় ছোট সন্তান তাঁর স্ত্রীর গর্ভে ছিল। স্বাধীনতার পর তাঁর জন্ম। বড় ছেলে টেলিকম ব্যবসায়ী। ছোট ছেলে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। বড় মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক। ছোট মেয়ে প্রবাসী।

সূত্র: মাহবুবা কানিজ (শহীদ আবদুল কাইয়ুমের বড় মেয়ে)। স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (প্রথম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯১) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত